মুখে খেটে খাওয়া মানুষের কথা, তবু কেন শূন্য বামেরা?
West Bengal CPIM: ২০০৬ পরবর্তী সিপিআইএম মোটামুটি মধ্যবিত্ত, বড়লোকের দল হয়ে গিয়েছে ধরেই নেওয়া যায়।
এক
কয়েকদিন আগেই লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের যাদবপুর লোকসভার প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য একটি ইউটিউব চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেশ সগর্বে বলছিলেন, "তৃণমূল ছাড়া সিপিআইএমই পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের গোটা রাজ্যের প্রতিটা অঞ্চলে, মহল্লায়, ওয়ার্ডে সংগঠন রয়েছে।"
দুই
সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ছিল দিল্লিতে। সেখানে বাংলার লোকসভার ফলাফল কাঁটাছেড়া করতে গিয়ে উল্লেখ করা হলো, বিজেপি-বিরোধিতার রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে তৃণমূলের জয়ও। সিপিআইএম যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তাতে বাংলায় জেতা তৃণমূলের ২৯টি আসন রয়েছে।
তিন
উপনির্বাচনের ফলাফল বের হলো বৃষ্টিস্নাত বিকেলে। যুবভারতীতে লাল-হলুদ ঝড়, আর বাংলা জুড়ে সবুজ। উপনির্বাচনের চারটি আসনের চারটিতেই তৃণমূলের ক্লিন সুইপ। তিনটি হারা আসন বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। খানিকটা অবধারিতভাবেই বামফ্রন্ট চারটি আসনেই জামানত খোয়াল। কোনও সাংবাদিক সম্মেলন হলো না বামফ্রন্ট, সিপিআইএমের তরফে। ইস্টবেঙ্গলের জয়কে সেলিব্রেট করতে গত লোকসভা নির্বাচনের শ্রীরামপুরের সিপিআইএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর যুবভারতীতে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে লিখলেন, "জয় মা ইস্টবেঙ্গল", যাদবপুরের প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য লিখলেন, "ফুটবলের মহোৎসবে প্রিয় দলের জয়"।
চার
গত জানুয়ারিতে কলকাতার রাজপথ ঢেকে গিয়েছিল লাল পতাকায়। ব্রিগেড মঞ্চ থেকে মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়ের হুঙ্কার, বাংলা জুড়ে ৪৯ দিন ব্যাপী তাদের ইনসাফ যাত্রা নজর কেড়েছিল বহু বামবিরোধী ভোটারেরও। সেদিন ব্রিগেড মঞ্চ সাজবার আগের বিকেলে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মীনাক্ষি বলেছিলেন, 'আমাদের সংগঠন ডিওয়াইএফআই রাজনৈতিক সংগঠন হলেও আমরা নির্বাচনে লড়ি না। নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।" খোঁজ নিলে জানা যায়, ইনসাফ যাত্রা যেদিন শেষ হয় যাদবপুর এইটবি-তে সেদিন আশেপাশের এসএফআই কর্মীদেরও সংগঠনের পক্ষ থেকে যেতে বলা হয়নি সেখানে। কারণ হিসেবে বলা হয় 'ওটা যুব সংগঠনের মঞ্চ' সেখানে ছাত্রদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন- চাকা ঘুরছে? মীনাক্ষি-সৃজন-কলতানদের ব্রিগেড ইনসাফ দেবে রাজ্যকে?
এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আরও একটা লোকসভা নির্বাচন চলে গেল। হাজার হাজার পার্টি সদস্যের রক্ত জল করা পয়সায় পতাকা, পোস্টার, হোডিং, ব্যানার কেনা হলো। বাঁধা হলো মাইক। কলকাতা, যাদবপুর, দমদম থেকে এয়ার কন্ডিশন কামরায় চেপে নেতৃত্বরা গেলেন জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ, ঝাড়গ্রাম, ফারাক্কা। দিলেন বক্তৃতা। ভিড়ের ছবি এল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
গোটা দিন কাঠপালিশের কাজ করে যে মানুষ পাঁচশ টাকা রোজগার করেন, কিংবা মিউনিসিপ্যালিটির ময়লার গাড়ি ঠেলে যিনি মাসিক ৯ হাজার টাকা বেতন থেকে মেয়ের রং পেন্সিল বাদ দিয়ে কার্ল মার্ক্সের জন্মতিথিতে 'ওয়ান ডে' দেন ৩০ টাকা তার কিন্তু রাজ্যে অন্তত একটা আসন জিততে মন চায়। তারা কিন্তু সিপিআইএমের প্রাক্তন রাজ্যে সম্পাদকের মতো করে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে চান না, "শুধুমাত্র কয়েকটা আসন জেতাই কমিউনিস্টদের কাজ নয়"। শনিবারের সন্ধ্যায় সিন্নি প্রসাদটা আদ্যপান্ত বাঙালি হিন্দুর মতো করেই তারা ঘরের বাইরে খান, মঙ্গলবারে নিরামিষ খান বজরংবলিকে স্মরণ করে। বাড়িতে রাজমিস্ত্রি কাজে এলে তাকে আলাদা কাপে চা দেন, বাতিল জলের বোতলে জল খেতে দেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে। উপরে চে গেভারা, নীচে কৃষ্ণের ছবি সাজিয়ে বাঙালি নিজের মতো করে এভাবেই বছরের পর বছর বামপন্থাকে সেলিব্রেট করেছে। স্বয়ং জ্যোতি বসু 'লাল সালাম' বলেননি। 'নমস্কার' বলেছেন। হাতজোড় করে প্রণাম করেছেন, মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলেননি।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ডঃ প্রভাত পট্টনায়ককে একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কী মনে হয়, বাংলায় ৩৪ বছর কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকার পরেও আজ দলের অবস্থা এই জায়গায় কেন?"
উত্তরে প্রভাত পট্টনায়ক জানিয়েছিলেন, "বাঙালি জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাতপাত, বৈষম্য। বাঙালির এলিটিস্ট সমাজ যেভাবে নবজাগরণকে টেনে নিজেদের সাম্যবাদী, মুক্তমনা ইত্যাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করে আদতে তাঁরা তা নয়। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কাজ ছিল এই জাতপাত, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কিন্তু তারা সেটা করেনি। বরং তারাও নবজাগরণকে রোম্যান্টিসাইজ করে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি।"
আজ যখন বিজেপি রাজ্যে এতগুলো আসন পাচ্ছে, মুসলমান ধর্মের বিরুদ্ধে রং চড়ানো সঙ্ঘের নেতাদের কথায় অকৃষ্ট হচ্ছে একটা বিরাট অংশের বাঙালি, তখন টের পাওয়া যাচ্ছে ডঃ প্রভাত পট্টনায়কের কথায় কতটা সত্যতা। এটা বাস্তব সত্য যে কমিউনিস্ট পার্টির এরিয়া কমিটির সদস্যও বাড়ির কাজের লোককে খাটে বসতে দেন না। বাড়িতে সেলসম্যান এলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। এটাই বাঙালির 'ন্যাচরাল চয়েস', এর বাইরে কোনও দলই নয়। তবে বামপন্থী দলগুলিতে এর ব্যতিক্রম রয়েছে, অনস্বীকার্য কিন্তু সার্বিক নয়।
সিপিআইএম-এসএফআইয়ের পোস্টার বয় সৃজন ভট্টাচার্য নিজের ওয়ার্ডে তিন নম্বর। নিজের বুথে জয়ী। রাজ্যে 'মুখ্যমন্ত্রী-মুখ' বলে যে মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়কে শোকেস করা হয়েছিল বামেদের তরফে, তিনিও নিজের বুথেই তিন নম্বর ছিলেন। সেখানে সর্বাধিক ভোট পেয়েছে বিজেপি। কুলটি বিধানসভা কেন্দ্রের ১৩ নম্বর বুথের ভোটার ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়। এখানে তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএম যথাক্রমে ২৩৬, ৩৪৮ ও ৪৬টি ভোট পেয়েছে। দিল্লির রাস্তায় কাঁপিয়ে শ্রীরামপুরে লড়তে এসেছিলেন দীপ্সিতা ধর কিন্তু ভোটের ফলাফল বেরনোর দিন তাঁর কাউন্টিং এজেন্টরা দুপুর ১টার মধ্যেই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছেন। যে দলটা সম্পর্কে লোকমুখে শোনা যেত, 'সিপিএম কলাগাছ দাঁড় করালেও জিতে যাবে', সেই দলের বাংলা থেকে একজনও প্রতিনিধি নেই বিধানসভায়। ওড়িশা, বিহার, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যেও আছে। পশ্চিমবঙ্গে নেই।
আরও পড়ুন- CPI(ML): ৩৫ বছর পর পুনরুত্থান । বাংলায় লাল ফিরবে? যা জানালেন দীপঙ্কর…
তবে কি সিপিআইএম বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরিসরে কোনও কাজই করছে না? তাদের আন্দোলন কি থেমে গিয়েছে?
