মদ, গাঁজা, সিদ্ধিই ভোগ, সুন্দরবনের লোকদেবতাদের ঘিরে থাকা রহস্য আজও অবাক করে

Sundarbans Deities: বনবিবি অন্য কোনও দেব-দেবীর মতো উগ্র বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। বরং সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা দেবী।

সুন্দরবন। প্রাকৃতিক এক বিস্ময়ের ডাকনাম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনেই আছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই সুন্দরবনকে প্রকৃতির জাদুঘর বললেও কম বলা হবে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সহ বিচিত্র ধরনের সব পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আঁতুড়ঘর এই সুন্দরবন। সুন্দরী গাছের নামেই বিশ্ব এই বনকে ডাকে ‘সুন্দরবন’ নামে। সুন্দরবনের সমাজ জীবন মূলত গ্রামপ্রধান। কৃষির জন্য, ফসল উৎপাদনের জন্য এক সময় সুন্দরবন কেটে লোকালয় তৈরি হয়েছে। সমুদ্র, নদী-খাল আর বাদাবন বেষ্টিত এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বাঁচে। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা নেই। তার উপর জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয়। রাতে ‘তেনাদের’ ভয়। এইসব প্রতিকূল পরিবেশে সুন্দরবনের মানুষ নিজেদের অসহায় মনে করেন আর ভয় কাটিয়ে উঠতেই বিভিন্ন লৌকিক দেবতাদের পুজো করেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই দেবতারাই তাদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। এইসব লৌকিক দেবতাদের মধ্যে চেনা পরিচিত কিছু হিন্দু দেবদেবী যেমন আছে তেমনই এমন অনেক দেবতা আছে যার নাম সুন্দরবনের বাইরে আর কেউ কখনও শোনেননি।

বনবিবি

বনবিবি অরণ্যের দেবী রূপে পূজিতা। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী কোথাও তিনি মুরগির রূপ ধারণ করেন, কোথাও বাঘের। বনবিবি অন্য কোনও দেব-দেবীর মতো উগ্র বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। বরং সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা দেবী। বনের সমস্ত সৃষ্টিতে রয়েছে তাঁর মমতা। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তেমনই ভালোবাসেন প্রকৃতিকে। বনবিবির মাহাত্ম্যের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে আছে সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষিজীবী, ক্ষেতমজুর, বাওয়ালি, মৌওয়ালি, কাঠুরে, জেলে, আদিবাসী মুণ্ডা, শিকারি গরিব মানুষরা। প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বনবিবির প্রধান পুজো হয়।

ওলাবিবি

ওলা দেবীকে বিবি মা বলেও ডাকা হয়। বিবি মা- এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে ভক্তি, ভালোবাসা ও নির্ভরতা। জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোনও রূপভেদ এখানে নেই। লোকধর্মে বিবি মা খুব সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর ভাবে স্থান পেয়েছেন। বিবি মা নামটি আবেগ প্রসূত এবং মাতৃত্ববোধক। বিবি মাদের মধ্যে ওলাবিবি সর্বজ্যেষ্ঠ। সাত বিবিদের মধ্যে তিনি অধিক সমাদৃত। ওলাওঠা রোগের বিবি হিসেবে তিনি সর্বজন পরিচিত। অন্য ছয়জন বোনদের নাম হল ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি। মতান্তরে আর একজন আছেন, তার নাম মড়িবিবি। মাটির স্তূপের প্রতীকে এবং মাটির প্রতিমা মূর্তিতে সর্বত্র এরা পূজিত হন। বালি-সিমেন্টে জমিয়েও এদের স্তূপ বানানো হয় কোথাও কোথাও। তবে ছোট-বড় মাঝারি মাটির মূর্তিতে পুজো দেওয়া হয় প্রায় সৰ্বত্ৰ। নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- ম্যানগ্রোভ বাঁচাতে সুন্দরবনে টহল মহিলা বাহিনীর, নয়া উদ্যোগে আশা দেখছেন স্থানীয়রা

