রুটির দোকানের হেল্পার ছিলেন নন্দিনীর বাবা, মেয়ের কাঁধে ভর দিয়েই উড়ান দিচ্ছে পাইস হোটেল
Nandini Pice Hotel: সংসার চালানোর দায় হয়ে উঠছে দেখে বাধ্য হয়েই অফিস পাড়ায় এসে এক চিলতে দোকানে প্রথমে রোজ ২০০ টাকা মাইনেতে রুটি বেলার কাজ নেব চক্রধারীবাবু
নন্দিনীর পাইস হোটেল। বর্তমানে ডালহৌসি রোডে অফিসপাড়ায় পরিচিত খাবারের ঠেক। কেউ ডাকে ম্যাডাম বলে, কেউ মমতা অথবা নন্দিনী, কেউ স্রেফ দিদি। রাতারাতি ভাইরাল এই এক চিলতে পাইস হোটেল। দিন পনেরো আগেও নন্দিনী ভাবতে পারেনি এমন হঠাৎ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতে পারে। প্রতিদিন যেখানে ৩০ প্লেট ভাত রেঁধে, লোকসান হতো তাঁর, সেখানেই এখন রোজ ৬০ প্লেট ভাত বিক্রি করেও ভিড় সামলাতে পারছেন না নন্দিনী। কিন্তু কীভাবে হল এমন বদল? প্রশ্নের উত্তর দিলেন স্বয়ং।
দিদি নম্বর ওয়ান, সমাজের মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলে বলেই পরিচিত এই ‘রিয়ালিটি' শো। এই আসরে ছিলেন নন্দিনী ওরফে মমতা গাঙ্গুলি। তিনি জানান, একদিন দুপুরে তার দোকানে ‘ডিম-ভাত’ খেতে এসেছিল একটি ছেলে। তার আবদার ছিল দোকানের ভিডিও করবে। আপত্তি করেননি নন্দিনী। যতটা পেরেছেন প্রশ্নকর্তাকে যথাযথ উত্তর দিয়েছেন। ভিডিও হয়, সেই ভিডিও পোস্টও হয় সোশ্যাল মাধ্যমে। ব্যাস তারপরই হয় মীরাকেল। মুহূর্তের মধ্যে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে নন্দিনীর গল্প। অফিস পাড়ার এক টুকরো ওই ভাতের হোটেলের গল্প।
নন্দিনী অবশ্য এর বিন্দুবিসর্গ জানত না। বুঝতে পারে একের পর এক ইউটিউবারের ভিড় দেখে। শুধু তাই নয়, ভিড় জমে খাদ্যপ্রেমী বাঙালিরও। জিন্স, কালো টপ আর গলায় ঝুলছে ব্লু টুথ হেড ফোন। এই ছবিটাই ছিল পরিচিত। এদিন অবশ্য রিয়ালিটি শো এর মঞ্চে ধরা দিলেন অন্য ভূমিকা। সবুজ রঙের শাড়িতে , বঙ্গ তনয়া মমতা। জীবনের গল্প বলতে বলতে চোখে জল এল তাঁর। সদা হাস্যময়ী এই মেয়েটিও অনেক লড়াই করেছে। যা হয়তো পাইস হোটেলে খেতে আসা অনেকেই জানে না। একসময় প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিল শরীরের একটা দিক, তারপর অনেক ঝড় সামলে পরিবারের সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে। তাই পরিবারের অসময়ে সেই দিন ভুলতে পারেনি, বাবার এক ডাকে নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে ছুটে এসেছে কলকাতায়। বাবা মায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে রোজকার লড়াইটা করছে সেও।
আরও পড়ুন - হাসিমুখে ভাতের থালা হাতে অফিস পাড়ার নন্দিনী, নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে কেন বেছে নিলেন এই পথ
সকাল নটা থেকে শুরু হয়ে যায় রান্নার তোড়জোড়। নিজের হাতে রোজ শিয়ালদহ থেকে বাজার করেন নন্দিনীর বাবা চক্রধারী গাঙ্গুলি। মা বিনাদেবী থাকেন কোটা বাটার দায়িত্বে। এরপর মাঠে নামে মমতা। রান্নায় বাবার সঙ্গে হাত লাগায় সে। তারপর নিজে হাতে ভাত বেড়ে খেতে দেন সকলকে। করোনায় রবারের ব্যবসা ডুবে যায় নন্দিনীর বাবা। নন্দিনী তখন রাজ্যের বাইরে। সংসার চালানোর দায় হয়ে উঠছে দেখে বাধ্য হয়েই অফিস পাড়ায় এসে এক চিলতে দোকানে প্রথমে রোজ ২০০ টাকা মাইনেতে রুটি বেলার কাজ নেব চক্রধারীবাবু। কোনও কাজকেই ছোট হিসেবে দেখেননি তিনি। সংসারের প্রয়োজনে তাই রুটি বেলার কাজ নেন। তারপর খানিকটা পয়সা জমিয়ে ওই অঞ্চলে নিজে একটা দোকান ভাড়া নেন। স্বামী স্ত্রী মিলেই চালাচ্ছিলেন। নন্দিনী বাদে বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন স্ত্রী বিনা গাঙ্গুলি। ঠিক তখন থেকে গল্পে প্রবেশ নন্দিনীর। অতঃপর এমন রাতারাতি প্রচারের আলো।
তবে এ আলো যে একদিন নিভে যাবে, পড়ে থাকবে কেবল রোজকার লড়াইটুকু একথা জানেন তাঁরা তিনজনই। তাই স্রোতে গা ভাসতে চান না। মাটিতে পা রেখেই চলছে এই পরিবার। নন্দিনীর কথায়, বাবাই সব। আমি কেবল পিছন থেকে একটা “সঙ্গে আছি” বলেছিলাম। বাবার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিতে চেয়েছিলেন নন্দিনী। সেই ভরসা টুকুই এখন স্বপ্নের পথে পাড়ি দিচ্ছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে নন্দিনীর মতো মেয়েরা সত্যিই উদাহরণ। যে, ভেঙে পড়া সমাজের চোখে চোখ রেখে শিখিয়ে দিচ্ছে এরই নাম আসল লড়াই।