দেবতার যৌনতাকে বস্ত্রে ঢেকেছে মানুষ, শ্লীল অশ্লীলের বেড়া ভেঙেছেন রহস্যময়ী লজ্জা গৌরী
Lajja Gauri: ইতিহাস বলছে, বেশ কয়েক বছর আগে সিঙ্গারায়াকোন্ডার কাছে একটি প্রস্তরখণ্ড পাওয়া যায়। সেখানে একটি নারী মূর্তিকে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকতে দেখা যায়, তিনিই দেবী লজ্জা গৌরী।
‘লজ্জা’, ‘নারী’, ‘ধর্ম’ লতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে শব্দেরা। যদিও খুব সদর্থক নয় সেই সহাবস্থান। দ্বিচারিতা, বিচ্যুতি, কলঙ্ক নানা ছলে সমাজে ও চেতনায় এই তিন শব্দের জটিল অঙ্ক কষে চলছে সময়। ধর্মে, বিশেষত হিন্দুধর্মে নানা রূপে নারী মূর্তির পুজো করা হয়। কখনও ধ্বংসের দেবতা হিসেবে, কখনও জগতের আধার হিসেবে, আবার কখনও ধন, সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে। সমাজের নারীর থেকে ধর্মের নারী ঠিক আলাদা কোথায়? আদৌ কি পৃথক? আদৌ কি ধর্মে উল্লিখিত নারীমূর্তির স্বাভিমান, বীরত্ব, তেজ, এবং কাম মানবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? দেবীমূর্তিদেরও কি মানুষ নিজের মতো করে গড়েনি, উলঙ্গ কালীকে শাড়িতে ঢেকে কি ‘লজ্জা’কেই মান্যতা দেয়নি? এখনও দেবী মূর্তিতে যৌনাঙ্গের প্রকৃষ্ট কোনও উল্লেখ থাকে না। নারী শরীরের যৌনাঙ্গকে বাদ দিয়েই তৈরি হয় দেবীর মূর্তি।
যৌনতা নিয়ে সমাজের ছুঁৎমার্গ চিরকালই কম বেশি ছিল। যদিও ধর্মীয় কাহিনি বা ভাস্কর্য বলে অন্য কথা। যৌনতা নিয়ে যে কৌতূহল তা একটা সময় অবধি রুপোলি পর্দার কল্যাণে এসে দাঁড়িয়েছিল ঠোঁটে ফুল ফুল ছাপ, কানে ফিসফিস, দু’টো সূর্যমুখী ফুলের ঠোকাঠুকিতে! এখন একাংশের ‘খুল্লামখুল্লা’ যাপন অন্যের কাছে আড়চোখের নিন্দা। মোদ্দা কথা, যৌনতা, কাম এবং বিশেষত নারীর এহেন ‘লজ্জাশরম’ বিসর্জন দিয়ে যৌন প্রদর্শন তথা যৌনতা নিয়ে কথা বলা এখনও ততটা সহজ সরল হয়নি। এই লজ্জা-শরম-হায়ার গালে সপাটে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন লজ্জা গৌরী। যৌনতার এক অনন্য নিদর্শন নিয়ে দেবীর রূপ সকলকে হতবাক করে।
প্রাচীন ভারতে এমন দু’টি দেবী মূর্তি রয়েছে যা সামাজিক ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। প্রাচীন ভারত নারীর যৌনতাকে যথাযোগ্য সম্মান করত। নিছক নারী শরীর হিসেবে না দেখে সার্বিকভাবেই তাঁর রূপ ধরা পড়ত, তারই প্রমাণ অসমের দেবী কামাখ্যা এবং দক্ষিণ ভারতের লজ্জা গৌরী। হিন্দু সভ্যতার ভিত্তি হয়েছিল নদীর ধারে। হিন্দু ধর্মে নদী মা রূপেই পূজিত। এমনকি আর্য সভ্যতায় পরিবারের প্রধান হিসেবে মেয়েরাই উঠে এসেছিলেন। পার্বতীর কথাই ধরা যাক। বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন রূপে পূজিত হন তিনি। ইতিহাস বলছে, বেশ কয়েক বছর আগে সিঙ্গারায়াকোন্ডার কাছে একটি প্রস্তরখণ্ড পাওয়া যায়। সেখানে একটি নারী মূর্তিকে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকতে দেখা যায়, তিনিই দেবী লজ্জা গৌরী।
আরও পড়ুন- ভারতের এই গ্রামে বিচার হয় স্বয়ং দেবতাদের! কড়া শাস্তি পান দেবদেবীরা
১৯ শতকের প্রথম দিকে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনকোটা, কর্ণাটকের সিদ্দানকোট্টে এবং মহারাষ্ট্রের ভোকারদান এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের দ্বারা এই দেবী মূর্তি উদ্ধার করা হয়। দেবী এমনভাবে বসে আছেন যাতে তাঁর যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত এবং স্তনযুগল সকলের সামনে উন্মোচিত। মূর্তির মাথা নেই সেই স্থানে পদ্মফুল বসানো রয়েছে। এই দেবী মূর্তিরই পুজো করা হয়। এই দেবী পার্বতীরই আরেক রূপ। কিন্তু কেন এই ভাবে বসে রয়েছেন পার্বতী?
