যৌন সংসর্গে অশনি সংকেত! এই মারণ ব‍্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এড়াতে জানতেই হবে যে তথ্য

Mycoplasma Genitalium: পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই সংক্রমণ অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং এর ফলে বন্ধ্যাত্বও দেখা যায়।

বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের সংক্রমণ। এই ব‍্যাকটেরিয়াটি ছড়ায় যৌন সংসর্গের মাধ্যমে। যোনিপথে সঙ্গমের সময় ছাড়াও, পায়ুসঙ্গম এবং ওরাল সেক্সের সময় ছড়ায় এই মারণ ব্যাকটেরিয়া। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই সংক্রমণ অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এবং এর ফলে বন্ধ্যাত্বও দেখা যায়। সমস্যা হলো, একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যার মানুষের শরীরে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের সংক্রমণের কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না।

তার থেকেও দুশ্চিন্তার বিষয় এই মুহূর্তে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের সংক্রমণ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, তাই রোগের ধরন সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ডাক্তারদেরও নেই। সারা বিশ্বের ডাক্তাররা চিন্তিত হয়ে আর্জি জানাচ্ছেন, এই ব্যাকটেরিয়া থেকে সংক্রমিত রোগ এবং সেই রোগগুলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও বিশদে গবেষণা হোক।

ইতিমধ্যেই একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-ক্ষমতা গড়ে তুলছে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম। ফলে একে ঘায়েল করার মোক্ষম যে অস্ত্র, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক, সেটি-ই আর কাজ করছে না। সেখানেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সারা বিশ্বের ডাক্তার ও গবেষকরা।

আরও পড়ুন: মাতৃগর্ভেই মৃত্যুফাঁদ! ভ্রূণেও নিরাপদ নয় শিশু, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা

সংক্রমণের লক্ষণ কী কী?
যে সমস্ত পুরুষদের মধ্যে মাইকোপ্লাজ়মা সংক্রমণের লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, সেই লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো পুরুষাঙ্গ থেকে জলের মতো তরল ক্ষরিত হওয়া; মূত্রত্যাগের সময় ব্যথা, জ্বালা বা তীক্ষ্ণ কিছু বিঁধে যাওয়ার অনুভূতি।

অন্যদিকে মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যোনি থেকে অস্বাভাবিক তরল ক্ষরিত হচ্ছে। যৌন সঙ্গমের সময় ব্যথা এবং রক্তপাতের ঘটনাও জানাচ্ছেন অনেক মহিলাই। পিরিয়ডস না চলাকালীনও রক্তপাত হচ্ছে মহিলাদের এবং নাভির নিচ থেকে তলপেটের (পেলভিক অঞ্চলে) যন্ত্রণাও ভুগছেন সংক্রমিত মহিলা। এখানে আবারও উল্লেখ করা হচ্ছে, পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সংক্রমণের পরেও কোনও রকম লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে।

মাইকোপ্লাজ়মার সংক্রমণের সঙ্গে কী কী রোগের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা?
বহু মহিলা ও পুরুষ বিভিন্ন কঠিন রোগের শিকার হচ্ছেন এবং সেগুলির সঙ্গে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম সংক্রমণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

গবেষকরা একাধিক গবেষণায় দেখেছেন, পুরুষদের শরীরে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের সংক্রমণের সঙ্গে অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস, ক্রনিক নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস, বালানোপসথাইটিস, ক্রনিক প্রস্টাটাইটিস, এবং অ্যাকিউট এপিডিডাইমিসের সম্পর্ক রয়েছে।

অন্যদিকে মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁদের নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস, ব্যাক্টেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস এবং ভ্যাজিনাইটিস, সার্ভিসাইটিস, পেলভিক ইনফ্ল্যামেটারি ডিজি়জ়, এন্ডোমেট্রাইটিস এবং স্যালপিনজাইটিসের মতো অসুখ।

অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস
ইউরেথ্রাইটিস বলতে ইউরেথ্রা বা মূত্রনালীর প্রদাহকে (ইনফ্ল্যামেশন) বোঝায়। গনোরিয়া ব্যতীত যে কোনও ইউরেথ্রাইটিসকে বলে অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস। যে সমস্ত পুরুষেরা অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিসে ভোগেন, তাঁদের পনেরো থেকে পঁচিশ শতাংশ পুরুষের মূত্রনালিতে এই ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিসে আক্রান্ত নব্বই শতাংশ পুরুষদের পুরুষাঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক ক্ষরণ হতে দেখা গিয়েছে।

