শুধু মহিষাসুর নয়, নটরাজের পায়ে দলিত হয় এক বামন অসুর! কে এই মুয়ালাকা?

Nataraja and Apasmara: এই বামন অসুরের নাম আপসমারা। আপসমারা হলেন একজন বামন যিনি আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা এবং অর্থহীন কথাবার্তার প্রতিনিধিত্ব করেন

দুর্গাপুজো সাঙ্গ। অসুরদলনী দুর্গাকে সমস্ত অশুভ শক্তির দমন আর শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা করার জন্য আরাধনা চারদিন অতিক্রান্ত করেছে। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র মতে, যুগে যুগে ঈশ্বর নানা রূপে অবতীর্ণ হন এই ধরাধামে। তিনিই অশুভ শক্তিকে বিনষ্ট করেন এবং ভক্তদের রক্ষা করেন। দুর্গার আগমনও তেমনই কারণে। যখন মহিষাসুরের দমন পীড়নে দেবতারা প্রায় স্বর্গচ্যুত হতে বসেছিলেন, তাঁদের রক্ষার্থেই অসুরকে হত্যা করেন দুর্গা। মানুষের বিশ্বাস, বিপদে পড়লে নিশ্চয়ই ঘরের মেয়ে দুর্গা (এক্ষেত্রে পড়ুন ঈশ্বর) এসে সামনে দাঁড়াবেন এবং রক্ষা করবেন। বিষয়টা নারী শক্তি বা পুরুষশক্তির নয়। বিষয়টা শুভ শক্তি এবং অশুভ শক্তির। তাই কখনও পুরুষ বেশে নেমে আসেন (শ্রীকৃষ্ণ বা রাম) কখনো নারী বেশে (দুর্গা, কালী ইত্যাদি)! যুগে যুগেই সেই শুভশক্তির জয়। তারই দৃপ্ত উচ্চারণ শুনতে পাই গীতার শ্লোকে,

"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥

পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥"

যদা যদা হি (যখন যখনই)- ধর্মস্য (ধর্মের)- গ্লানিঃ (গ্লানি)- ভবতি (হয়); ভারত (হে ভরতবংশী অর্জুন); অভ্যুত্থানম্ (অভ্যুত্থান ঘটে) অধর্মস্য (অধর্মের); তত্ [তখনই] (সেই/স্বীয়)- আত্মানং (আত্মাকে)- সৃজামি (সৃজন করি)। -অহং (আমি)। পরিত্রাণায় হি (পরিত্রাণের জন্যই), সাধুনাং (সাধুদের বা ধার্মিকদের) বিনাশায় চ (এবং বিনাশ নিমিত্ত); দুষ্কৃতাং (দুষ্কৃতকারীদের) ধর্মসংস্থাপনার্থায় (ধর্ম সংস্থাপনের জন্য)- সম্ভবামি (অবতীর্ণ হই~লীলা শরীর বিগ্রহ করি)॥ যুগে যুগে (যুগে যুগে)

দুর্গার পায়ের নিচে মহিষাসুরকে সকলেই দেখে অভ্যস্ত, শুভশক্তির পদতলে অশুভের বিনাশ। অথচ চোখ এড়িয়ে গিয়েছে নটরাজ শিবের মূর্তি। যেমন দুর্গার পদতলে অসুর, ঠিক তেমনই এক বামন আকৃতির ভয়ানক অসুরকে দলিত হতে দেখা যায় নটরাজ শিবের পদতলে। কে এই বামন অসুর? কেনই বা নৃত্যরত মহাদেবের পদতলে এই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় তিনি? এই অসুরের সঙ্গে এমন কিছু বিষয় জড়িত আছে যা ধর্মীয় ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে, যা এক বাস্তব বধের শিক্ষা দেয়। আজকে সেদিকেই একটু দৃষ্টিপাত করা যাক।

আরও পড়ুন- ঋতুমতী কন্যারা ব্রাত্য, কীভাবে নির্বাচন করা হয় কুমারী পুজোর বালিকাদের?

