সন্দেশখালি ঘুরে কেন রাষ্ট্রপতি শাসন চাইছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন?

Woman Commission in Sandeshkhali: সোমবার সন্দেশখালি পরিদর্শনে যায় জাতীয় মহিলা কমিশন। সন্দেশখালি ঘুরে দেখার পর রেখা শর্মা জানান, রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া গতি নেই সেখানে।

সন্দেশখালিতে মাত্রা ছাড়িয়েছে নারীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা। নেপথ্যে রয়েছেন শাসকদল তৃণমূলেরই স্থানীয় নেতা শেখ শাহজাহান আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ। বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামেন স্থানীয় মহিলারা। দিনের পর দিন মহিলাদের উপর শারীরিক নির্যাতন চলেছে। বিনা পারিশ্রমিকে করিয়ে নেওয়া হয়েছে স্কুল, পার্টি অফিস পরিষ্কারের মতো কাজ। রাতবিরেতে ডেকে পাঠানো হত স্থানীয় মেয়ে-বউদের। না যেতে চাইলে বাড়ির পুরুষদের উপর চলত অত্যাচার, মারধর। সন্দেশখালিতে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রয়োজন। সন্দেশখালি পরিদর্শনের পর তেমনটাই মনে করছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা।

কিছুদিন আগেই সন্দেশখালি ঘুরে এসেছে রাজ্যের এসসি কমিশন। তার পর সোমবার সন্দেশখালি পরিদর্শনে যায় জাতীয় মহিলা কমিশন। সন্দেশখালি ঘুরে দেখার পর রেখা শর্মা জানান, রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া গতি নেই সন্দেশখালির। দিনের পর দিন সেখানকার মেয়েদের উপর নির্যাতন হয়েছে। কম করে হলেও ১৮টি ধর্ষণের অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। মিলেছে দু'টি ধর্ষণের অভিযোগও। রেখা জানান, তাঁকে ধরে কেঁদেছেন গ্রামের মহিলারা। পুলিশের উপর আস্থা নেই গ্রামবাসীর। এই পরিস্থিতিতি রাষ্ট্রপতি শাসনের পক্ষেই সওয়াল করেছেন কমিশনে চেয়ারপার্সন।

আরও পড়ুন: কামদুনি গণধর্ষণে ন্যায়বিচার পেল নির্যাতিতার পরিবার?

মহিলাদের নির্যাতনের নেপথ্যে রয়েছে খোদ শাসকদলের নেতা। ফলে এই পরিস্থিতিতে যে বাসিন্দারা ঠিক কতটা স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য পাবেন, তা তো আঁচ করাই যায়। আর সন্দেশখালিতেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে বলে অভিযোগ বাসিন্দারা। সোমবার সন্দেশখালি গিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন রেখা শর্মা অভিযোগকারিনীদের সঙ্গে নিয়ে খোদ থানায় যান তিনি। রেখা শর্মা বলেন, “১৮টির কাছাকাছি অভিযোগপত্র পেয়েছি আজ। এর মধ্যে ২টি ধর্ষণের অভিযোগ আছে। বাকি যৌন হেনস্থা। তবে সেই মলেস্টেশনও ভয়ঙ্কর। বলেছেন, আমাদের কাপড় খুলে দিয়েছে, এখানে স্পর্শ করেছে ওখানে স্পর্শ করেছে। এত খারাপ এখানকার পরিস্থিতি যে আমাকে এখানকার মহিলারা ছাড়তে চাইছেন না। আমাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছেন ওনারা। খুব খারাপ অবস্থা। আমার মনে হয় না রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া আর কিছু হবে। পুলিশকেও ভয় পাচ্ছেন। লিখিত অভিযোগের কপি নিয়ে যাচ্ছি।” রেখা শর্মার দাবি, এখানে বাচ্চাদের কপালে পিস্তল ধরে ভয় দেখানো হয়। বলা হয়, মা যদি অভিযোগ না প্রত্যাহার করেন, তাহলে গুলি করে দেওয়া হবে।

 

রাজ্যের এসসি কমিশনও কিন্তু একই দাবি জানিয়েছিল সন্দেশখালি ঘুরে আসার পর।তফসিলি কমিশনের চেয়ারম্যান অরুণ হালদার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করে ওই সুপারিশ করেন। সন্দেশখালি গিয়েছিল জাতীয় তফসিলি কমিশনের প্রতিনিধি দল। সেখান থেকে ফিরে গত শুক্রবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন কমিশনের চেয়ারম্যান অরুণ এবং অন্য প্রতিনিধিরা। সেখানেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার সুপারিশ জানানো হয়। কেন রাষ্ট্রপতি শাসন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অরুণ বলেন, 'সংবিধানের ৩৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও রাজ্যে তফসিলি জনজাতিভুক্ত মানুষদের যদি সেখানকার সরকার সেখানকার সরকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি চাইলে সেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারেন।'

