ভ্যাকসিনেও আটকাবে না! কোভিডের চোখরাঙানি ফের ফেরাবে অতিমারীর কালো দিন?

জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশনের ফলেই প্রচলিত ভ্যাকসিন আর এই সাব-ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের মতে ভ্যাকসিন ও বুস্টার ডোজ় একমাত্র ভরসা বিপদ থেকে বাঁচার।

ভারতে পাওয়া গেল নোভেল করোনাভাইরাসের (Novel Coronavirus) নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.2.75। ভারতজুড়ে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট (Sub-variant)। ইতিমধ্যেই ভারত-সহ পৃথিবীর দশটি দেশে এই সাব-ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তালিকায় রয়েছে ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনকী, BA.2 ও BA.5 থেকেও বেশি দ্রুত হারে ছড়াতে পারে নতুন BA.2.75 সাব-ভ্যারিয়েন্ট। শুধু তাই নয়,বর্তমানে প্রচলিত কোভিড ভ্যাকসিনগুলিরও সাধ্য নেই, এই সাব-ভ্যারিয়েন্টকে আটকানোর। কারণ সেই ভ্যাকসিনগুলি নেওয়ার ফলে ভাইরাস-প্রতিরোধী যে অ্যান্টিবডিগুলি তৈরি হয়েছে, তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট।

বস্তুত এটি ওমিক্রনের (Omicron) সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.2- এর একটি সাব-লিনিয়েজ (Sub-lineage), যা BA.2 সাব-ভ্যারিয়েন্টেরই জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে তৈরি হয়েছে। BA.2.75 সাব-ভ্যারিয়েন্টটি 'সেনটরাস' (Centaurus) নামেই বেশি পরিচিত।

আরও পড়ুন: এখনও হয়নি যথেষ্ট টিকাকরণ, বিশ্বজুড়ে নখ শানাচ্ছে করোনা! আবার অতিমারী?

এখানে উল্লেখ্য, ওমিক্রন BA.2.75 সাব-ভ্যারিয়েন্টও কিন্তু আদতে BA.2 সাব-ভ্যারিয়েন্টের সাব- লিনিয়েজ।অর্থাৎ, ওমিক্রন BA.2 সাব-ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের ফলেই তৈরি হয়েছে BA.2.75। তবে 'সেনটরাস' নামটি বিজ্ঞানসম্মত নয়, এমনকী, স্বাস্থ্য-আধিকারিদের দেওয়াও নয় এই নাম। এটি নিতান্তই ডাকনাম নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.2.75 -এর। নেহাতই সামাজিক মাধ্যম মারফৎ ছড়িয়েছে নামটি।

তবে নতুন এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.2.75, ওমিক্রনের অন্যান্য সাব-ভ্যারিয়েন্ট যেমন BA.1 কিংবা BA.4/5-এর থেকেও বেশি ক্ষতিকর কি না, তা এখনও জানা যায়নি। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা 'দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট' (The Independent) সূত্রে জানা গেছে, রচেষ্টারের মায়ো ক্লিনিকের (Mayo Clinic) ভাইরাস-বিশারদ (Virologist) ম্যাথিউ বিনিকার জানিয়েছেন, ওমিক্রনের আগের সাব-ভ্যারিয়েন্টগুলির তুলনায় এই সাব-ভ্যারিয়েন্টে অনেক বেশি জেনেটিক মিউটেশন (Mutation) ঘটেছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো স্পাইক প্রোটিন জিন (Spike Protein Gene)। স্পাইক প্রোটিন জিনে পরিবর্তন এলে, আণবিক চরিত্র (Molecular Characteristic) বদলাবে স্পাইক প্রোটিনের। আর তার ফলেই নতুন এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট অনেক ভালোভাবে আমাদের কোশকে আক্রমণ করার ক্ষমতা লাভ করেছে।

