বনেদি আভিজাত্যে বিলুপ্তির পথে নীলকণ্ঠ পাখিরা! দশমীর দিনে কেন ওড়ানো হয় এই বিশেষ পাখি?
Durga Puja Neelkantha Pakhi: শোভাবাজার রাজবাড়িতে প্রতিমা বিসর্জনের দিন নীলকণ্ঠ পাখির মূর্তি গড়ে তাকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। নীলকন্ঠ পাখির ছবি এঁকে আকাশে ফানুস উড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো অবশেষে সমাগত। দুর্গাপুজোয় প্রত্যেকবারই আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে যায় উৎসব। একদল তৈরি করে বারোয়ারি দুর্গা। আর বাংলায় দুর্গাপুজো শুরুর সময় থেকেই কলকাতা সহ একাধিক জেলার জমিদার বাড়িতে হয়ে আসছে দুর্গাপুজো। কালের বিচারে দেখলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে প্রত্যেকটাই প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এই সব বনেদি বাড়ির পুজোর রেওয়াজের মধ্যে অন্যতম হল দশমীর দিন দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের সময় আকাশে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া।
নবকুমার ভট্টাচার্য ‘দুর্গা ও দুর্গোৎসব’ গ্রন্থে ‘প্রাচীন কলকাতার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে উল্লেখ করছেন, “১৭.১০.১৮২৯ তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় মন্তব্য করে যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সর্বপ্রথম দুর্গোৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাঁর দৃষ্টান্ত দেখে ব্রিটিশ সরকারের আমলে যারা ধনী হয়েছেন, তাঁরা দেশের অধিপতির সামনে নিজেদের সম্পদ প্রদর্শন করতে আর ভীত নন। ...কলকাতার বাবুরা দুর্গোৎসবে তা অনুকরণ করেছিলেন, বিশেষ করে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পথ অনুসরণ করেই কলকাতা ও জেলার জমিদাররা দুর্গাপুজোর জমকে মন দিয়েছিলেন।”
কেন ওড়ানো হত নীলকণ্ঠ পাখি
বলা হয়ে থাকে, রাবণ বধের আগে এই নীলকণ্ঠ পাখির দর্শন পেয়েছিলেন রামচন্দ্র। আবার অন্য মতে, এই নীলকণ্ঠ পাখিই পথ দেখিয়ে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল রামচন্দ্র ও বানর সেনাদের। হিন্দু পুরাণ মতে, এই পাখি দর্শন তাই খুবই শুভ। এই নীলকণ্ঠ পাখিই জড়িয়ে গিয়েছে বাঙালির অতি প্রিয় দুর্গাপুজোর সঙ্গে। মূলত বনেদি বাড়ির পুজোয় বিসর্জনের দিন আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত নীলকন্ঠ পাখি। বনেদি বাড়িগুলোতে এখনও বিশ্বাস করা হয় নয় দিন মর্ত্যলোকে কাটিয়ে বিজয়া দশমীর দিনে যখন উমা তাঁর চার সন্তানকে নিয়ে কৈলাসে ফেরেন তখন উমার যাত্রার খবর কৈলাসে শিবের কাছে পৌঁছে দেয় এই নীলকণ্ঠ পাখি।
আরও পড়ুন- সাবর্ণদের ৪১৩ বছরের দুর্গাপুজো! পোড়া ল্যাটা মাছের ভোগে আজও অমলিন দুর্গার আরাধনা
উমার যাত্রার সময় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর আরও একটি অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বলা হয় লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ একসঙ্গে শিবের আরাধনা করেন ব্রাক্ষণ হত্যার পাপ থেকে মুক্ত হবেন বলে। সেই সময় নীলকণ্ঠ পাখির রূপ ধারণ করে রাম ও লক্ষ্মণের আরাধনায় সাড়া দিয়ে শিব মর্ত্যে এসেছিলেন।
বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোগুলিতে এই রীতি পালন করতে গিয়ে প্রত্যেক বছরই নির্বিচারে বন্দি করা হত কয়েকশো নীলকণ্ঠ পাখিকে। তারপর বনেদি বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেওয়া হত নীলকণ্ঠদের। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে খাঁচায় বন্দি থাকার ফলে আহত পাখিগুলো ছাড়া পেয়েও বেশি দূর উড়ে যেতে পারত না। কিছুদূর যাওয়ার পরই নীলকন্ঠ পাখিদের আক্রমণ করত কাকের দল। সেই আক্রমণে প্রত্যেক বছরই প্রাণ যেত কয়েকশো নীলকণ্ঠ পাখির।
নীলকণ্ঠ পাখির পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়ান রোলার’ আর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘কোরাসিয়াস বেনঘালেনসিস’। নীলকণ্ঠ পাখি মূলত ঘাস ও ঝোপঝাড়ের বাসিন্দা। আকারে ২৬-২৭ সেমি এই পাখির দেহ, লেজ ও ডানায় রয়েছে উজ্জ্বল নীল বর্ণের উপস্থিতি। ঘাসজমির পোকামাকড় খেয়ে সাধারণ কৃষকদের উপকার করে এই পাখি। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ এই পাখিকে ওড়িশা, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায় ‘স্টেট বার্ড’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো
কলকাতা সহ জেলার প্রায় সকল বনেদি বাড়িতেই দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময়ে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত নীলকণ্ঠ পাখি। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুজো শোভাবাজার রাজবাড়িতে কয়েকশো বছর ধরেই প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত নীলকণ্ঠ পাখি। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে নীলকণ্ঠ পাখির বিলুপ্তির আশঙ্কায় বন দপ্তর এই পাখি ধরা নিষিদ্ধ করে দেয়। তারপর থেকে শোভাবাজার রাজবাড়িতে প্রতিমা বিসর্জনের দিন নীলকণ্ঠ পাখির মূর্তি গড়ে তাকে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। নীলকন্ঠ পাখির ছবি এঁকে আকাশে ফানুস উড়িয়ে দেওয়া হয়।
নীলকণ্ঠকে বাঁচাতে সংরক্ষিত পশু পাখির তালিকার চতুর্থ তফসিলিতে এই পাখিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনও মহালয়ার পর থেকে বিভিন্ন চোরা পথে অনেক বনেদি বাড়িতেই নিয়ে আসা হয় নীলকন্ঠ পাখি। বন দপ্তরের আধিকারিকদের মতে, কঠোরভাবে নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বহু বনেদি বাড়িই আইনের তোয়াক্কা করে না। পুজো চলাকালীন বনেদি বাড়িতে হানা দিয়ে পাখি উদ্ধার করাও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে বন দপ্তরের কাছে। শেষ বেশ কিছু বছর ধরে তাই নীলকণ্ঠ পাখি ধরা আটকাতে মহালয়ার পর থেকেই কলকাতার বড় পাখির বাজারগুলোতে তল্লাশি চালায় বন বিভাগ। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। পুজোর আগে নীলকণ্ঠ পাখির চোরা কারবারে শেষ কয়েক বছরে অনেকটাই ভাটা পরেছে। বন দপ্তরের কঠোর অনুশাসনে তাই দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর এই প্রাচীন রীতি এখন শুধুই ইতিহাস।