'আমাকে বাঁচাও'! আজও রাতের আঁধারে আর্তনাদ ভেসে বেড়ায় এই রহস্যময় প্রাসাদে
Shaniwar Wada Mystery: মানুষের ভিড়ের মধ্যে বীরত্ব, ভালবাসা, ষড়যন্ত্র, খুন, রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শনিওয়ার ওয়ারা।
আঠারো বছরের পেশোয়া নারায়ণ রাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। গর্দিরা তাঁকে আটক করতে নয়, বরং হত্যা করতে এসেছে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, 'কাকা মালা বাচভা।' মারাঠিতে এই কথার মানে হলো, কাকা আমাকে বাঁচাও। নারায়ণ রাওয়ের এই করুণ চিৎকার তাঁর কাকার কানে পৌঁছয়নি। যখন তাঁর কাকা এই ঘটনার কথা জানতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। গর্দিরা নারায়ণ রাওকে হত্যা করার পরে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে জলে ফেলে দিয়েছিল। মারাঠাদের সেই গর্বের প্রাসাদে বর্তমানে কেউ থাকে না। তবু আজও নাকি পূর্ণিমার রাতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে কেউ কেউ শুনতে পায় সেই আর্তনাদ। বহু মানুষের মতে, আজও পুণের শনিওয়ার ওয়ারা-র অলিন্দে নারায়ণ রাওয়ের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়।
'শনিওয়ার ওয়ারা'-র নামের মধ্যে 'ওয়ারা' শব্দের অর্থ হলো বাড়ি। ১৭৩০ সালে শনিওয়ার ওয়ারা-র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন পেশোয়া বাজিরাও বল্লাল। মারাঠা সাম্রাজ্যের কথা উঠলেই সাহু ছত্রপতি শিবাজি ভোঁসলের পরে যাঁদের নাম আসে, তাঁদের মধ্যে মারাঠাদের সপ্তম পেশোয়া বাজিরাও বল্লাল অন্যতম।
এই প্রাসাদ এবং তার আশেপাশের পাঁচিল প্রথমে পাথর দিয়ে তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনার কথা চাউর হতে বহু মারাঠার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁদের মতে, সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি কেল্লায় একমাত্র রাজা বসবাস করতে পারেন। বাজিরাও পেশোয়া ছিলেন। তাই সকলের মতামতকে মান্যতা জানিয়ে তিনি কেল্লার নির্মাণে পাথরের সঙ্গে কাঠ এবং বাঁশের ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই কেল্লার প্রধান দরজার নাম ছিল দিল্লি দরওয়াজা। এছাড়া বাকি দরজাগুলির নাম ছিল গণেশ, জম্ভাল, খিড়কি এবং মস্তানি। বাজিরাও বল্লাল তাঁর প্রিয় কেল্লার একটি দরজার নাম নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীয়ের নামে নামকরণ করে সম্ভবত নিজের ভালবাসার প্রমাণ দিয়েছিলেন। আত্মীয়-পরিজনদের বাধা সত্ত্বেও বিয়ে করা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে তিনি বেশ কিছুদিন এই কেল্লায় থাকতে দিতে পেরেছিলেন।
জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা 'বাজিরাও মস্তানি'-তে বাজিরাও বল্লালের জীবন এবং মস্তানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছাড়াও শনিওয়ার ওয়ারা দেখানো হয়েছে। যদিও সিনেমার স্বার্থে কিছুটা কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে এবং সেই একই কারণে ইতিহাসের কিছু তথ্য হয়তো অজান্তে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১৯ সালের বলিউড সিনেমা 'পানিপথ'-এও শনিওয়ার ওয়ারা-র ভেতরের জীবন দেখানো হয়েছিল। ১৭৫৮ সাল নাগাদ এই কেল্লায় প্রায় হাজার জন মানুষ বসবাস করত।
আরও পড়ুন: কালো জলের কুয়োর নিশির ডাক! দিল্লির এই প্রাচীন স্থাপত্য ঘিরে আজও দানা বাঁধে রহস্য