এত সংখ্যায় মিউটেশনই বিজ্ঞানীদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যত বেশি মিউটেশন হবে ততই বেশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন দেখা যাবে নোভেল করোনাভাইরাসে। সংক্রামক ব্যাধি-বিশেষজ্ঞ শিশি লিও-র মতে ('দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট' সূত্রে জানা গেছে), BA.2.75 ভ্যারিয়েন্টই প্রমাণ যে, নোভেল করোনাভাইরাস এখনও বিবর্তিত হচ্ছে। তিনি বলছেন, আমরা অতিমারীর পূর্বের অবস্থাতে ফিরতে চাইলেও, আমাদের সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করা ভীষণ জরুরি। তিনি আরও জানাচ্ছেন, আমাদের মেনে নিতে হবে আমরা কিন্তু এখনও আগের থেকেও বিপদের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি।

আর এই জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশনের ফলেই প্রচলিত ভ্যাকসিন আর এই সাব-ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের মতে ভ্যাকসিন ও বুস্টার ডোজ় একমাত্র ভরসা বিপদ থেকে বাঁচার।

ইউরোপের স্বাস্থ্য অধিকর্তারা ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছেন। বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি যাঁরা, তাঁরা তো বটেই, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনো-কম্প্রোমাইজ়ড) যাঁদের কম, তাঁদেরও সত্ত্বর নেওয়া উচিত দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিকর্তারা তারও আগে জানিয়েছেন বুস্টার ডোজে়র প্রয়োজনীয়তার কথা।

অন্যদিকে 'ফিনানশিয়াল টাইমস' (Financial Times) সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শনের কার্যনির্বাহী পরিচালক, মাইক রায়ান জানিয়েছেন, তাঁরা আন্দাজ করছেন চলতি বছরের শেষেই আবার বাড়বে সংক্রমণের সংখ্যা।

অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক পিটার ইংল্যান্ডের মতে, নোভেল করোনাভাইরাস এখনও বহুলভাবে ছড়াচ্ছে। আর সেইভাবে আরওই মিউটেশনের মাধ্যমে তারা শরীরে বিবর্তন আনছে। কিছু কিছু ভ্যারিয়েন্ট রোগ সংক্রমণের ক্ষমতার নিরিখে পুরনো ভ্যারিয়েন্টের থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে। কখনও নতুন ভ্যারিয়েন্টের ফলে রোগের ভয়াবহতাও বাড়ছে। পিটার ইংল্যান্ড আরও জানাচ্ছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে, তা কিন্তু আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার থেকেও কম সময় ধরে স্থায়ী হচ্ছে।

কিন্তু এই ডামাডোলের মাঝেই খুব আশ্চর্য পদক্ষেপ করেছে সরকার- ওমিক্রনের বিরুদ্ধে লড়বে এমন ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগেই, দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ় নেওয়ার দিকে জোর দিচ্ছে সরকার। সেই বুস্টার ডোজ় কিন্তু ওমিক্রনের নতুন এই সাব-ভ্যারিয়েন্টের (BA.2.75) বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়। বর্তমানে কোভিড প্রতিরোধের জন্য যে ভ্যাকসিনগুলি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি কিন্তু নোভেল করোনাভাইরাসের‍ একদম প্রাথমিক স্ট্রেন, যা চিনের ইউহান প্রদেশে পাওয়া গিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তৈরি। তার মাঝে একাধিক ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট মাথাচাড়া দিয়েছে, ছড়িয়ে গিয়েছে পৃথিবীজুড়ে। যদিও এই ভ্যাকসিন একাধিক স্ট্রেনের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম কিছুটা হলেও, কিন্তু পাশাপাশি ভ্যাকসিন থেকে তৈরি হওয়া রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে, তা ভুললে চলবে না।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শনের কার্যনির্বাহী পরিচালক (Executive Director) রায়ান জানাচ্ছেন, রোগ-প্রতিরোধকারী কোশগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধকারী স্মৃতি (বা ইমিউনোলজিক্যাল মেমোরি) ভুলতে শুরু করে। ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তখন আর তারা লড়তে পারে না ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

 

More Articles