এই রোগে আক্রান্ত নারী ও পুরুষ, উভয়েরই সঙ্গমের সময় যৌনাঙ্গে ব্যথা, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ, পেটে ব্যথার মতো সমস্যার সম্মুখীন ঘটেছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাদা বা ঘোলাটে পদার্থ ক্ষরণ হতে পারে পুরুষাঙ্গ থেকে, পাশাপাশি দেখা যায় পুরুষাঙ্গে ব্যথা কিংবা ঘা। মহিলাদের ক্ষেত্রে আবার যোনি থেকে হলুদ বা সবুজ রঙের তরল বা সান্দ্র পদার্থ ক্ষরিত হওয়ার ঘটনাও জানা গেছে।

যৌনাঙ্গের কোশে আটকে আছে মাইকোপ্লাজ়্মা (সূত্র: মলিকিউলার বায়োলজি ইনস্টিটিউট অফ বার্সেলোনা)

ক্রনিক নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস
ক্রনিক নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিসের লক্ষণগুলি অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিসের মতোই, তবেএই ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরেও একটানা মূত্রনালিতে প্রদাহের সমস্যা দেখা যায়। ডক্সিসাইক্লিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরেও দেখা চল্লিশ শতাংশ রোগীর সমস্যার কোনও সুরাহা হতে দেখা যায়নি, জানা যাচ্ছে একটি গবেষণা থেকে।

বালানোপসথাইটিস
গবেষকেরা বালানোপসথাইটিসের সঙ্গে মাইকোপ্লাজ়মা সংক্রমণের সূত্র পেয়েছেন একটি গবেষণায়।

পুরুষাঙ্গের একদম ওপরের গোলাকার অংশ বা গ্ল্যান্স পেনিসে ইনফ্ল্যামেশন হয়। গ্ল্যান্স পেনিসের প্রদাহকেই বালানাইটিস বলে। বালানোপসথাইটিসে, এর পাশাপাশি প্রিপিউস বা লিঙ্গের বাইরের চামড়াতেও প্রদাহ দেখা যায়, যাকে পসথাইটিস বলে।

মাইকোপ্লাজ়মা-জনিত অ্যাকিউট নন-গনোকক্কাল ইউরেথ্রাইটিস হলে বালানোপসথাইটিসও পাশাপাশি দেখা যেতে পারে।

ক্রনিক প্রস্টাটাইটিস
প্রস্টাইটিসে মূত্রত্যাগে সমস্যা বা মূত্রত্যাগের সময় জ্বালা বা ব্যথার মতো সমস্যায় ভুগতে পারেন পুরুষরা। হঠাৎ করে মূত্রত্যাগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে, এবং এর পাশাপাশি মূত্রত্যাগের ইচ্ছে রাতের দিকে আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও মূত্রে রক্ত দেখা যেতে পারে এবং মূত্রের রঙ ঘোলাটে হতে পারে।

একটি গবেষণায় ক্রনিক প্রস্টাইটিসে আক্রান্ত ১৩৫ জন পুরুষের মধ্যে ৫ জনের (চার শতাংশ) শরীরে মাইকোপ্লাজমা জেনিটেলিয়ামের সংক্রমণের ঘটনা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ক্রনিক অ্যাব্যাক্টেরিয়াল ইনফ্ল্যামেটারি প্রস্টাইটিসে আক্রান্ত আঠেরো জন পুরুষের মধ্যে দুইজনের শরীরে (এগারো শতাংশ) মাইকোপ্লাজমা জেনিটেলিয়ামের সংক্রমণের ঘটনা নজরে এসেছে।

অ্যাকিউট এপিডিডাইমিস
মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম সংক্রমণের ফলে অ্যাকিউট এপিডিডাইমিস দেখা যেতে পারে পুরুষদের মধ্যে। অ্যাকিউট এপিডিডাইমিসের নেপথ্যে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের পাশাপাশি ক্ল্যামাইডিয়া ট্র্যাকোম্যাটিস নামের ব্যাক্টিরিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যাকিউট এপিডিডাইমিসের নেপথ্যে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম দায়ী কি না, তা বুঝতে এপিডিডাইমাল ফ্লুইড পরীক্ষা করা প্রয়োজন, এবং এর পাশাপাশি মূত্র ও মূত্রনালির সোয়্যাব পরীক্ষা করা দরকার।

অ্যাকিউট এপিডিডাইমিসে শুক্রথলি ফুলে লাল হয়ে যেতে পারে, সঙ্গে যন্ত্রণা তো আছেই। এছাড়াও মূত্রত্যাগের সময় জ্বালা এবং বীর্যর সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস এবং ভ্যাজিনাইটিস
সেন্টার ফর ডিজি়জ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে জানা যাচ্ছে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিসে সাদা বা ধূসর পদার্থ যোনি থেকে বেরতে পারে, মূত্রত্যাগের সময় মহিলারা জ্বালা বা ব্যথা অনুভব করতে পারেন, যোনি থেকে আঁশটে দুর্গন্ধ দেখা যায়। দুর্গন্ধ বিশেষ করে বাড়ে সঙ্গমের পরে। এর পাশাপাশি যোনি এবং তার চারপাশে চুলকানি দেখা যায়।

মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম লন্ডনের 'সেন্ট মেরিজ' হাসপাতালের এসটিডি ক্লিনিকে আসা মহিলাদের যৌনাঙ্গের নিম্নাংশে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। এদিকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের একটি হাসপাতাল জানায়, তারা চুয়াত্তর জন মহিলার মধ্যে পাঁচ জনের সার্ভিক্সে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়ামের সন্ধান পেয়েছেন। এই ব্যাকটেরিয়া আদৌ ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস বা ভ্যাজিনাইটিসের কারণ কি না, সে-বিষয়ে গবেষকদের সন্দেহ আছে, কোনও স্পষ্ট প্রমাণও এর সপক্ষে পাওয়া যায়নি। তবে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু মহিলার শরীরে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস বা ভ্যাজিনাইটিসের নেপথ্যে একমাত্র এই ব্যাকটেরিয়াই যোগসূত্র হিসেবে পাওয়া গেছে। ব্যাকটেরিয়াটির সঙ্গে ভ্যাজিনোসিস বা ভ্যাজিনাইটিসের যোগসূত্র স্পষ্ট না হলেও, যে-সমস্ত মহিলা ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস বা ভ্যাজিনাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের যৌনাঙ্গে মাইকোপ্লাজ়মা জেনিটালিয়াম পাওয়া গেছে।

পেলভিক ইনফ্ল্যামেটারি ডিজি়জ় এবং বন্ধ্যাত্ব
পেলভিক ইনফ্ল্যামেটারি ডিজি়জে়র একটি কারণ হলো এই ব্যাকটেরিয়া। তবে এই রোগটির একাধিক কারণ থাকতে পারে এছাড়াও।

এই রোগে জরায়ুর ঊর্ধ্বভাগ, বিশেষ করে ফ্যালোপিয়ান টিউব, এমনকী, ডিম্বাণু অবধি ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঘটতে পারে। যার ফলে পেটে ব্যথা, মূত্র ত্যাগ ও সঙ্গমের সময় প্রদাহ, যোনি থেকে অস্বাভাবিক ক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা যায়। আর যেহেতু ডিম্বাণু এবং ফ্যালোপিয়ান টিউব আক্রান্ত হয়, বহু মহিলাই বন্ধ‍্যাত্বের শিকার হ’ন। এই ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, এমন সতেরো থেকে বাইশ শতাংশ মহিলা বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়েছেন।

এন্ডোমেট্রাইটিস
বেশ আগের কিছু গবেষণাতে মহিলাদের এন্ডোমেট্রিয়ামের বায়োপসি করে সেখানে মাইকোপ্লাজ়মার সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই মহিলারা হাসপাতালে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, সঙ্গে পেলভিক ইনফ্ল্যামেটারি ডিজি়জে়র সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন।এন্ডোমেট্রাইটিসে আক্রান্ত ষোলো শতাংশ মহিলার ক্ষেত্রে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

এই ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধের উপায় কী?
যে কোনও যৌনরোগের মতোই, এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করতে যে কোনও রকম যৌন সঙ্গমের সময় নারী ও পুরুষ- উভয়েরই কন্ডোম ব্যবহার করা উচিত‌।

ব্যাকটেরিয়াটি শরীরে পাওয়া গেলে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই তা প্রতিরোধ করা হয়। সেন্ট্রাল ফর ডিজি়জ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফে জানানো হচ্ছে যে সমস্ত রোগীর শরীরে এই ব্যাকটেরিয়াকে ম্যাক্রোলাইডের সাহায্যেই প্রতিরোধ করা যায়, তাঁদের ক্ষেত্রে দিনে দু'বার এক সপ্তাহের জন্য একশো মিলিগ্রাম ডক্সিসাইক্লিন দেওয়া যেতে পারে। এবং তারপরে চালু করতে হবে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কোর্স। যেখানে আরও তিন দিন দিনে একবার করে ৫০০ মিলিগ্রামের অ্যাজিথ্রোমাইসিন প্রয়োগ করতে হবে।

অন্যদিকে যাদের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া ম্যাক্রোলাইডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাঁদের ক্ষেত্রে দিনে দু'বার এক সপ্তাহের জন্য একশো মিলিগ্রাম ডক্সিসাইক্লিন দিতে হবে। এবং তারপরে টানা সাতদিন দিনে একবার করে ৪০০ মিলিগ্রাম মক্সিফ্লোক্সাসিন দিতে হবে। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া করা বিপজ্জনক।

More Articles