বাসর রাতেই ফেরার বিদ্রোহী কবি! এ এক অন্য নজরুলের গপ্পো
সালটা ১৮৯৯। চুরুলিয়া গ্রামের আকাশের মুখ সেদিন গম্ভীর। গতরাত থেকে অবিশ্রান্ত ভাবে কেঁদে চলেছে সে, এমনকি সকালেও সে কান্নার বিরাম নেই। এমনই এক বর্ষণমুখর দিনে চুরুলিয়া গ্রামের শেষ প্রান্তে এক কুঁড়েঘরে জন্ম নিলেন দুখু মিঞা ওরফে কাজী নজরুল ইসলাম। বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। জন্মের পর থেকেই সংসার সীমান্তে স্বল্প রোজগেরে বাবা – মায়ের নিত্যদিনের এক অসম লড়াইয়ের স্বাক্ষী ছিলেন একরত্তি নজরুল। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় খুব দ্রুত বদল ঘটছিল মানুষের যাপনে। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল সমাজ অর্থনীতি এবং বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র। সময়ও তার মতো করে গড়েপিটে নিয়েছিল নজরুলকে।
১৯১৭ সালে মাত্র আঠেরো বছর বয়সে নজরুল যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। যে ছেলেটির কলম একদিন ঝড় তুলত, স্থানীয় লেটো দলে,যার গানে মুক্তির কাঙ্খিত আশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল বাংলার প্রায় প্রতিটি মানুষ, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার পর বছর আঠেরোর সেই সদ্য যুবক কলমের বদলে হাতে তুলে নিল বন্দুক। হাজারো সৃষ্টিশীলতার উৎস ছিল যে তরুণ মন, সেই পরিচিত হল, বিশ্বব্যাপী অমানবিকতা আর নৃশংসতার সঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের লেলিহান অগ্নিশিখা তখনও বীরবিক্রমে প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে, বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববাসী পরিচিত হলেন অর্থনৈতিক মহামন্দার সঙ্গে। এই উত্তাল সময়ের আঁচ আরও অনেকের মতোই সেদিন স্পর্শ করেছিল আপাত অখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের সেই যুবককে।
আরও পড়ুন-প্রিয় রবিবাবু থেকে ভানুদাদা, ঠিক কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ ও লেডি রাণুর সম্পর্কের ভিয়েন
তিনি বিদ্রোহী কবি, মুক্তির স্পর্ধিত পংক্তি নব ছন্দে উঠে আসে তার কলমে তিনি কি এই উত্তাল সময় থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে পারেন? জীবনের এই ভাঙাগড়ার খেলাকে পাথেয় করেই পরবর্তীতে সচল হয়ে উঠল নজরুলের কলম। জন্ম নিলো একের পর এক কালজয়ী সাহিত্য। গ্রামের লেটো দল থেকে যে জয়যাত্রার সূচনা হয়েছিল, তা পরিণতি লাভ করল জীবনের মধ্যগগনে এসে। তবে তাঁর সাহিত্যসাধনা নয়, আজ আমরা ইতিহাসের পাতা উল্টে ফিরে যাবো কিংবদন্তি এই সাহিত্যিকের জীবনের প্রায় অনালোচিত একটি অধ্যায়ে।
কুমিল্লা – গোমতী নদী তীরবর্তী বাংলাদেশের এক মহানগর। আর এই কুমিল্লার অন্তর্গত ছোট্ট এক গ্রাম দৌলতপুর। গ্রামের পুরুষরা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কেউ ফলায় ধান কেউ বা পাট। আবার কারও কারও কাছে স্রোতস্বিনী গোমতী হয়ে উঠেছে জীবন – জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। মহিলারা ব্যস্ত তাদের দৈনন্দিন ঘরকন্নার কাজে। নিতান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন। আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বের আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের সঙ্গে কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই গ্রামটির। অথচ অতীতের দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যাবে দৌলতপুরের পায়ে পায়ে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। সেই ইতিহাস একাধারে প্রেমের আবার অন্যদিকে বিরহের।
সালটা ১৯২১। ক্ষীণকায়া গোমতীর তীরে দন্ডায়মান এক বছর তিরিশের যুবক। শেষ বিকেলের নিভে আসা সূর্য আর পাখির কলতান সমগ্র পরিবেশে এক অপার্থিব মাদকতা সৃষ্টি করেছে। বস্তুতপক্ষে সেদিনের সেই মায়াঘেরা বিকেল আর ক্ষীণকায়া গোমতী হয়তো পরবর্তীতে নজরুলের মানসপটে চিরদিনের জন্য উজ্জ্বল হয়ে ছিল। ঘটনাচক্রে বছর তিরিশের নজরুলকে সেদিনই প্রথম দেখেন সৈয়দা খানম। সেদিন তরুণী সৈয়দার চোখের ভাষা বোধহয় পড়তে পেরেছিলেন নজরুল।অর্থাৎ প্রথম দর্শনেই প্রেম, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। এভাবেই শুরু হলো নজরুল আর সৈয়দা খানমের প্রেমের পথচলা।
সৈয়দা ছিলেন রূপে গুনে অতুলনীয়া। বেশ কিছুদিন প্রেমের পর নজরুল বিয়ে করলেন সৈয়দা খানমকে। নজরুল ভালোবেসে তরুণী প্রেমিকার নাম রেখেছিলেন নার্গিস। কিন্তু বিধি বাম – নার্গিস নজরুলকে ঘিরে এতদিন ধরে যে সোনালী স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন নজরুল নিজেই তাকে ছিঁড়ে ফেললেন এক নিমেষে। বাসর রাতেই কোনো এক অজানা কারণে উধাও হয়ে গেলেন বিদ্রোহী কবি, পরবর্তীতে তাঁর খোঁজ মিলল কুমিল্লায়। না অনেক চেষ্টার পরেও জানা যায়নি নজরুলের অন্তর্ধানের কারণটি। কিন্তু এই ঘটনার পরেও নজরুলের জন্য পথ চেয়ে প্রায় পনেরোটি বছর এক অন্তহীন অপেক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছিলেন নার্গিস। কিন্তু না নজরুল আর ফিরে আসেননি।
তবে সমালোচকদের একাংশের মতে নজরুল এক্ষেত্রে একপ্রকার চক্রান্তের স্বীকার হন। কলকাতাতে থাকাকালীনই সৈয়দ খানমের এক আত্মীয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। নজরুল কবি হিসেবে তখনই যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। খানমের সেই আত্মীয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশে আসেন তিনি এবং প্রেমে পড়েন সৈয়দ খানমের। কিন্তু বিয়ের মুহুর্তে নজরুলকে ঘরজামাই থাকার পরামর্শ দেন সৈয়দ খানমের বেশ কিছু আত্মীয়, যা একেবারেই না পসন্দ ছিল বিদ্রোহী কবির। তার সন্দেহ হয় সৈয়দ খানম স্বয়ং এই পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতেন। ফলে তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাসর রাতেই ফেরার হয়ে যান কবি।
নজরুল বিদ্রোহের কবি, মুক্তির কবি। বিদ্রোহের আঁচ, মুক্তির ডাক তার প্রতিটি রন্ধ্রে।হয়তো মুক্তির নিরাপত্তা ভেঙে খানখান হতে পারে সেই ভয়েই ছেড়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেননি সম্ভাব্য জীবনসঙ্গিনীকেও।