কেন কালীপুজোর দিন হয় অলক্ষ্মী বিদায়
Kali Puja 2022: খানিকটা অবহেলিত দেবী কালীর শ্মশান উপাখ্যানের মধ্যেই বারবার বিরচিত হয় এই অলক্ষ্মীর অনুষঙ্গ।
রূপেই তোমায় ভালো লাগে, গুণে তুমি কী! বাহির তোমার খারাপ হলে সমাজে তুমি ঝি! ও মেয়ে তোর বয়স কত বলতে বলতে ও মেয়ে তুই খারাপ কেন? এই প্রশ্নেই উদ্বেল হয় দুনিয়া। তথাকথিত সমাজের ঠিক করে দেওয়া বিধিনিষেধের বশে বারবার অনুরণিত হয় এক-একটি কালো মেয়ের উপাখ্যান।
বর্ণবৈষম্য থেকে সামাজিক গঞ্জনা সব ক্ষেত্রেই দেখা দেয় এক অযাচিত হস্তক্ষেপ! ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মূর যুগে দাঁড়িয়েও এমনই একাধিক দৃষ্টান্ত উঠে আসে পুরাণ থেকেও। আর তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন কালীপুজোর রাতের অলক্ষ্মী! বঞ্চিত দেবী চণ্ডী, খানিকটা অবহেলিত দেবী কালীর শ্মশান উপাখ্যানের মধ্যেই বারবার বিরচিত হয় এই অলক্ষ্মীর অনুষঙ্গ। যাঁর অবহেলিত-আরাধনা সূচিত হয় দীপান্বিতা অমাবস্যায়। শ্যামার পূজার দিন।
কে এই অলক্ষ্মী
পুরাণে বলা হয়, অলক্ষ্মী এক হিন্দু দেবী। লক্ষ্মীর ছায়া এবং দুর্ভাগ্যের দেবী তিনি। অলক্ষ্মী কল্কি পুরাণ ও মহাভারত অনুযায়ী, বিরাটাকায় দৈত্য কলির দ্বিতীয়া স্ত্রী। বাহন তাঁর গর্ধব বা গাধা। এই অলক্ষ্মী প্রসঙ্গ রয়েছে লিঙ্গ পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, শ্রী সুক্তমে। তিনি দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কি না, এই বিষয়ে রয়েছে একাধিক বিতর্কও।
আরও পড়ুন: পুরুষকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটা! নবদ্বীপে যেভাবে তৈরি হয়েছিল প্রথম কালীমূর্তি
পুরাণে যাঁর রূপ বর্ণনা করা হয় ঠিক এইভাবে। 'গোরু খেদানো, হরিণের মতো পা, ষাড়ের মতো দাঁত।' অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর 'দেহ শুষ্ক, গাল কুঞ্চিত, ওষ্ঠাধর স্ফীত, ক্ষুদ্র, গোলাকার ও উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্টা এবং তিনি গর্দভের পিঠে উপবিষ্টা।'
তিনি কখনও কখনও লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচার রূপ ধারণ করেন। মনে করা হয়, প্যাঁচা হল, লক্ষ্মী দ্বারা আসা সৌভাগ্যের সঙ্গেই হাজির হওয়া ঔদ্ধত্য ও অশুভের প্রতিনিধি এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
অর্থাৎ, এই বর্ণনার ছত্রে ছত্রে বিরচিত অলক্ষ্মীর কুকথা। যেখানে তাঁর নামের মধ্যেই রয়েছে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত, অর্থাৎ অ অর্থাৎ না লক্ষ্মী। সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর বর্ণনাও লক্ষ্মীর বিপরীতে রয়েছে খারাপেই দাঁড়িয়ে।
কথকতার অলক্ষ্মী
অলক্ষ্মীর জন্ম-সংক্রান্ত একাধিক উপাখ্যান রয়েছে। এক জায়গায় বলা হয়, লক্ষ্মী প্রজাপতির মুখের আভা থেকে জন্ম নেন এবং অলক্ষ্মী জন্ম নেন প্রজাপতির পৃষ্ঠদেশ থেকে।
অপর একটি উপাখ্যান অনুযায়ী, লক্ষ্মীর জন্ম সমুদ্রমন্থনের সময়। এইসময় বাসুকি নাগের মুখনিসৃত কালকূট বিষ থেকে অলক্ষ্মীর জন্ম হয়। আবার এই কাহিনিরই পাঠান্তর অনুযায়ী, অলক্ষ্মী-লক্ষ্মী দুই জনেই সমুদ্রমন্থনের সময় জন্ম নেন। অলক্ষ্মী আগে জন্মান।
অপর একটি উপাখ্যান অনুযায়ী বলা হয়, অলক্ষ্মী তার কনিষ্ঠা ভগিনীকে বিষ্ণুর মতো স্বামীর সঙ্গে বৈকুণ্ঠে বাস করতে দেখে বেদনার্ত হন। কারণ তার স্বামী বা বাসস্থান কিছুই ছিল না। লক্ষ্মী তখন তাকে বর দেন,
কলি হবে অলক্ষ্মীর স্বামী এবং অপরিচ্ছন্ন, কুৎসিত, আলস্য, অত্যাচার, ঈর্ষা, ক্রোধ, ভণ্ড, লোভ ও কামের মধ্যে তিনি বাস করবেন।