বোধহয় একথা সত্য নয়। সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টি গোটা বাঙালিকে বামপন্থী ধরে নিয়েছে। আদতে বাঙালি তা হয়নি। একজন বিমান বসু, একজন মুজ্ফফর আহমেদ, একজন মানিক সান্যাল পাড়ায় পাড়ায় জন্মান না, জন্মাননি। পাড়ায় পাড়ায় জন্মেছে বিজয় বোস, দুলাল ব্যানার্জীরা। যাদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে প্রথমে হনুমান এবং পরে কার্ল মার্ক্সকে পাওয়া যেত। যায়। যাবেও।
সেই কোভিড-লকডাউনকালীন সময় থেকে যাদবপুরের কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালাচ্ছে। কুড়ি টাকায় ভরপেট খাবার পাচ্ছেন সিকিউরিটি গার্ড থেকে রিকশা চালক। খারাপ খাবার নয়। মাছ, মাংস, বিরিয়ানি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার দেখুন, এই শ্রমজীবী ক্যান্টিনের বিরাট সাফল্যের কথা কিন্তু গত লোকসভায় আপনি একটিবারও শোনেননি। যাদবপুরের সিপিআইএম প্রার্থী কোনও সাক্ষাৎকারে বলেছেন বলে আমি অন্তত শুনিনি। দলের রাজ্য কমিটির সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে কোনও ভিডিও, পোস্ট ইত্যাদি? না হয়নি।
ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি ক্ষমতায় ফিরেছে। তা নিয়ে ফেসবুক তোলপাড়। ব্রিগেড মঞ্চে গণসঙ্গীত গাওয়া আরাত্রিকা সিংহ জনপ্রিয় টিভি শো-এর ফাইনালে উঠেছে, সেটা নিয়ে ফেসবুকের নীল দেওয়াল লাল করে দিচ্ছেন স্বয়ং দলের একজন 'টিভি চ্যানেল মুখপাত্র'। অথচ নির্বাচনের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ প্রায় ভুলেই গেলেন, গোটা পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বিরোধী দল পরিচালিত তাহেরপুর পৌরসভা তাদের দখলে। শালকু সোরেনের মা-কে ব্রিগেড মঞ্চের ডানদিকে বসিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে অথচ তাহেরপুরে পৌরসভা নির্বাচনে শাসকদলের হুমকি, সন্ত্রাসের চোখে চোখ রেখে যারা লড়লেন এবং জিতলেন তাদের কোনও প্রকার উৎসাহ পর্যন্ত দিলেন না মহম্মদ সেলিম, মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়রা। শুধুমাত্র তাহেরপুর নয়, পঞ্চায়েত নির্বাচন, পৌরসভার অন্যান্য আসন যারা জয়ী হলেন তাঁরা কেউ স্পটলাইটে এলেন না। লোকসভা নির্বাচনে তারা ব্রাত্য থেকে গেল যারা ভীষণ অসময়ে দলকে একটা-দুটো আসন এনে দিয়েছিলেন। কৌটো নাচিয়ে খুচরো পাঠিয়েছিল গণশক্তির দপ্তরে। যাদের নিয়ে ফেসবুকে লেখা হয়েছিল 'আমরা যারা, এই আঁধারেও স্বপ্ন দেখি'। সায়রা শাহ হালিমরা ভোটে লড়লেন, ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দিলেন ইংরেজি টিভি চ্যানেলকে। একদা এসএফআই অধুনা বিজেপিপন্থী সাংবাদিক দুয়ারে পৌঁছে পেল টিআরপি। শ্রীমতি হালিমের জামানত বাজেয়াপ্ত হলো আর আড়ালে রয়ে গেলেন দক্ষিণ কলকাতার ৯২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জেতা কাউন্সিলর মধুছন্দা দেব।
একদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ, অন্যদিকে তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, একটার পর একটা সরকারি প্রকল্প। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আসন জেতা সহজ কাজ নয়। বিহার, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রে এমনকী বিহারেও বিধানসভায় একজন হলেও সিপিআইএমের বিধায়ক রয়েছেন। কেবল বাংলায় নেই! জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার, মানিক সান্যাল, রতনলাল ব্রাহ্মণ, কান্তি গাঙ্গুলি, সরোজ মুখোপাধ্যায়, অনিল বিশ্বাসদের পার্টির একটি আসনেও জয় নেই। লোকসভায় সদস্য নেই। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ১৯৪৬ সালে, বাংলার প্রাদেশিক আইনসভাতেও যাদের তিনটি আসনে জয় ছিল, যে দল বাংলায় ক্ষমতায় এসেই জমির বর্গা আইন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মতো ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, আন্দোলনের ইতিহাসে যাদের শহিদ সদস্যদের নাম রাস্তা, দেওয়াল, বইয়ের পাতায়, তাদের একটা আসনেও জয় নেই।
কারণ অনেকগুলো। অনেক বিশেষণ আছে, বিশ্লেষণও। তবে ২০০৬ পরবর্তী সিপিআইএম মোটামুটি মধ্যবিত্ত, বড়লোকের দল হয়ে গিয়েছে ধরেই নেওয়া যায়। যার শুরুটা দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি, বসু, মিত্ররা আসার পর হয়েছিল, যার শেষটা হচ্ছে আজ। জ্যোতি বসু সিঙ্গুর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "ওখানে কৃষকসভার নেতা কোথায়?" খোঁজটা তখন শুরু হয়েছিল, তারপর থেকে আর খোঁজ মেলেনি কোনও কৃষকসভার নেতার। থাকলেও, তারা কোনওদিন ব্রিগেড মঞ্চে এসে ভাষণ দেননি। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রেস কনফারেন্স রুমে প্রথম সারিতে তাদেরকে দেখা যায়নি। পাওয়া যায়নি জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, সোনারপুর, ব্যান্ডেল, রায়দিঘিতে মঞ্চের উপরে। কলকাতা থেকে যাওয়া দুর্দান্ত বক্তৃতা দেওয়ার প্রধান অতিথির জন্য তাদের বক্তব্য 'শর্ট' করতে বলা হয়েছে। মঞ্চ তারাই কাঁপিয়েছেন যারা ক্যামেরার সামনে দুর্দান্ত কথা বলতে পারেন। যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, জেএনইউয়ের মেধা, বুদ্ধি পড়াশোনার কাছে হেরে যায় কৃষক। শঙ্খ ঘোষের কবিতা দিয়ে শুরু হয় মঞ্চে ভাষণ, শেষ হয় ভগৎ সিংয়ের জেল ডায়েরি দিয়ে। পাড়ার সবচেয়ে কম পড়াশোনা জানা, বখাটে, রকে-চা দোকানে আড্ডা মারা ছেলেটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না প্রেসিডেন্সির রিসার্চ স্কলার। সে হিন্দু হস্টেল নিয়ে স্লোগান দেয় বটে কিন্তু কলেজ স্কোয়ারের পুকুর ধারে যে ছেলেটা পড়াশোনা করতে পারেনি আর্থিক অনটনের কারণে, যে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে পাউরুটি ঘুগনির দোকানে কাজ করে আর রাতে দেশি মদ খায় তার কান অব্দি পৌঁছয় না, "যে শিশু পায়নি দুধ, শুকনো মুখ ক্লান্ত বুক", কিংবা "বোকারাই স্বপ্ন দেখে পৃথিবীটাকে বদলানোর"।
আরও পড়ুন- দুর্নীতি, গণপিটুনি! মমতা বিরোধী হলে কী করতেন? বিজেপি-সিপিএম সব কোথায় গেল?