১৭৭২ সালে আঠারো বছরের নারায়ণ রাও পেশোয়া পদ এবং এই কেল্লা-র মালিকানা লাভ করেন। তিনি পেশোয়া নিযুক্ত হওয়ার সংবাদে কিছু মানুষ খুশি ছিল না। তাঁরা সকলেই নারায়ণ রাওয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের সময়ে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মিরজাফর কুখ্যাত হয়েছিলেন। মিরজাফর ছাড়া সিরাজ-উদ-দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে অন্যতম নাম ছিল ঘসেটি বেগম। মিরজাফরের সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক থাকলেও ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সিরাজের আত্মীয়ের সম্পর্ক ছিল। নারায়ণ রাওয়ের জীবনের সেই ঘসেটি বেগম হলো তাঁর কাকা রঘুনাথরাও এবং কাকিমা আনন্দীবাঈ। মৃত্যুর আগে যে কাকাকে সাহায্যের জন্য দেখেছিলেন, সেই রঘুনাথরাও নিজেই নারায়ণ রাওয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। যদিও রঘুনাথরাও-এর পরিকল্পনা ছিল নারায়ণ রাওকে আটক করে গৃহবন্দি করে রাখা। ষড়যন্ত্র চলাকালীন তিনি নিজেই একটা ঘরে বন্দি ছিলেন। তাই তাঁর স্ত্রী এবং চাকর মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে তিনি নতুন পেশোয়াকে আটক করার ফন্দি করছিলেন। সেই সংক্রান্ত একটি চিঠিতে তিনি গর্দিদের লিখেছিলেন 'নারায়ণ রাও লা ধরা' অর্থাৎ নারায়ণ রাওকে আটক করে রাখো। সেই চিঠিতে আনন্দীবাঈ একটি ছোট পরিবর্তন করে গর্দিদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। 'নারায়ণ রাও লা ধরা', এই কথাটার পরিবর্তে তিনি লিখে দিয়েছিলেন 'নারায়ণ রাও লা মারা' অর্থাৎ নারায়ণ রাওকে হত্যা করো। রঘুনাথরাও যখন এই বদলের কথা জানতে পেরেছিলেন, তখন সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। যদিও স্থানীয় কিছু মানুষের মতে, আজও নারায়ণ রাওয়ের অতৃপ্ত আত্মা পূর্ণিমা রাতে তাঁর কাকার কাছে সাহায্যের আর্জি জানায়।
১৮১৮ সালের ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পরে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই কেল্লা দখল করে। তৎকালীন পেশোয়াকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই কেল্লা হয়তো কোনও দিন ইংরেজদের মালিকানা স্বীকার করতে চায়নি। ১৮১৮ সাল থেকে ১৮২৮ সাল অবধি এই কেল্লায় বহু অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেই অগ্নিকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৮২৮ সালের অগ্নিকাণ্ড। ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৮ সালে শুরু হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের জেরে বহু জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলেও কেল্লার পাথরের প্রাচীর, ভিত, দরজা, কয়েকটি কামান এবং অল্প কিছু জিনিস রক্ষা পেয়েছিল। কথিত আছে যে, এই অগ্নিকাণ্ড সাতদিন ধরে চলেছিল। ইংরেজ অথবা অন্য কেউ কোনও দিন এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। এই বীভৎস অগ্নিকাণ্ডের পর কেল্লা মানুষের থাকার অযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। ২৯০ বছরের পুরনো এই কেল্লা দেখতে আজও বহু মানুষ প্রত্যেকদিন সকাল ন'টা থেকে সন্ধে সাড়ে ছ'টার মধ্যে ভিড় জমান। এই শতকের শুরু থেকে প্রত্যহ একটি লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের আয়োজন করা হয়।মানুষের ভিড়ের মধ্যে বীরত্ব, ভালবাসা, ষড়যন্ত্র, খুন, রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শনিওয়ার ওয়ারা।
তথ্য ঋণ: পুণে গভ.ইন, থ্রিলিং ট্রাভেল