পুরাণ থেকেই চলছে বউদি-ননদের দ্বন্দ্ব! শিবের বোন আশাবরী আর দেবী পার্বতীর গল্প

শিবের বোনকে জন্মের একদিনের মধ্যেই কৈলাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এইভাবেই হয়তো পৌরাণিক যুগ থেকে শুরু করে আজও ননদ ও বউদির সম্পর্কে মিলমিশের অভাব যেন পরিবারের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

 

 

ভারত এক বৈচিত্র‍্যপূর্ণ দেশ। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, ঐতিহ্য, ও ধর্মের মানুষ এখানে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলে। হিন্দু পৌরাণিক ঘটনা এবং গল্পগুলি এমনই যে, বর্তমান সময়ের সঙ্গেও তার অটুট সম্পর্ক থাকে। কিন্তু এইসব পৌরাণিক ঘটনার মধ্যে এমন অনেক গল্প আছে যা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। তেমনই এক গল্প হল শিবের বোন দেবী আশাবরীকে নিয়ে। যাঁকে স্বয়ং দেবতা শিব নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন।

ভারত এমন একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন পৌরাণিক।কাহিনি বা কিংবদন্তি বিদ্যমান ছিল শুরু থেকেই। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। পৌরাণিক কাহিনির মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগের আধিপত্যবাদী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কঠোর বাস্তবতাও উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে লিঙ্গ বা বর্ণবৈষম্য উপস্থিত ছিল। যেমন ধরুন, রামের‌ বোনের কথা। আজ আমরা ক’জন জানি বলুন তো যে, রাম অযোধ্যার রাজপরিবারের সবথেকে বড় সন্তান ছিল না। সত্যি কথা, হয়তো অনেকেই জানেন না। আসল কথা হলো, রামের জন্মের পূর্বে রাজা দশরথের এক কন্যাসন্তান হয়, যাঁর নাম ছিল শান্তা। আমরা তাঁর বিষয়ে কিছু জানি না, কারণ রাজা দশরথ ছোট থাকতেই সেই মেয়েকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। রাজ্য চালানোর জন্য তাঁর দরকার ছিল রামের মতো পুত্রসন্তানের। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারতীয় সভ্যতার শুরু থেকেই লিঙ্গবৈষম্য পুরোদমে ছিল।

এরপর আসি শিবের বোনের কথায়। শিব আত্মভোলা মানুষ। সংসারের কোনওকিছুতেই তাঁর মন নেই। আর
এই শিবঠাকুরের বোন যে দেবী পার্বতীর ননদিনী হবেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। তবে এদিকে এক মহাবিপদ উপস্থিত। আত্মভোলা শিব এমন এক দেবতা, যার না আছে শুরু, না আছে শেষ। এককথায় তিনি অজন্ম। তাহলে সেই দেবতার আবার বোন এল কোথা থেকে?

আরও পড়ুন: জগন্নাথের রথ এক ইসলাম সম্প্রদায়ের ভক্তের সমাধির সামনে এসে থামে আজও

কৈলাসে বিয়ে হয়ে আসা অবধি দেবী পার্বতীর মন বড় খারাপ। দেবাদিদেব তো সারাক্ষণই ধ্যানে মগ্ন। আর নয়তো তাঁর চ্যালাদের নিয়ে চলছে ভাং খাওয়া, নাচ-গান এইসব। কার্যত একাকীত্বেই তাঁর জীবন কাটতে থাকে। শিব ছাড়াও তাঁর দুই চ্যালা নন্দী আর ভৃঙ্গী তাঁর সঙ্গে থাকে। কিন্তু তাদের সঙ্গে আর কী কথা বলবেন তিনি। কতক্ষণই বা তাদের সঙ্গে থাকা যায়? যদি তাঁর কোনও ননদ থাকত বা দ্বিতীয় কোনও নারী থাকত, তাহলে কত ভালো হতো। কী সুন্দর তাঁর সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে যেত। কিন্তু তা আর হলো কই! শুধু শুধু একা বসে থাকা। কাজের মধ্যে পরিবারের সকলের জন্য মুখরোচক ব্যঞ্জন বানানো। তিনি যে জগজ্জননী, দেবী অন্নপূর্ণা। তিনি না রাঁধলে যে কারও মুখে রুচবে না।