বাঘ দেবতা দক্ষিণ রায়

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। সুন্দরবনের মানুষদের কাছে এই প্রবাদ জীবন দিয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতার সামিল। জীবিকার দায়ে যাদের গভীর অরণ্যে যেতে হয় তাদের মনে বাঘের তীক্ষ্ণ দাঁতের ভয় হওয়াই স্বাভাবিক। সেই ভয় থেকে মুক্তি পেতেই বাঘ-দেবতা দক্ষিণ রায়ের আবির্ভাব। আবার জনশ্রুতি অনুযায়ী, সুন্দরবনে দক্ষিণ রায় নামে রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন যিনি পরে লোকদেবতায় পরিণত হন।

দক্ষিণ রায়ের শীর্ণ শরীর, হরিদ্রাভ গায়ের রং, উজ্জ্বল গায়ের ত্বক, সারা গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ, বিরাট পাকানো গোঁফ, মুখের দু’দিক থেকে ঝরছে লালা, আর লম্বা একটি লেজ। সর্বদা তীর-ধনুক, ঢাল-তলোয়ার-বল্লম নিয়ে যুদ্ধসাজে সজ্জিত তিনি। তবে লেজটি আসলে পোশাকের লেজ, তাঁর শরীরের লেজ নয়। পোড়া শোল মাছ, রান্না করা খাসির মাংস, মদ, গাঁজা, সিদ্ধি, তাড়ি দক্ষিণরায়ের নৈবেদ্য। দক্ষিণ রায়ের বাহন কোথাও বাঘ, কোথাও ঘোড়া। বারুইপুর থানার অন্তর্গত ধপধপি গ্রামে দক্ষিণ রায়ের মূর্তিটি এক সুপুরুষ রাজযোদ্ধার মতো, তাঁর হাতে বন্দুক, কোমরে তরবারি। মূর্তির পিছনে দেখা যায় তির-ধনুক, কুঠার, ঢাল ইত্যাদি অস্ত্র। সাদা ওড়না কাঁধে, সাদা ধুতি আর পায়ে নাগরা জুতো পরে দক্ষিণ রায় পূজিত হন। তবে মূলত দুই রকমের মূর্তি দেখা যায় দক্ষিণ রায়ের – একটিকে বলে দিব্যমূর্তি আর অন্যটি হল বারামূর্তি। বারামূর্তিতে একটি তিন কোণা মুকুট দেখা যায় দক্ষিণ রায়ের মাথায় আর চোখের টানা ভ্রু, টানা গোঁফ আর দু’ পাটি লম্বা লম্বা দাঁত মুখ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর পূজা মূলত মাঘ মাসে হয়ে থাকে। দিনের বেলায় পুজোর সময় লম্বা বাঁশের মাথায় আগুন জ্বেলে চারদিকে ঘোরানো হয়। লোকের বিশ্বাস যে সেই আগুন যতদূর পর্যন্ত দেখা যাবে ততদূর পর্যন্ত হিংস্র প্রাণী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব কেউই প্রবেশ করতে পারে না।

কালু রায়

কুমির দেবতা কালু রায়। সুন্দরবনের মূর্তিমান যমদূত কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশ্বাসে জলজীবী মানুষেরা কুমির দেবতা কালু রায়ের পুজো করেন। দক্ষিণ রায়ের মতো এর মূর্তি একেবারে মানবীয়। পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পিঠে তির ধনুক। নৈবেদ্য রূপে ফলমূল, কলা, আতপ চাল দেওয়া হয়।