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই বামন অসুরের নাম আপসমারা। আপসমারা হলেন একজন বামন যিনি আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা এবং অর্থহীন কথাবার্তার প্রতিনিধিত্ব করেন অর্থাৎ তিনি মানব জীবনের বামনত্ব বা ক্ষুদ্রতারই প্রতিনিধি। তিনি মুয়ালকা বা মুয়ালাকান নামেও পরিচিত। পৃথিবীতে জ্ঞান রক্ষা করার জন্য, অপস্মরাকে (অজ্ঞানতা বা জ্ঞানের বামনত্বকে) বশীভূত করতে হবে, হত্যা নয়। কারণ হত্যা করলে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অজ্ঞতার মধ্যে প্রয়োজনীয় ভারসাম্য নষ্ট হবে। আত্মহৃদয়ে অপস্মরাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা, উত্সর্গ এবং কঠোর পরিশ্রম ছাড়াই জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টার প্রতীক হবে এবং এটি সমস্ত আকারেই জ্ঞানের অবমূল্যায়নের দিকে পরিচালিত করবে। অর্থাৎ কঠোর সাধনা বা ধ্যান ছাড়া যে সংক্ষিপ্ত উপায়ে জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা তা প্রকৃতপক্ষে অসম্পূর্ণ জ্ঞান।

তাই অপস্মরাকে বশীভূত করার জন্য, পরম যোগী, পরম জ্ঞানী শিব– নৃত্যের প্রভু নটরাজের রূপ ধারণ করেছিলেন এবং তাণ্ডবের মহাজাগতিক নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। এই নৃত্যের সময় নটরাজ অপস্মারকে তাঁর ডান পা দিয়ে পিষে দমন করেন। যেহেতু অপস্মরা (অজ্ঞতা) অমরত্বের জন্য নির্ধারিত কয়েকটি অসুরদের মধ্যে একটি (যেমন, অজ্ঞতা মানুষের জীবনে স্থায়ীভাবে অন্তর্হিত হয় না বিভিন্ন রূপে সে মানুষের মধ্যে বিরাজমান থাকে), তাই বিশ্বাস করা হয় যে শিব চিরকাল তাঁর নটরাজ রূপে অপস্মরাকে অনন্তকাল ধরে দমন করে থাকেন। অর্থাৎ আপসমারা বা অজ্ঞতার মৃত্যু নেই চিরকাল সে মানব হৃদয়ে উপস্থিত, অমর। কিন্তু সে অমর হলেও অপরাজেও নয়। শিবের মতো কঠোর জ্ঞান ও তপস্যার দ্বারা অপস্মরাকে (অজ্ঞতা) বশীভূত করা সম্ভব কিন্তু নির্মূল করা সম্ভব না। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যতই জ্ঞানী হন না কেন কিছু না কিছু অজ্ঞতা তাঁর ভেতরে থেকেই যায়। কিন্তু সাধনার ধারা যথাসম্ভব নিজেকে জ্ঞানী করে তোলা যায়। ঈশ্বরের পদতলে অপস্মরার (অজ্ঞতা) পিষ্ট হওয়া তারই প্রতীক।

আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়

নটরাজের ডান পা এই ভয়ঙ্কর ছোট অবমানবিক প্রাণী-রাক্ষস, মুয়ালকার উপর প্রতিস্থাপিত রয়েছে। একজন বামন, কিন্তু অজ্ঞতার মূর্ত প্রতীক, কুখ্যাত, অত্যন্ত শক্তিশালী মুয়ালাকা হল লোভী, অধিকারী সত্ত্বার প্রকাশ। তার উপর স্ট্যাম্প, তার পিঠ ভাঙা! আর ঠিক সেটাই করছেন নটরাজ। ছোট্ট দৈত্যটিকে ডান পায়ে মাড়াচ্ছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, তিনি নাচের সময় বাম পা মাটি থেকে তুলে রেখেছেন। কেন? এই উত্তোলিত পা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অমান্য করছে। এই নৃত্য ভঙ্গিমায় পা-টি মোক্ষের বা মুক্তির প্রতীক।

More Articles