সারি সারি কফিন ঝোলানো এই পাহাড়ে! ঝুলন্ত কবরের যে ইতিহাস স্তম্ভিত করবে
Hanging Coffins: মৃতদেহটিকে ছোট করে ঢোকাতে হাড়গুলি ফাটানো হয়, পরে লতাপাতা দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরিবারের কেউ প্রয়াত হলে কবর দেওয়াই রীতি এই দেশে, তবে মাটির নীচে নয়। সারা বিশ্ব জুড়ে মৃত্যুর পর দেহ সৎকারের বিবিধ ও বিচিত্র সব প্রথা রয়েছে, কিছু প্রথা ঘুচে গিয়েছে কিছু প্রথা এখনও পালিত হয়। মাটি খুঁড়ে দেহকে কবর দেওয়া সাধারণ এক রীতি। কিন্তু কফিনে দেহ রেখে তা ঝুলিয়ে রাখা? এমন অদ্ভুত প্রথা আজও দেখা যাবে উত্তর ফিলিপাইনসে গেলে। সেখানকার মাউন্টেন প্রদেশের ইগোরোট উপজাতির সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের মৃতদের মাটির উপরে উঁচু পাহাড়ের পাশে পেরেক গেঁথে ঝুলন্ত কফিনে কবর দেওয়ার প্রথা পালন করে আসছে। দীর্ঘদিন মানে প্রায় হাজার দুয়েক বছর ধরে তো বটেই, স্প্যানিশদের আগমনের বহু আগে থেকেই! আজও এই পুরোনো ঐতিহ্যটি পালিত হয়ে আসছে, যদিও আগের তুলনায় তা এখন অনেক ছোট পরিসরে। কেন এমন বিচিত্র প্রথা?
এই প্রথার নেপথ্যের সবচেয়ে সাধারণ বিশ্বাসগুলির মধ্যে একটি হলো, মৃতদেহগুলিকে যতটা উপরে ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া যায় তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের আত্মার ততই কাছাকাছি চলে আসে। তবে প্রাচীন স্থানীয়দের মতে, এ ছাড়াও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আগে বৃদ্ধ মানুষরা নিজেদের মৃত্যুর পর কবরের মধ্যে তাঁদের কী হবে এই নিয়ে ভয় পেতেন। মৃত্যুর পর তাঁদের দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে এই নিয়ে আতঙ্ক ছিল সকলের। যখন এই বয়স্করা মারা যেতেন, তার আগে তাঁরা কিছুতেই চাইতেন না যে তাঁদের কবর দেওয়া হোক কারণ তাঁরা জানতেন জল মাটিতে প্রবেশ করবে এবং তাঁদের দেহ দ্রুত পচে যাবে। তাঁরা এমন একটি জায়গা চেয়েছিলেন যেখানে তাদের মৃতদেহ নিরাপদ থাকবে।
আরও পড়ুন- সর্বাঙ্গ ঢাকা বর্ম পরিয়ে দেওয়া হতো কবর! চিনের মৃতদের এই রহস্য তাক লাগাবে…
সেই ভয়কে সম্মান দিতে, কফিনগুলো হয় বেঁধে রাখা হয় বা পাহাড়ের পাশে পেরেক দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ কফিনই প্রায় এক মিটার দৈর্ঘ্যের। এত ছোট কেন? কীভাবে তাতে এঁটে যায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহ? মৃতদেহগুলিকে আসলে ভ্রূণ যেমন পেটের মধ্যে থাকে, ঠিক সেই অবস্থানেই রাখা হয়। ইগোরোটরা বিশ্বাস করেন, একজন ব্যক্তির সেইভাবে চলে যাওয়া উচিত যেভাবে সে পৃথিবীতে এসেছিল।
যখন কেউ মারা যান, ঐতিহ্যগতভাবে শুয়োর এবং মুরগির মাংস রান্না করা হয় ওই সম্প্রদায়ের উদযাপনের জন্য। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য, ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনটি শুয়োর এবং দু'টি মুরগি জবাই হওয়া উচিত। কিন্তু যাদের এত সামর্থ্য নেই তারা দু'টি মুরগি এবং একটি শুয়োরেই কাজ সেরে ফেলেন। কিন্তু এই জবাই হওয়া প্রাণীর সংখ্যা সবসময়ই হতে হবে তিন বা পাঁচ।
মৃতদেহটিকে একটি কাঠের চেয়ারে বসানো হয় এবং সেটিকে বেত ও লতা দিয়ে বেঁধে তারপর একটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যাতে মৃতের উদ্দেশ্যে আত্মীয়রা শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, তাই সেই চেয়ারটিকে বাড়ির প্রধান দরজার মুখোমুখি রাখা হয়। মৃতদেহের দ্রুত পচন রোধ করতে এবং এর পচা গন্ধ আটকাতে ধোঁয়া তৈরি করা হয়। মৃতদেহটি বেশ কয়েক দিন ধরে রাখা হয়, তারপরে মৃতদেহটিকে চেয়ার থেকে সরিয়ে কফিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাখা হয় ঠিক ওই ভ্রূণের অবস্থানেই। পা গুলো মুড়ে চিবুকের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তারপরে এটি আবার একটি কম্বলে মুড়িয়ে বেতের পাতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। অন্যরা কফিন ঝোলাতে পাহাড়ের পাশে গর্ত করেন।
আরও পড়ুন-মৃত্যুর পরেও মেলেনি কবর! কীভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা?
পাহাড়ে কবর ঝোলাতে যাওয়ার পথে শবযাত্রার শরিক হন অনেকেই। স্থানীয়দের বিশ্বাস, "মৃতের রক্তে রঞ্জিত হওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।" মৃতদেহ থেকে বেরনো তরল জীবনে সাফল্য নিয়ে আসে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় মৃতের সংস্পর্শে এলে মৃত ব্যক্তির দক্ষতাগুলিও নাকি অন্যের দেহে চলে আসে।
শবযাত্রাটি সমাধিস্থলে পৌঁছালে, যুবকরা পাহাড়ের পাশ দিয়ে উঠে যান এবং মৃতদেহটিকে একটি ফাঁপা কাঠের কফিনের ভিতরে রাখেন। মৃতদেহটিকে ছোট করে ঢোকাতে হাড়গুলি ফাটানো হয়, পরে লতাপাতা দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এখন অবশ্য নতুন কফিনগুলির পরিমাপ প্রায় দুই মিটার। কফিনগুলির দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে কারণ মৃতের আত্মীয়রা তাদের প্রিয়জনের হাড় ভাঙতে ভয় পান। খুব কম মানুষই এখন সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করেন। নয়া প্রজন্ম আধুনিক জীবন পদ্ধতিতেই অভ্যস্ত এবং দেশে খ্রিস্টান বিশ্বাস ও আচার এখন বেশি জনপ্রিয়। এখন প্রতি উপলক্ষ্যে কবরস্থানে যাওয়া, মৃত আত্মীয়দের স্মরণ করার ধারণাটি প্রসার পেয়েছে। ঝুলন্ত কফিনে তো এসব সম্ভব নয়! এই ঐতিহ্য তাই ধীরে ধীরে শেষ হয়েই যাচ্ছে।