ফুল ফোটে ১২ বছরে মাত্র একবার, কেবল এদেশেই! রহস্যময়ী নীলকুরিঞ্জিকে দেখতে কেন ছুটে আসেন মানুষ
Neelakurinji: যার এমন রাজকীয় সৌন্দর্য সে নাকি বেঁচে থাকে অনাদরে অবহেলায়। প্রধানত নীলগিরির পাহাড়ি অঞ্চলের ফুল বলে এর নাম নীলকুরিঞ্জি। দেখতেও নীলচে বেগুনি।
কতই না রঙ্গ দেখি এই দুনিয়ায়। আসলে বলতে চাইছি প্রকৃতির রঙ্গের কথা। সারা ভারতে কতই যে অপূর্ব ও নৈসর্গিক শোভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তা বিশ্বের আর কোথাও খুঁজলে পাওয়া যাবে না। বিরল ঘটনার নজির রয়েছে এই ভূভারতেও। এক যুগ অন্তর এমন প্রাকৃতিক শোভা দেখার ভাগ্য হয় কেরলবাসীদের। মুন্নারের এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যান নীল-সাদা আর নীল-বেগুনি নীলকুরিঞ্জি ফুলে ভরে ওঠে। কেরলের ইডুক্কি জেলার শালোম পাহাড়ে একধরনের বিরল প্রজাতির ফুল ফোটে, যার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ১২ বছর।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এই অঞ্চলটিকে নীলকুরিঞ্জি ফুলের রাজ্যও বলা হয়। গোটা পর্বতের সারি ঢাকা পড়ে যায় এক আশ্চর্য নীল গালিচায়। ঈশ্বরের আপন দেশে বেগুনি-নীল রঙের ছটা দেখে মনে হয় যেন কোনও শিল্পী তাঁর তুলির টানে এক সুন্দর ক্যানভাস ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ফুল প্রকৃতির এক বিস্ময়। সারা বছর তো নয়ই, এমনকী প্রতি বছরে কোনও বিশেষ সময়েও এই ফুল ফোটে না। এখানকার আদিবাসীদের মতে, এই ফুল শুভ সংবাদ বহন করার প্রতীক। এর বিজ্ঞানসম্মত নামটিও বেশ চমকপ্রদ, স্ট্রোবিল্যান্থেস কুনথিয়ানা। প্রতি ১২ বছরে মাত্র একবার ফোটে এই ফুল।
ফুলের বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষত্ব
জনপ্রিয় এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, কেউ হঠাৎ করে যদি ফুলটিকে দেখেন তাও এর তেমন কোনও বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। অন্য সব ফুলের মতোই জংলি ফুল ফুটে আছে বলে মনে হবে। অনেকটা ঘণ্টার মতো দেখতে এই ফুল। থোকায় থোকায় দলবদ্ধ ভাবে ফুটে থাকে। বলা ভালো, আলাদাভাবে এই ফুল আপনাকে খুব একটা বেশি আকর্ষণ করবে না। কিন্তু যখন মাইলের পর মাইল এই ফুলে ছেয়ে যায় তখন মনে হবে কেউ যেন নীল-বেগুনি রঙের গালিচা পেতে রেখেছে। প্রায় আগাছার মতোই এদের বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু। তারপর আবার একসময় নতুন করে পাতা জন্ম নেয়, প্রকৃতির খেয়ালে নিজের মতোই বেড়ে ওঠে। কিন্তু যেই ফুল ফোটার সময় আসে অমনি পাল্টে যায় বনের চেহারা। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রঙ বদলায় এই ফুল। ফুলের রঙের এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো।
আরও পড়ুন-বছরে একবার নিশুতি রাতে জন্ম নেয় ব্রহ্মকমল! হিমালয়ের ফুল ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য
কুঁড়ি থেকে ধীরে ধীরে এই ফুল যখন ফুটতে থাকে তখন নীলচে বেগুনি এবং সবশেষে ফিকে বেগুনি রঙ ধারণ করে। ফুলের এমন রূপ দেখার জন্য দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকের দল ছুটে আসে। যার এমন রাজকীয় সৌন্দর্য সে নাকি বেঁচে থাকে অনাদরে অবহেলায়। প্রধানত নীলগিরির পাহাড়ি অঞ্চলের ফুল বলে এর নাম নীলকুরিঞ্জি। দেখতেও নীলচে বেগুনি। নীলকুরিঞ্জি ফুল সাধারণত ১৩০০-২৪০০ মিটার উঁচুতে ফোটে। গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী এই গাছের উচ্চতা সাধারণত ৩০-৬০ সেন্টিমিটার। সর্বোচ্চ ১৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্তও এই গাছকে বড় হতে দেখা গেছে।
