টানা দশ দিন ধরে দোল খেলা হয় নবদ্বীপে, কোন রহস্য লুকিয়ে আড়াইশো বছরের পুরনো ইতিহাসে?
Dol Yatra 2023 at Nabadwip, Mayapur : প্রতিবছরের মতো এবারেও নবদ্বীপে সাজো সাজো রব। এই স্থান থেকে যাতে কোনও ভক্তরাই বিনা প্রসাদে না ফেরেন তার জন্যও শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যবস্থাপনা।
নদীয়া মানেই বৈষ্ণব ও চৈতন্য ভক্তির পীঠ। এক উৎসব শেষের কুঞ্জভঙ্গের বেদনা মিলিয়ে যায় নতুন উৎসবের অধিবাসে, এ কথা যেন যথার্থই নবদ্বীপে। নবদ্বীপের দোল মানেই একটা অন্যরকম আবহ। তাই দোল শেষ হওয়ার দিন দশেক পরেও বাতাসে মিশে থাকে আবির গুলান। নগর সংকীর্তনের দলের শব্দে মুখর হয়ে ওঠে বাতাস। মুহূর্তের মধ্যে ব্যস্ত শহরের পিচঢালা পথ যেন বৈষ্ণব ভজনকুঠির নাটমন্দির হয়ে ওঠে এই সময়। সুর, রং আর সুগন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে বসন্তের আগমন। এই শহরের পাড় ঘেঁষে বিয়ে যায় গঙ্গা। এই নদীকে কেন্দ্র করে আরও আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এই জনপদ। উৎসব নিয়ে যে আকর্ষণ তাই চাঙ্গা করে তোলে অর্থনীতির ভিত। পর্যটন মানচিত্রে বেশ জাঁকিয়ে জায়গা করে নিয়েছে নবদ্বীপ। উৎসবকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এখানকার জীবন এবং জীবিকা। বছরের এই সময়টা নবদ্বীপে একটা অন্যরকম পরিবেশ। এখানে দোল চলে প্রথম থেকে টানা দশম দোল অবধি। বৃন্দাবনের বর্ষাণা হোলি, জাওয়াট হোলি বা নন্দগ্রাম হোলির মত, এসব দোলের প্রতিটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
যাই হোক, আসা যাক এবারের দল উৎসবের আয়োজনে। প্রতিবছরের মতো এবারেও নবদ্বীপে সাজো সাজো রব। এই স্থান থেকে যাতে কোনও ভক্তরাই বিনা প্রসাদে না ফেরেন তার জন্যও শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যবস্থাপনা। ক্লাব, বারোয়ারি পুজো কমিটি, প্রতিষ্ঠান এমনকী কিছু কিছু মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগেও প্রসাদ খাওনোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেই জানা গিয়েছে। অন্তত এক হাজার মানুষকে প্রসাদ খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন - কে বেশি প্রাচীন, শান্তিপুর না কি নবদ্বীপ? রাসযাত্রা ঘিরে একাধিক কাহিনি আজও অবাক করে
নবদ্বীপ হল একমাত্র জায়গা, যেখানে দোলের এতদিন পরেও চলে দোল উৎসব। আবিরের রঙে রাঙা হয়ে থাকে পরিবেশ। এর মূল কারণ অবশ্য স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভু। দোলপূর্ণিমার পুণ্য তিথিতেই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেই কারণেই দোল পূর্ণিমা তিথিটি নবদ্বীপবাসীর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর চৈতন্য মহাপ্রভুর ৫৩৭তম আবির্ভাব দিবস। আর এই উৎসব উপলক্ষ্যে বহু মানুষ ভিড় করেন নবদ্বীপ এবং মায়াপুরে। এমনিতেই চৈতন্য দেবের মহিমায় সারা বছরই নবদ্বীপ এবং ইসকন মন্দির নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা অন্যরকম আকর্ষণ থাকে। এবারে সেই আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে দিতে ইতিমধ্যে শুরু করা হয়েছে মায়াপুর ইসকন মন্দিরের নগর পরিক্রমা। এক মাস ব্যাপী চলবে নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দুই বছর পর এবার আবারও করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে পুরনো জৌলুস ফিরে পেতে চলেছে নবদ্বীপের দোল।
পুরাণ এবং ইতিহাস...
“কীর্তন ফাগু খেলত গোরা বিষ্ণুপ্রিয়া সঙ্গে, মারে পিচকারি দুঁহুঁ দোঁহা অঙ্গে...” এই গবের সুর আজও লেগে রয়েছে নবদ্বীপের সঙ্গে। কথিত রয়েছে, বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর দুই প্রিয় সখি কাঞ্চনা এবং অনিতা এই দশমী তিথিতে গৌরাঙ্গদেবের সঙ্গে রঙ খেলে ছিলেন। তাই সেই রীতি মেনে আজও মহাপ্রভুকে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সহ দোলনায় বসানো হয়। গাওয়া হয় এই গান। আর রাধাকৃষ্ণের দোল শেষ হলে তবে শুরু হয় মহাপ্রভুর দোল খেলার রীতি। এই প্রথার বয়স আজ প্রায় আড়াইশো বছর ধরে চলে আসছে। ঐতিহ্যের পিঠে চেপে আজকের সময়ও এগোচ্ছে বছর বছর। আর উৎসবের আঙিনায় এবং ভক্তের ভক্তিতে ফিরে ফিরে আসছেন মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব।