বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা

Kolkata Durgapuja 2022: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই সম্ভবত দুর্গাপুজোয় গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে। স্বদেশী আন্দোলনের ব্যপ্তি বাড়াতে এই উৎসবই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার।

দেবী দুর্গার সামনে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ আর তরবারি খেলার মাধ্যমে সাহস আর শক্তি প্রদর্শন। এই অনুষ্ঠানের নামই বীরাষ্টমী। কালের যাত্রাপথে আজ কার্নিভ্যালের গরিমা, কিন্তু এখনও কলকাতার অনেক পুজোই ভার বহন করছে বৈপ্লবিক ইতিহাসের। এরকমই এক পুজো বাগবাজার।

১৯২৫-এর সেপ্টেম্বর মাস। জেলে বসেই বন্ধুকে চিঠি লেখেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জানান, জেলের মধ্যে থেকেও পুজোর আয়োজনের অনুমতি মিলেছে। সেই সময়ে পুজোকে কেন্দ্র করে লাঠিখেলার মতো প্রদর্শনী চালু হয়। যা আদতে বিপ্লবীদের অনুশীলনেরই অঙ্গ ছিল। সেই প্রথা মেনে আজও বাগবাজারে অষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী পালন হয়। কলকাতার প্রাচীন পুজোগুলোর অন্যতম বাগবাজার। এই পুজোর গায়ে পরতে পরতে লেগে রয়েছে বিপ্লব, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গন্ধ। ইতিহাসের পাতা উল্টালে সবার আগে যে নামটা উঁকি দেয়, তা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যাঁর হাত ধরে এই পুজো একসময়ে হয়ে ওঠে বিপ্লবের ঠিকানা। আজ সময়ের ভিড়ে অনেক প্রথা বিলীন হলেও হারায়নি বীরাষ্টমী। কীভাবে এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়েছিলেন নেতাজি?

বাগবাজার ও নেতাজি

বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো কলকাতার সবচেয়ে পুরনো সর্বজনীন দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে একটি। ১৯১৯ সালে বাগবাজারের বাসিন্দারা প্রথম এই পুজোর আয়োজন করেছিলেন। প্রথমবার পুজো হয়েছিল নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের সংযোগস্থলে সরকার হাউসে। সেই সময় এই পুজোর নাম ছিল ‘নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপূজা’।

১৯৩০ সালে কলকাতা পৌরসংস্থার অল্ডারম্যান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় থেকেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে স্বদেশী আন্দোলনের ধ্যানধারণা। পুজোর নাম বদলে হয় ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও মেলা’। যে দুর্গানগর মাঠে এখন মেলা বসে, সেটি আসলে ছিল কলকাতা পুরসভার রাস্তা-সারাই বিভাগের মেটাল-ইয়ার্ড। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুকে অনুরোধ করেন এখানে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়ার জন্য। সুভাষচন্দ্র অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে দেন পাঁচশো টাকা চাঁদাও। সেই থেকে এইখানেই চলে আসছে বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো।

আরও পড়ুন-‘দুগ্গাপুজোয় শুধু নতুন জুতো হলেই হবে! নতুন সেক্স চাই না?’ পুজোর সোনাগাছির গোপন কথা

১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোর সঙ্গে। এই দুই বছর তিনিই ছিলেন পুজো কমিটির সভাপতি। আসলে তিনি চেয়েছিলেন উৎসবকে হাতিয়ার করে গড়ে উঠুক ঐক্য। আর সেই একতার শক্তিকে আশ্রয় করে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। সুভাষচন্দ্র ছাড়াও সন্তোষ কুমার বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, হরিশঙ্কর পাল প্রমুখ এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একইভাবে নেতাজি স্বাধীনতার ধারণা ছড়াতে আশ্রয় করেছিলেন আর একটা পুজো, যার নাম সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো।

সিমলা ব্যায়াম সমিতি

বিপ্লবী আখড়া থেকে সর্বজনীনের পুজো- সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর সভাপতি ছিলেন নেতাজি। ১৯২৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির কাছে সিমলা অঞ্চলে, বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে সর্বসাধারণের জন্যে দুর্গাপুজো শুরু হয়। সেই সময় বিপ্লবীদের আখড়া হিসেবে ইংরেজ শাসকরা সিমলা ব্যায়াম সমিতির ওপর নজর রাখত। মনে করা হয়, এই পুজোর আগে পর্যন্ত দুর্গাপুজো একশ্রেণির মধ্যেই সামীবদ্ধ থাকত। সিমলার ব্যায়াম সমিতির হাত ধরেই কলকাতায় দুর্গাপুজো সর্বজনীন হয়। ১৯৩০ সালে নেতাজি কলকাতা পুরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরেই সিমলা ব্যায়াম সমিতি সভাষচন্দ্র বসুকে এই পুজো কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করে। নেতাজির উদ্যোগে ও স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোতে প্রতিমাকে তখন দেশীয় খাদি বস্ত্র পরানোর চল শুরু হয়। দেবীর পরণের অলঙ্কার সবই মাটির। অস্ত্র দেশীয় লোহা, তামার। বীরাষ্টমী উৎসব ছাড়াও মণ্ডপে পুতুল খেলা, যাত্রা পালা ও কবিয়াল গানের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হতো।

ঋষি অরবিন্দ ও বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতি ছিল লাঠিখেলা, তলোয়ার চালনা, কুস্তি খেলা প্রভৃতি শেখার প্রধান আখড়া। দেশমাতৃকার আরাধনার উদ্দেশ্য নিয়ে অতীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির উদ্যোগে দুর্গোৎসব শুরু করেন। সারা বছরের শরীর চর্চা আর সাহসিকতার পরীক্ষার দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হতো মহাষ্টমীর দিনটিকে। এই দিনটি তাঁরা বীরাষ্টমী দিবস হিসেবে পালন করতেন।