একদিন দেবী পার্বতী বসে আছেন মানস সরোবরের তীরে আর মনে পড়ছে তাঁর ছোটবেলার কথা। আজ তাঁর বড় মন খারাপ, যদি একটা ননদিনী থাকত, তাহলে আর এত মন খারাপ হতো না। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সময় কেটে যেত। কত যত্ন করতাম তাকে। সেও আমাকে কত ভালবাসত। সেইদিন রাতে শিব ঘরে ফিরতেই তাকে সব খুলে বললেন পার্বতী।

শিব তখন বললেন, দেবী সরস্বতীকে কৈলাসে ডেকে নিতে। কিন্তু সে গুড়েও বালি। সরস্বতীর সাংসারিক জীবন আছে, দায়িত্ব আছে। সে কী করে আসবে? তাঁর ওপর সে ব্রহ্মার স্ত্রী। তাকে ছেড়ে সে কীভাবে এখানে এসে থাকবে। তাহলে উপায়?

দেবী পার্বতী বললেন, যদি তোমার কোনও বোন থাকত, তাহলে কত ভালো হতো। শিব সব শুনে বললেন, দেবী তুমি যা বলছ তা ঠিক, কিন্তু সব ভেবে-চিন্তে তারপর আমাকে বলো। কারণ এর ফল শুভ নাও হতে পারে। তাই মন স্থির করে আমাকে বলো কী চাইছ।

দেবী রেগে গিয়ে বললেন, তুমি তো আত্মভোলা, নিজের কাজ নিয়েই থাকো। আমার জ্বালা কি বোঝ। আমার একা একা কীভাবে কাটে, তা কি তুমি জানো। এরপর শিব বললেন, ঠিক আছে, তোমার কোনও কথা আমি আজ অবধি ফেলতে পারিনি, তাই এই কথাও রাখছি। আর অন্যদিকে দেবী পার্বতী শিবকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তাঁর ননদকে তিনি পরম যত্নে রাখবেন, তাঁর খাওয়ানো-পরানো সব দায়িত্ব তাঁর।

আর অন্য কোনও উপায় না দেখে ধ্যানে বসলেন শিব। কিন্তু এখানেও সমস্যা। তিনি যে ধ্বংসের দেবতা, অন্য মানুষ সৃষ্টি করবেন কী করে। ত্রিকালজ্ঞানী হলেও তিনি যে এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। কী আর করা, দেবীকে কথা যখন দিয়েছেন, তা তো রক্ষা করতেই হবে। এরপর তিনি তাঁর সমস্ত ধ্যান-সহযোগে সমস্ত পবিত্র শক্তিকে কাজে লাগিয়ে হুবহু নিজের মতো এক নারীকে সৃষ্টি করলেন। তাঁর নিজের বোন। নাম রাখলেন দেবী আশাবরী।

এই দেবী আশাবরী শিবের মতোই বস্ত্রহীন, পরনে শুধু বাঘছাল। দীর্ঘ জটাযুক্ত কেশ আর সুডৌল নাক। আর পায়ের গোড়ালিতে বিশাল ফাটল। পার্বতী ননদকে পেয়ে আপ্লুত। আশাবরীকে ভাল করে স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পরিয়ে খেতে দেন তিনি।