তখন থেকেই সাড়ম্বরে উৎপত্তি।
অলক্ষ্মী পুজো
কালীপুজোর দিন। দীপান্বিতা অমাবস্যায় অশুভের বিদায় লগ্নের আগমনের জন্য অলক্ষ্মীর পুজো হয়। যেখানে দীপাবলির সন্ধ্যায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুধর্মের মহিলারা এই পুজো করেন। অলক্ষ্মীকে অমঙ্গল ও অশুভের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তাই অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীবরণই এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর এবং পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মী, কুবের ও নারায়ণের মূর্তি নির্মাণ করা হয়। উঠানের এক কোণে অলক্ষ্মীর মূর্তি রেখে প্রথমে পূজা করা হয়। পূজা শেষে মেয়েরা কুলো পিটাতে পিটাতে ওই মূর্তিটি বাড়ির কাছের কোনও রাস্তার তিন মাথা মোড়ে নিয়ে যান।
সেখানে সমবেত কণ্ঠে 'লক্ষ্মী আয়, অলক্ষ্মী যা' ধ্বনি সহকারে মূর্তিটি ফেলে দেওয়া হয়। ফেরার পথে আলোর আধিক্য থাকে। এর সঙ্গেই বাজে ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা। এরপর গৃহিণীরা গৃহে ফিরে তাঁদের আরাধ্যা দেবী লক্ষ্মীর পূজা করেন।
নারীর বঞ্চনা
সমসাময়িক প্রেক্ষাপট এবং সার্বিকভাবে পুরাণে বর্ণিত নারীর-দেবীর মাহাত্ম্য-কথায় যে বঞ্চনার প্রসঙ্গ এসেছে, তার মধ্যে অন্যতম যেমন মনসা, চণ্ডী। ঠিক তার বিপরীত দিকে রয়েছেন এই অলক্ষ্মী। যাঁর অস্তিত্ব লক্ষ্মীর ছায়ায়, যাঁর অস্তিত্ব কখনও লক্ষ্মীর পদতলের প্যাঁচার মধ্যে। অর্থাৎ বরাবর বঞ্চিত, অবহেলিত তিনি।
অনেকেই বলেন, পুরাণকথায় তাঁর প্রসঙ্গে একাধিক অশুভের কথা বলা হয়েছে, তাই তাঁকে তাড়াতে এই কথকতা আসবেই!
কিন্তু সেই অনুযায়ী যদি অলক্ষ্মীর উপাখ্যান ধরা হয়, সেখানেই বলছে; যখন অলক্ষ্মী গৃহে প্রবেশ করেন, তখন তিনি সেই গৃহে ঈর্ষা ও অমঙ্গল নিয়ে আসেন। তিনি ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব এনে কুল-বিনাশ করেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে লক্ষ্মীর বিপরীত দিক, পূর্ণিমার আলোকের অভিযাত্রী লক্ষ্মীর অন্ধকার দিকের বাহক তিনি। মানব সত্তার আলো আর কালোর মধ্যেই তিনিই কালোর দেবী। যেখানে কালী হয়েছেন শক্তি, সংহার আর দশ মহাবিদ্যার এক রূপ। যেখানে সমস্ত খারাপের ত্যাগের বাহক হয়ে উঠেছেন কালী। অনেক লড়াইয়ের পরে এসেছে এই স্বীকৃতি। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে অলক্ষ্মীর দেবী সত্তার তুলনায় তাঁর খারাপ দিকটিই বিবেচিত হয়েছে বারবার। যেখানে মহিলারা আর এক মহিলাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন ঘর থেকে। এই সমাজের নারীর প্রতি নারীর অত্যাচারের মতোই। দুয়ারে লেবু-লঙ্কা প্রতীক রাখছেন যাতে তিনি না আসেন!
যাঁর বঞ্চনা তো প্রথম থেকেই! একই সঙ্গে জন্মেও লক্ষ্মীর বড় দিদি হয়েও তিনি স্বর্গে নন, থেকেছেন অন্যত্র। আবার লক্ষ্মী তাঁকে খারাপের মধ্যে থাকতে, খারাপ স্বামী পাওয়ার বর দিচ্ছেন।
অর্থাৎ, তুমি খারাপ, তোমার স্থান ওখানেই। যে অধিকার ছিনিয়ে নিতে পেরেছিলেন মনসা। যে লড়াইয়ে খানিকটা রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন চণ্ডী, কালী। সেখানে অলক্ষ্মীর রূপ, অবস্থান প্রসঙ্গ, পুরাণ-অনুষঙ্গ তাঁদের তুলনায় বহু ক্ষেত্রে আলাদা হলেও এই লড়াই না করেই ক্রমশ যেন একা একা বারবার অশুভের সঙ্গেই বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। আর সেখানেই অলক্ষ্মী তাড়াতে উদ্যত মেয়েরাই আর এক মেয়েকে ঝাঁটাপেটা করেছেন বারবার।