স্বদেশী আন্দোলন ও দুর্গাপুজো

১৯১৯ সাল। সারা বাংলা জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। কলকাতা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম সবত্রই স্বদেশী ভাবধারায় জেগে উঠছে এক নতুন প্রজন্ম। এখানে সেখানে প্রতিদিন গড়ে উঠছে ছোটখাটো বিপ্লবীদের দল। এমন কয়েকটি বিপ্লবীদের আড্ডায় ঠিক হলো, সবাইকে এক ছাদের তলায় আনতে হবে। তবেই স্বদেশী আন্দোলনে সফলতা আসবে। তার জন্য সেরা উপায় হল দুর্গাপুজো। ঠিক করা হলো, দুর্গাপুজোকে উপলক্ষ্য করে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুবকদের একত্র করা হবে। উৎসবও হবে আর দেবী বন্দনার সঙ্গে সঙ্গে দেশ মাতৃকার বন্দনায় তরুণ প্রজন্মকে জাগরিত করার আয়োজনও চলবে। এর মধ্যেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বারোয়ারি দুর্গোৎসবকে বেছে নিলেন। ১৯২৭ সালে বার্মার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় ফিরে এসে নেতাজি বিভিন্ন সামাজিক এবং সেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সেই সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত হন। দক্ষিণ কলকাতার আদি লেকপল্লীর পুজো, মধ্য কলকাতার ৪৭ পল্লীর পুজো, উত্তর কলকাতার বাগবাজার, কুমারটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি- এই বারোয়ারি পুজোগুলির সঙ্গে নেতাজি বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন।

পলাশির পরাজয়

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে নবাব সিরাজউদৌল্লার পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার শেষ সলতেটুকু নিভে যায়। বাংলার মানুষ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, তারা কী হারিয়েছে। এর মধ্যেই শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেপরোয়া শাসন। কোম্পানিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো বাংলার তৎকালীন কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত জমিদার। সে বছরই পলাশির যুদ্ধ জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য রাজা নবকৃষ্ণদেব কলকাতার শোভাবাজারের বাড়িতে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। লর্ড ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এই উৎসবে যোগ দেন। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে পালিত এই দুর্গাপুজোয় কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তাদের আগমনে তা বিজয় উৎসবে পরিণত হয়। ফলে সেইসময় স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটাতে ব্রিটিশ শাসনের মূলে সজোর ধাক্কার প্রয়োজন ছিল, যার নাম গণ আন্দোলন, বিপ্লব। ফলে ছোট আয়তনে হলেও এখানে ওখানে বিপ্লবীরা দুর্গাপুজোকে আশ্রয় করে শুরু করে দিলেন জাগরণের কাজ। স্বাদেশী ভাবনার জাগরণ।

আরও পড়ুন- মাটিতে পোঁতা ছিল তিন ফুটের দুর্গা! বাগবাজারের হালদার বাড়ির যে ইতিহাস আজও অবাক করে

বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী বিজ্ঞাপন

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই সম্ভবত দুর্গাপুজোয় গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে। স্বদেশী আন্দোলনের ব্যপ্তি বাড়াতে এই উৎসবই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। প্রায় প্রতিটা পুজোর বিজ্ঞাপনেই নজরে আসে ‘নাথিং বিদেশি, এভরিথিং স্বদেশী’ জাতীয় পাঞ্চলাইন। সকলের জন্য এবং সকলকে নিয়ে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ধারণাটিও শুরু হয় এই সময় থেকেই। বলা হয়, উত্তর কলকাতার মানিকতলাতেই প্রথম স্বদেশী ভাবনায় সর্বজনীন দুর্গাপুজোর শুরু, সেই সময় যার ডাকনাম ছিল ‘কংগ্রেস পুজো'। এমনকী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় জেলের মধ্যে থেকেও বিপ্লবীদের অনেকে দুর্গাপুজোর আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন এমন উদাহরণও রয়েছে প্রচুর।

ইতিহাসবিদের মতে, দুর্গার চরিত্র বদলের পিছনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠে'র (১৮৮২ সালে লেখা) ভূমিকা অসামান্য। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসেই দুর্গাকে বা বলা ভালো শক্তির বিভিন্ন মৃণ্ময়ীরূপকে আন্দোলনকারীরা কীভাবে দেশের সঙ্গে একই স্থানে রাখছেন তা স্পষ্ট। উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম' গান বিপ্লবীদের লড়াইয়ের অন্যতম মন্ত্র। বাঙালি-চালিত প্রেসগুলিতে দুর্গা প্রতিমার ছবির উপর বহু দেশাত্মবোধক গান ছাপা হয়।

একসময়ে ক্লাইভকে তুষ্ট করা হোক বা তোষামদের জমিদারিত্ব পাকা করতে টেক্কা দেওয়া, ঝাড়লণ্ঠন আর দামী কারণবারির আয়োজন কোথাও যেন ঘুরেফিরে মিশে যাচ্ছে এইসময়ের থিম-টক্করের সঙ্গে। শাসকের মুখের উপর কখনও সুপারইম্পোজ হতে থাকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের আদল, কখনও বা বর্তমান রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডার রঙ। গল্প আসলে একই। বহুকালের শিকড়ওয়ালা একটা উৎসব, পোশাক বদলে বদলে হয়ে উঠছে কার্নিভ্যাল। কিন্তু এতকিছুর পরেও দুর্গাপুজো আর বিপ্লবের ইতিহাসকে আলাদা করা যায় না। পুজো নিজেই আজ বহু শিল্প এবং শিল্পীর বেঁচে থাকার নেপথ্যের গল্প, তেমনই বিপ্লবের আখ্যানও বটে।

More Articles