চলতি মাসের গোড়া থেকেই দফায় দফায় সন্দেশখালিতে অশান্তির খবর কানে এসেছে। অত্যাচারে জেরবার হয়ে শেষপর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ান মহিলারা। বিক্ষোভ দেখাতে পথে নামেন তাঁরা। মহিলাদের একাংশ দাবি করেছেন, তাঁদের উপর দিনের পর দিন শ্লীলতাহানি, যৌনহেনস্থার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। গত শনিবার রাতে গ্রেফতার হয় তৃণমূল নেতা শিবু হাজরা, যে শেখ শাহজাহানের অন্যতম সঙ্গী বলে অভিযোগ। তার আগে গ্রেফতার হয় আরেক অভিযুক্ত উত্তম সর্দার। শিবু ও উত্তমের গ্রেফতারের পর উল্লাসে মেতে উঠেছিল সন্দেশখালি গ্রাম। এদিন সন্দেশখালিতে গিয়ে অভিযুক্ত শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারির দাবি তুলেছেন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। শেখ শাহজাহান অবশ্য এখনও বেপাত্তা। জানুয়ারি মাসের গোড়াতে তার বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। সেই থেকেই নিখোঁজ শেখ শাহাজাহান। এখনও পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তার জন্য অবশ্য রাজ্য সরকারের অনিচ্ছাকেই দুষেছে একটি অংশ।

ইতিমধ্যেই রাজভবনে সন্দেশখালির মহিলাদের জন্য বানানো হয়েছে সেফ হোম। সোমবার থেকেই চালু হয়ে গিয়েছে সেই ব্যবস্থা। দিন কয়েক আগে সন্দেশখালি পরিদর্শনে যান রাজ্যপাল। সেখানে গিয়েই সেফ হোম চালু করার আশ্বাস দিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। প্রাথমিকভাবে রাজভবনের মার্বেল হাউজের পাশে তিনটি ঘরে পিস রুম বা সেফ হোমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্দেশখালির নির্যাতিতা মহিলারা চাইলেই এই সেফহোমে এসে থাকতে পারেন। থাকা-খাওয়া থেকে নিরাপত্তা যাবতীয় ব্যবস্থা করবে রাজভবন। রাজ্যপালের ওএসডি সন্দীপ রাজপুত বলেন, "রাজ্যপালের নির্দেশেই এই সেফ হোমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তিনটি সেফ হোম খোলা হয়েছে। প্রয়োজনের খাতিরে সেফ হোমের সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে। এই সেফ হোম খোলার বিষয়ে রাজ্যপাল নিজেই উদ্যোগী হয়েছেন।"

অনেকেই সন্দেশখালির এই আন্দোলনকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শুধু নারীনির্যাতন নয়, গ্রামের মানুষদের থেকে জোরজাবস্তি জমি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ শাহজাহান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের আগে শাসকদলের বিরুদ্ধে ওঠা এতবড় অভিযোগকে হাতিয়ার করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিরোধীদল বিজেপিও। ওই ঘটনার উপর রাজনৈতিক রং লাগানোর চেষ্টাও কম হচ্ছে না। বিজেপি সাংসদ দিলীপ ঘোষের কথায়, “ওঁরা রাজ্যপালের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছেন। কী পরিস্থিতি এটা? মহিলা কমিশনেরও দায়িত্ব এটা জেনে আসা। তারপর যা রিপোর্ট দেবে সেইমতো এগোবে।” রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে জাতীয় মহিলা কমিশনকে অভিযোগ জানিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সন্দেশখালির অভিযোগকারীর পরিচয় পুলিশ ফাঁস করেছে বলে চিঠি দেন সুকান্ত। তিনি বলেন, “যে মহিলাকে দিয়ে পুলিশ ১৬৪ স্টেটমেন্ট করাচ্ছে, তাঁরই পরিচয় ফাঁস করে দিচ্ছে? এটা তো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অমান্য করা।” যদিও রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার দাবি, জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনের জানা উচিৎ যে এই রাজ্যে মহিলার উপর নির্যাতনের অভিযোগ এলে কতটা তৎপর রাজ্য।

আরও পড়ুন: সন্দেশখালি কি আজকের নন্দীগ্রাম?

সোমবার সন্দেশখালির হালদারপাড়া, পুকুরপাড়া ও লস্করপাড়ার মহিলাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছেন মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স-এ জাতীয় মহিলা কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, সন্দেশখালি থেকে যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে মহিলাদের উপর অত্যাচার হওয়ার ব্যাপারটি প্রকাশ্যে এসেছে। একই সঙ্গে নির্যাতিতাদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারটি দ্রুত খতিয়ে দেখার কথাও বলা হয়েছে মহিলা কমিশনের তরফে। সেই নিরাপত্তা কি মিলবে রাজভবনে তৈরি সেফ হোমে। সেখানেই এনে কি নিরাপত্তা দেওয়া হবে নির্যাতিতাদের? ঘনিয়েছে নানা প্রশ্ন। পাশাপাশি ভোটের ঠিক আগে সন্দেশখালির ঘটনা ঘিরে বেশ বিপাকে পড়েছে শাসকদল তৃণমূল। যদিও শেখ শাহজাহানের দুই সঙ্গীকে গ্রেফতার করে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ারই বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু সত্যিই কি সুবিচার পাবেন সন্দেশখালির মেয়েরা? নাকি সন্দেশখালির অবস্থাও হতে চলেছে কামদুনির মতোই। এমন প্রশ্ন উস্কে উঠেছে নানা মহলেই।

 

More Articles