পাঁচু ঠাকুর

পাঁচু ঠাকুর শিশুসন্তান রক্ষক দেবতা। তিনি গর্ভস্থ শিশুকে রক্ষা করেন। শিশুদের ধনুষ্টংকার রোগ থেকে রক্ষা করেন। তাই প্রসূতি ও মায়েদের কাছে তিনি পরম আরাধ্য দেবতা। পাঁচু ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ছাগ বলিরও রেওয়াজ আছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, পাঁচু ঠাকুর মহাদেবের আরেক রূপ। কোথাও মাটির মূর্তিতে, কোথাও শিলা বা ঘটের প্রতীকে, কোথাও আবার শিলা রূপে হাতি ও ঘোড়া মূর্তিতে তিনি পূজিত হন। পাঁচু ঠাকুরের গায়ের রঙ লাল, তাঁর চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী। বড় গোলাকার রক্তাভ তিনটি চোখে রাগ। মূর্তিতে ঠাকুরের প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক বর্তমান, দাড়ি নেই, গোঁফ রয়েছে যা কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং জটা বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতরা ফুল গুঁজে রাখা। মূর্তির উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে থাকে বাঘছাল, আবার কোনও কোনও জায়গায় নিম্নাঙ্গে কাপড় পরানো থাকে।

গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু, পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। পাঁচু ঠাকুরের আবার পরিষদ রয়েছে, তাঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জ্বরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামের দু’জন অপদেবতা। এঁর সঙ্গেই থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি।

জ্বরনাশক জ্বরাসুর

জ্বররোগ নাশক রূপে পূজিত বিচিত্র দেবতা জ্বরাসুর। এই দেবতার দেহাবয়ব বিচিত্র ধরনের। গায়ের রঙ ঘন নীল। তিনটি মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত ও তিনটি পা নিয়ে জ্বরাসুর অসংখ্য থানে শীতলা, মনসা, দক্ষিণ রায়, আটেশ্বর, প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে পুজো পান। এর মূর্তি পুজোর প্রচলন খুব বেশি।

আরও পড়ুন- আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা

মানিক পীর

মানিক পীরকে গোরক্ষক দেবতারূপে গৃহস্থ চাষি পরিবারে পুজো করা হয়। এর ব্যক্তি পরিচয় অন্যান্য পীর-গাজি-বিবিদের মতোই রহস্যাবৃত। মেঘ বরণ এই পীরের গঠন অতি সুন্দর, মাথায় বাবরি চুল, তার উপর তাজ পাগড়ি। কোনও কোনও দরগাতে তাঁর পোশাক হিন্দু দেবতার অনুরূপ। কোথাও আবার কালো রঙের আলখাল্লা ও টুপি দেখা যায়। ভক্তজনের বিশ্বাস, ইনি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও চিকিৎসক ও সাধক। গৃহপালিত পশুপক্ষীর রোগ নিরাময়কারী ছিলেন বলে এক সময় শ্রদ্ধাভক্তির প্রাবল্যে লৌকিক দেবতায় উন্নীত হয়েছেন। মানিকপীর লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে একই থানে বা দেবালয়ে পুজো পান।

মাছের দেবতা মাকাল ঠাকুর

সুন্দরবনের জেলে সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা হলেন মাকাল ঠাকুর। তাঁর মূর্তি মানবাকৃতি নয়, বরং ছোট একটি বা একসঙ্গে দু’টি স্তূপের মতো। এই স্তূপটি মাটির তৈরি ওল্টানো গ্লাস বা কতকটা টোপরের মতো দেখতে। মাকাল ঠাকুরের পুজোর কোনও নির্দিষ্ট স্থান নেই। সুন্দরবনের জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে নদী বা খালের পাড়ে পুজো করে থাকে। পুজোর জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করে তাতে মূর্তি বসানো হয়। বেদির চারপাশে তিরকাঠি পুঁতে বেড়া দেওয়া হয়। সিঁদুর মাখানো ফুল, বেল পাতা ও তুলসীপাতার সঙ্গে নৈবেদ্য হিসেবে আতপচাল, পাকা কলা, বাতাসা ইত্যাদি দিয়ে মাকাল ঠাকুরের পুজো হয়। ভক্তদের বিশ্বাস পুজোয় ঠাকুর সন্তুষ্ট হলে প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, এইসব লোকদেবতাই সুন্দরবনের মানুষের চিরায়ত বিশ্বাস। যে বিশ্বাস আর ভক্তি তাদের সুন্দরবনের অসহনীয় পরিবেশে টিকে থাকতে, লড়াই করতে শক্তি দেয়।

 

More Articles