নীলকুরিঞ্জি ফুল প্রায় ২৫০ প্রজাতির হয়ে থাকে। এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ৪৬ টির মতো প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। নীলকুরিঞ্জি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ যা তামিলনাডু, কর্নাটক, কেরলেও দেখতে পাওয়া যায়। নীলকুরিঞ্জি ফুল ফুটলে নীলগিরির বিস্তীর্ণ এলাকায় মৌমাছির আধিক্য বহু গুণ বেড়ে যায়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, নীলকুরিঞ্জির মিষ্টি গন্ধ এবং ফুলে মধুর আধিক্যই এর অন্যতম কারণ। প্রতি ১২ বছর পরপর জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে এই ফুল ফোটে। ২০০৬ সালে এমনই নীল রঙের নীলকুরিঞ্জি ফুলে ঢেকে গিয়েছিল নীলগিরি। এরপর ২০১৮ সালে নীলগিরির বিস্তীর্ণ এলাকা আরও একবার ঢেকে যায় নীলকুরিঞ্জি ফুলে। সেবার শুধু নীলগিরিতে নয়, কর্ণাটকের মণ্ডলপট্টি পাহাড়েও নীল চাদর বিছিয়ে রেখেছিল নীলকুরিঞ্জি ফুল।
ফুল ফোটার প্রকৃত সময়
বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এই নীলকুরিঞ্জি ফুল প্রতি ১২ বছরে একবার করে ফোটে। কিন্তু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। কিছু কিছু ফুল ফুটতে ১৬ বছর সময়ও লেগে যায়। ১২ বছর পর ফুটলেও ওই বছরের যে কোনও সময় এই ফুলের দেখা পাওয়া যায়। এই ফুল ফোটার পিক সিজন হল অগাস্ট থেকে অক্টোবর। সেই সময় গাড়োয়ালের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সকেও হার মানায় নীলগিরির নীলকুরিঞ্জি ফুলের সৌন্দর্য।
নীলকুরিঞ্জি ফুলের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনও রয়েছে। দ্য হিন্দুর প্রাক্তন এডিটর তাঁর বইতে এই ফুলের বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। সেই বই অনুযায়ী, কেরলের একটি জনজাতি এই ফুলকে রোমান্স এবং ভালোবাসার প্রতীক মানত একটা সময়। শুধু তাই নয়, ভগবান মুরুগান এই ফুলের মালা পরেই নাকি বিয়ে করেছিলেন। এমনই আরও এক জনজাতি রয়েছে যারা এই ফুলকে সামনে রেখে বয়সের হিসাব রাখেন।
আরও পড়ুন- ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই
পর্যটন শিল্প
নীলগিরি ও তার আশেপাশের অঞ্চল বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। নীলগিরির প্রায় ৩২ বর্গকিমি এলাকা প্রতি ১২ বছরে একবার এই নীল রঙের ফুলে রঙিন হয়ে যায়। আর এই ফুলের টানেই দেশ বিদেশের বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে এই এলাকায়। ফুল, প্রকৃতি এবং রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে তামিলনাড়ু ও কেরলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন সেজে ওঠে নীলের চাদরে তখন প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে আসতে পারেন যে কেউ।
এই ফুল নিজের আনন্দেই রঙ ছড়িয়ে ফুটে ওঠে। প্রকৃতির লীলাখেলায় তা খুশি ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। তারপর আবার একদিন হারিয়ে যায়। ফের গাছে ফুল ধরে। রঙে, গন্ধে আবার ভরে ওঠে চারপাশ। অধিকাংশ ফুলের ফোটার সময় স্থির করা থাকে। প্রতি বছর সেই সময় তা গাছের ডালে ভরে ওঠে। কিন্তু এই প্রজাতির কিছু ফুল হয় যা ১ বছর, ২ বছর বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে ফোটার কারণে এই ফুল দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। একটি জীবনে সেই ফুলের দিকে চাইবার, তার অপরূপ রূপে মোহিত হওয়ার সুযোগ হাতে গুণে পাওয়া যায়। অবাক করার বিষয়, নীলকুরিঞ্জি ফুল একমাত্র ভারতের মাটিতেই ফোটে। বিশ্বের আর কোথাও এই ফুল পাওয়া যায় না।