বাবা মা'কে হত্যা করেছে নাৎসিরা, ৬৬৪ জন শিশুকে যেভাবে অন্য জীবন দিয়েছেন এই ব্যক্তি

Jewish Refugee Children: উইন্টন জানতেনই না পুরো স্টুডিও জুড়ে যে দর্শকরা বসে আছেন তাঁরা সকলেই সেই শিশু যাদের তিনি জীবন বাঁচিয়েছিলেন

সাল ১৯৩৮। সুইজারল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার কথা, সমস্ত টিকিট, পরিকল্পনা সারা। কী মনে হতে সুইজারল্যান্ডের ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করে দিলেন তরুণ ব্রিটিশ স্টক ব্রোকার নিকোলাস উইন্টন। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চললেন প্রাগে একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। নাৎসিদের কাছ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সেই সময় সাহায্য করছিলেন ওই বন্ধু। বন্ধুর এই কাজ, এই কাজের নেপথ্যে থাকা তাঁর দর্শন গভীরভাবে প্রভাবিত করল নিকোলাসকে। দিন কয়েকের অভিজ্ঞতা জীবন বদলে দিল নিকোলাসের, জীবন বদলে দিল আরও শ'য়ে শ'য়ে মানুষের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ইংল্যান্ডে নিরাপদে ৬৬৯ জন শিশুকে ফিরিয়ে আনেন নিকোলাস উইন্টন, এই শিশুদের অধিকাংশই ছিল ইহুদি। শিশুদের বাবা-মা অনেকেই নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মারা গিয়েছেন। আর মারা যাওয়ার আগে শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যতের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন নিকোলাস উইন্টনকে।

নিকোলাস উইন্টন নিকোলাস ওয়ারথেইমারের জন্ম ১৯০৯ সালের ১৯ মে। নিকোলাসের বাবা মা ছিলেন জার্মান ইহুদিদেরই বংশধর। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে চেকোস্লোভাকিয়ায় ওই বন্ধুর কাছে চলে যান নিকোলাস। বন্ধু মার্টিন ব্লেক তখন ব্রিটিশ কমিটির একজন সহযোগী হিসাবে শরণার্থীদের জন্য কাজ করছেন। এই কমিটি ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে মিউনিখ চুক্তির শর্তাবলীর অধীনে সুডেটেন অঞ্চলের উদ্বাস্তুদের সাহায্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইউরোপীয় যুদ্ধ যে আসন্ন এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে উইন্টন চেকস্লোভাকিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাগে, ব্লেক উইন্টনকে তাঁর সহকর্মী, ডোরিন ওয়ারিনারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ইহুদি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতে ঠাসা শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

মিউনিখের পরে, উইন্টন নিশ্চিত ছিলেন যে জার্মানরা অনেক আগেই বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়ার বাকি অংশ দখল করবে। ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে ক্রিস্টালনাখ্ট দাঙ্গার সময় জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসার কারণে তিনি আরও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তখনই জানতে পারেন কিন্ডারট্রান্সপোর্টে জার্মান এবং অস্ট্রিয়ান ইহুদি শিশুদের উদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের ইহুদি সংস্থাগুলি চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার জেরেই শেষ পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনে প্রায় ১০,০০০ সঙ্গীহীন, পরিবারহীন শিশুদের নিয়ে আসা হয়। উইন্টন ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের উদ্ধারের জন্য একটি ছোট দল গড়েন।

আরও পড়ুন- সিরিয়া থেকে ইউক্রেন – একুশ আসলে শরণার্থীর শতক

উইন্টন একটি শিশু বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চেকোস্লোভাকিয়া থেকে শরণার্থীদের জন্য ব্রিটিশ কমিটির নাম ব্যবহার করে, প্রাথমিকভাবে কোনও অনুমোদন ছাড়াই বাবা মায়ের কাছ থেকে আবেদনপত্র নেওয়া শুরু করেন। প্রাগে একটি অফিসও খোলেন উইন্টন। হাজার হাজার অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উইন্টনের শিশু বিভাগের অফিসের বাইরে লাইন দিতে থাকেন। উইন্টন শিশুদের নিরাপদে অন্যত্র পাঠানোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। শরণার্থী শিশুদের যত্ন নিতে ইচ্ছুক ব্রিটিশ পরিবারগুলিকেও খুঁজে বের করেন। দিনের বেলা স্টক এক্সচেঞ্জের চাকরি আর বাকিটা সময় উদ্ধারের প্রচেষ্টা- এই ছিল উইন্টনের দিনলিপি।