পুরাণ মতে, পার্বতীর সঙ্গে একটু মজা করতে একদিন মহাদেব তাঁর একটি কম্বল তাঁকে দিয়ে বলেন, এটি তাঁর অত্যন্ত প্রিয়, একে সাবধানে রাখতে। কিন্তু কিছু পরে নিজেই ইঁদুরের রূপ ধরে এসে কম্বলটি কেটে দেন। কম্বলের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান পার্বতী। মহাদেব খুব রাগারাগি করবেন বলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেই সময় একজন দর্জি পার্বতীয় দরজায় এসে দাঁড়ান। তাঁকে তখনই কম্বলটি সেলাই করে দিতে বলেন পার্বতী। কিন্তু দর্জির রূপ ধরে আসা মহাদেব তাঁকে জানান, তিনি কম্বল সেলাই করে দিতে পারেন কিন্তু তার বদলে পার্বতীকে তাঁর সঙ্গে মিলনে রত হতে হবে।
এই প্রস্তাবে প্রথমে অত্যন্ত রেগে যান পার্বতী। পরে তাঁর মনে হয় মহাদেবের প্রচণ্ড রাগ সহ্য করার থেকে ওই দর্জির সঙ্গে মিলিত হওয়াই ভাল। দর্জির প্রস্তাব মেনে নিয়ে দু’জনে যখন রতিক্রিয়ায় মগ্ন, তখনই নিজের আসল রূপে ফিরে আসেন মহাদেব। মহাদেবকে সামনে দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যায় পার্বতীর, আর সেখানে জন্ম নেয় একটি পদ্মফুল।
বাদামী চালুক্য যুগে লজ্জা গৌরীর পুজো অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এই সময়ে দেখা যাচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলি তান্ত্রিক অনুশীলনের সঙ্গে মিশে গেছে। আইহল, মহাকুটা, নাগানাথকোল্লা, হুলিগেমনাকোল্লা এবং সিদ্ধানকোল্লা— সব জায়গাতেই লজ্জা গৌরীর অবদান লক্ষণীয়। সিদ্ধানকোল্লা এবং হুলিগেমনাকোল্লার মতো জায়গায়, দেবী চিত্রগুলি আজও পাথরের উপরে এবং নীচে খোদাই করা আছে। স্থানীয় বিশ্বাস এবং পুরাণগুলি যোনি পুজোর তান্ত্রিক অনুশীলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
আরও পড়ুন- উপাস্য দেবতা ‘কালী’, সাহেবদের চোখে চোর হয়েও যেভাবে বাঁচে জিপসিরা
আবার, অন্য একটি মতে, লজ্জা গৌরী নারীর প্রজনন ক্ষমতার রূপ। পা ফাঁক করে বসে সন্তান জন্মের মুহূর্তই ধরা পড়েছে তাঁর ভঙ্গিতে। প্রাচীনকালে মানুষ যুদ্ধ, খরা, মহামারীকে ভয় পেত। তাই প্রজনন ক্ষমতার রূপে নারী পূজিত হতেন সেখানে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ‘মহান মা’ দেবী লজ্জা গৌরী, অদিতি, আদ্যা শক্তি, ঋষি জমদগ্নির পত্নী রেণুকা নামেও পরিচিত, এছাড়া মাতঙ্গী, ইয়ালাম্মা (সকলের মাতা), কোটারী, কোটাভী (একজন নগ্ন কুলদেবী), কোট্টামহিকা, কোটমাই এবং অন্যান্য নামেও উর্বরতার (প্রজনন) দেবী রূপে উপাসনা করা হয়। এটিই হিন্দুধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন দেবী রূপ।
তবু, পুরাণ যতই বলুক, যৌনতার গায়ে ট্যাবু বসিয়েছে মানুষ। নারী শরীরকে ‘লজ্জার’ ভূষণে ঢেকে স্বাভাবিকত্বকে খর্ব করা হয়েছে। শ্লীল অশ্লীলের গণ্ডিতে তাঁকে আবদ্ধ করা হয়েছে। এখন, আধুনিকতার দাবি করেও যৌন মন্দির এবং মূর্তি নিয়ে আমাদের লজ্জা প্রকাশ এবং তাকে অশ্লীল বলে দেগে দেওয়া নেহাত বোকামির পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।