কিন্তু, আশাবরীর খিদে দেখে চমকে যান পার্বতী। পার্বতী যত জনের রান্না করেছিলেন, এক লহমায় তার সবটাই খেয়ে ফেলেছেন আশাবরী। তাঁর আরও খাবার চাই। পার্বতী জানালেন, আর খাবার নেই। শুনবেন না আশাবরী। পার্বতী ছুটলেন শিবের কাছে। পার্বতী সবিস্তারে সমস্ত কথাই জানালেন। কিন্তু শিব স্মরণ করিয়ে দিলেন, পার্বতী-ই বলেছিলেন আশাবরীর যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না।

এরপর পার্বতী ফিরে যান কৈলাসে। শুরু হয় বউদি আর ননদে খোঁটাখুঁটি। এর পরিণামে দুষ্টু আশাবরী পার্বতীকে তাঁর গোড়ালির ফাটলে বন্দি করে ফেলেন। সেখানে দম বন্ধ হয়ে যায় দেবী পার্বতীর। এদিকে শিব তো ধ্যানে বসে সব দেখতে পাচ্ছেন। তিনি না জানার ভান করে বাড়ি ফিরলেন। এসে পার্বতীকে না দেখে আশাবরীকে জিজ্ঞেস করলেন, পার্বতী কোথায়? কিন্তু আশাবরী মিথ্যে কথা বলেন যে, তিনি জানেন না তাঁর বউদি পার্বতী কোথায়।

দেবী পার্বতী চাইলেই সেই ফাটল থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন, কিন্তু ননদ ক্ষুব্ধ হবে ভেবে তিনি সেখানেই ছিলেন। এদিকে শিব তো রেগে ফায়ার। শিবের সেই প্রলয় রূপ দেখে আশাবরী তাঁর পায়ের ফাটল ঝাড়া দিলে সেখান থেকে দেবী পার্বতী আবির্ভূত হন। আশাবরীর এত যত্ন করার পরও ননদের এই আচরণে দুঃখিত হন পার্বতী। তিনি শিবের কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার করে বলেন, এমন মেয়ের সঙ্গে সংসার করা কঠিন। আশাবরীর আচরণ যে তাঁকে পীড়া দিয়েছে, তাও জানান পার্বতী। কৈলাসে আশাবরীকে রাখতে পারবেন না বলেও শিবকে জানিয়ে দেন।

শিব ঠিক করলেন আশাবরীর ত্রুটিগুলি মোচন করে সরিয়ে কিছু ভাল গুণ দিয়ে তাঁকে পুনর্জন্ম দেবেন। কিন্তু, পার্বতী বলে বসেন, আশাবরী যদি নিজের চরিত্রে নমনীয়তা আনতে পারেন এবং পার্বতীকে সম্মান দিতে পারেন, তবেই তিনি তাঁকে কৈলাসে থাকতে দেবেন। পার্বতীর এহেন ভাবনার কথা জেনে আশাবরীর পুনর্জন্মের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন শিব। তিনি পার্বতীকে জানান, কখনওই কেউ কারও মনের মতো হতে পারে না। সকলের একটা স্বাধীন সত্তা থাকে। সেই সঙ্গে শিব এ-ও বলেন যে, দুই ভিন্ন রক্তের সম্পর্কের নারী একই জায়গায় চিরটা কাল সুখী থাকতে পারে না। তাই আশাবরীকে কৈলাস থেকে সরিয়ে দেন শিব।

এই ছিল শিবের বোনের কাহিনি। যাকে জন্মের একদিনের মধ্যেই কৈলাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এইভাবেই হয়তো পৌরাণিক যুগ থেকে শুরু করে আজও ননদ ও বউদির সম্পর্কে মিলমিশের অভাব যেন পরিবারের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখনও আমরা বিভিন্ন সিরিয়ালে বা অনেক বাড়িতেও দেখি, বউদি আর ননদের সম্পর্কের টানাপড়েন। এইসব দেখার পর ভগবান শিবের কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। ভিন্ন রক্তের নারী কখনওই একসঙ্গে থাকতে পারে না।

 

 

More Articles