জার্মানরা চেক ভূমি দখলের ঠিক আগের দিন, ১৯৩৯ সালের ১৪ মার্চ উইন্টনের ব্যবস্থাপনায় শিশুদের নিয়ে প্রথম দলটি প্রাগ ছেড়ে রওনা দেয়। জার্মানরা বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়ার চেক প্রদেশে শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর উইন্টন আরও সাতটি পরিবহনের ব্যবস্থা করেন যা প্রাগ থেকে রেলপথে এবং জার্মানি জুড়ে আটলান্টিক উপকূলে, তারপর জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে চলে যায়। লন্ডনের স্টেশনে, ব্রিটিশ পালক বাবা মায়েরা এই বাচ্চাদের নিজেদের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। শিশুদের নিয়ে শেষ ট্রেনটি ১৯৩৯ সালের ২ অগাস্ট প্রাগ ছেড়ে রওনা দেয়। জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে এবং ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্রিটেন জার্মানিতে যুদ্ধ ঘোষণা করলে উদ্ধার কার্য বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন- মন্ত্রীর পরকীয়া ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন খোদ হিটলার! ‘ফেক নিউজের’ জনক গোয়েবলস…

এরপর কেটেছে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর, যুদ্ধ থেমেছে, পৃথিবী অন্য বাঁকে বইতে শুরু করে দিয়েছে। ১৯৮৮ সালে বিবিসির হাতে আসে একটি স্ক্র্যাপবুক। নিকোলাস উইন্টন নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত স্টক ব্রোকারের দেরাজে যত্ন করে রাখা ছিল এই খাতাটি। সেই মোটা খাতাতে শ'য়ে শ'য়ে ইউরোপীয় শিশুর ছবি, নাম এবং তথ্য লেখা। এই সমস্ত শিশুদের ট্রেন ভাড়া দিয়েছিলেন, ভ্রমণের নথি জাল করেছিলেন এবং ইংল্যান্ডে নতুন এক পরিবারের কোলে এই শিশুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন নিকোলাস উইন্টন। অথচ নিজের জীবদ্দশাতে উইন্টন কখনও প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথাও বলেননি। কিন্তু একদিন তাঁর স্ত্রীর হাতে আসে দেরাজে লুকিয়ে রাখা সেই স্ক্র্যাপবুক। নানাভাবে যোগাযোগ করে বিবিসির এক সাংবাদিকের হাতে এই খাতাটি পৌঁছে দেন উইন্টনের স্ত্রী।

সেই সময়ের এক জনপ্রিয় বিবিসি টিভি অনুষ্ঠান, দ্যাটস লাইফ এই স্ক্র্যাপবুক সম্পর্কে এক বিশেষ পর্ব সম্প্রচার করে। সেই অনুষ্ঠানে স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল উইন্টনকেও। কিন্তু উইন্টন তো এসবের প্রায় কিছুই জানেন না, উইন্টন জানতেনই না পুরো স্টুডিও জুড়ে যে দর্শকরা বসে আছেন তাঁরা সকলেই সেই শিশু যাদের তিনি জীবন বাঁচিয়েছিলেন, নতুন জীবন দিয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানের মঞ্চে, বিবিসির উপস্থাপক এসথার র‍্যান্টজেন জিজ্ঞাসা করেন, "আজ রাতে আমাদের শ্রোতাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছেন যিনি নিকোলাস উইন্টনের কাছে আজীবন ঋণী? যদি থাকেন, দয়া করে উঠে দাঁড়াবেন?” উপস্থাপকের কথা শেষ হতেই, সারা স্টুডিও উঠে দাঁড়ায়। এই সমস্ত মানুষ সেই শিশু যাদের কথা নিজের সেই স্ক্র্যাপবুকে লিখে রেখে গিয়েছেন উইন্টন, এরা সকলেই সেই শিশু যাদের নাৎসি অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে নতুন জীবন দিয়েছিলেন তিনি। উইন্টন অবাক চোখে দেখেন, বড় হয়ে ওঠা সেই শিশুদের। তাঁর নিজে হাতে বাঁচানো প্রাণদের। এক ঘর ভর্তি প্রাণ যা উইন্টনের কাছে চিরদিনের ঋণী। উইন্টনের প্রচেষ্টায় মোট কত শিশু যে জীবন পেয়েছে তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে তাঁর সেই খাতা বলে ৬৬৪ জন শিশুকে গ্রেট ব্রিটেনে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। ২০০২ সালে, উইন্টন মানবতার সেবার জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে নাইটহুড সম্মান লাভ করেন।

More Articles