কমিউনিস্ট পার্টির একদল ফেসবুকীয় সদস্য কৃষকের ফাটা গোড়ালির ছবি দেখিয়ে আবেগ উস্কে দেয় মানুষের কাছে। সেই সব খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষ ব্রিগেডে এলে তাদের নিয়ে ফিল্মি কথাবার্তা বলা হয়। লেখা হয়। পাওয়া যায় গানের লিরিক্স লেখার কাঁচামাল। তারাও মনে মনে লাল ঝান্ডার অগণিত সৈনিক। তারপরেও যাদবপুর, দমদম থেকে যাওয়া 'কমরেড'-রাই বিরিয়ানি খেতে পারেন। গোপীবল্লভপুর, লালগড়, ভেদিয়া, হবিবপুর থেকে আসা দলীয় কর্মীদের কপালে জোটে সোয়াবিনের তরকারি আর মোটা চালের ভাত। তারা কি ব্রিগেড থেকে ফিরে, ভোটের আগে কোথাও গিয়ে ভেবে নেন যে, দলটা আমার ছিল। এই দলটা আমার নেই?
"তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, তারা তো ২ টাকা কেজি চাল দিচ্ছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিচ্ছে। যার থেকে পাচ্ছি তাকেই ভোটটা দিই।"
তাই সোনামণি টুডুর মতো অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিপিআইএম প্রার্থী ভোটে হেরে যান। শুধুমাত্র হেরে যান না, জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। লেখার শুরুতে যে কাঠপালিশের কাজ করা পার্টি সদস্যের বলে কথা বলেছিলাম, সেই মানুষরা পার্টির মিছিলে, মিটিংয়ে হাঁটেন, সভায় যান। যাদের একদিন পারিবারিক ইতিহাস ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহের, এপার বাংলায় এসে কমিউনিস্ট পার্টির লঙ্গরখানায় দিন গুজরানের, তারা আজকাল তৃণমূলকে ঠেকাতে বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে। কেউ কেউ হিন্দুত্বের কথা বলছে পার্টি মিটিং থেকে বাড়ি যাবার সময় অন্য আরেকজন পার্টি সদস্যের সঙ্গে।
মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বললেন, "আমাদের সংগঠনের সঙ্গে নির্বাচনের সরাসরি সম্পর্ক নেই", অথচ সেই সংগঠনের সদস্যরা পাড়ায় পাড়ায় ভোট চাইতে গেল। মীনাক্ষি নিজেই প্রচারে ভাসলেন কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। যাদবপুরের যে সকল এসএফআইয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ইনসাফ সভায় যেতে বারণ করা হয়েছিল, তারাই সৃজন ভট্টাচার্যের জন্য দেওয়াল লিখলেন। পাড়ায়, মহল্লায় সংগঠন করা সদস্য যখন মার খেলেন, হুমকি দেওয়া হলো বাড়ি ঢুকে, তার খোঁজ নিলেন না সোনারপুর নিবাসী দমদমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী। অথচ সেই পাড়া-মহল্লা থেকে কেউ প্রার্থী হলেন না। একজন অনিল বিশ্বাস, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল না, যারা ২৪ ঘণ্টা শুধুই রাজনীতি করবেন, অন্য কিছু নয়। বাঙালি যেমন রাজনীতিবিদ চেয়েছে বরাবর, যেমনটা করে থাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি রাজনীতির বাইরে একটা পা-ও ফেলেন না!
তৃণমূল-বিজেপির ফস্কা গেরোয় আটকে যাচ্ছে লাল ঝান্ডা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সুচারুভাবে বিরোধীদের জায়গায় বসিয়ে দিলেন সেই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সারদা, নারদার ভয়ঙ্কর অভিযোগের মধ্যেও সূর্যকান্ত মিশ্র-অধীর চৌধুরীরা দাঁত ফোটাতে পারলেন না। ফুটতে শুরু করল পদ্মফুল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
তৃণমূল নেত্রী শুধুমাত্র জিতছেনই না, প্রয়োজনমতো বিরোধীদেরকে ব্যবহারও করছেন। বিহারে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর ১২জন বিধায়ক, দুই সাংসদ। কোন ম্যাজিকে? সে ম্যাজিক শিখতে সেলিম, মীনাক্ষি, দেবাঞ্জনদের কি আরও একজন প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসকে খুঁজে আনতে হবে? নাকি বামমনস্ক বাঙালির কাছে নতুন কোনও বামপন্থী দলের উদ্ভব হবে?