ডায়েটকে না বলুন, খান মনের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাতেই কিস্তিমাত বলছে গবেষণা

স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণেই হোক বা সুন্দর হয়ে ওঠার উদ্দ্যেশ্যেই  হোক আমাদের অনেকেরই মধ্যে রোগা হওয়ার প্রবণতা প্রবল ভাবে রয়েছে। রোগা হতেই হবে এই আপ্তবাক্য ধরে নিয়েই  কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে ডায়েট শুরু করে দেন অনেকে। সুন্দরের সংজ্ঞা  অধরাই থেকে গেছে, কিন্তু যেনতেনপ্রকারেণ সুন্দরকে ছোঁয়ার জন্য় সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত পরিসরে কিছু কম মানসিক চাপের স্বীকার হই না। আর সেখান থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, চিরাচরিত পদ্ধতিতে ডায়েট মেনে চললে, ওজন কমে বটে, কিন্তু খুব বেশি বছর তার প্রভাব থাকে না। মানে ধরুন আপনি ক্যালরি মেপে, আপনার পছন্দের সব খাবার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে রোগা হলেন, গবেষণা বলছে তার প্রভাব বেশিদিন থাকছে না। তাহলে উপায়?

গবেষণা বলছে, উপায় একটাই। আর তা হল "মাইন্ডফুল ইটিং" (Mindful eating)। “মাইন্ডফুলনেস” বলতে বোঝায়, বর্তমানে নিজের ঠিক চারপাশে যা যা ঘটছে, সেখানে নিজের মনকে পুরোপুরি উজাড় করে দেওয়া, সেখানেই নিজের মনকে উপস্থিত রাখা, এবং বর্তমানের প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগ করা। “মাইন্ডফুল” ইটিং মানে আপনি যখন যা খাচ্ছেন, আপনার খাবারের প্রতিটি কণাকে উপভোগ করা। তার স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ, তার রূপ এবং ছোঁয়াকে অনুভব করা। শুধু এখানেই শেষ নয়, সেই বিশেষ খাবারটি খাওয়ার সময়ে আপনার কী অনুভূতি হচ্ছে, এবং খাওয়ার পরে আপনার অনুভূতি কী সেগুলোকে পুঙ্খ্নাপুঙ্খ ভাবে নিরীক্ষণ করবেন আপনি নিজেই।

দেখা যাচ্ছে, যারা খুব কঠিন ডায়েট মেনে চলেন, নিজেদেরকে কড়া অনুশাসনে রাখেন খাওয়ার বিষয়ে, তাঁরা কিন্তু খুব বেশিদিন এইসব কঠিন নিয়মে নিজেদের ধরে রাখতে পারেন না। ফলে আজকে নিজেকে সংযত করে বেশি ক্যালরির খাবার না খেলেও, কাল বা পরশু পছন্দের খাওয়ারের প্রতি ঝোঁক আবার বাড়ছে। তাই ওই বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর নিয়মে আবার তাঁরা নিয়ম ভেঙে বেশি ক্যালরির খাওয়ার খেতে শুরু করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও দেখা গেছে ডায়েটের কড়া নিয়মের ফলে হরমোন ক্ষরণে পরিবর্তন আসে, বদল আসে খাদ্য হজমেও। যার ফলে, চিরাচরিত ডায়েটে  খিদে বাড়ে এবং একটা সময় পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে ওঠে।

এদিকে, যে সমস্ত ব্যক্তির ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, অর্থাৎ যারা ওভারওয়েট (Overweight) এবং ওবেস (obese), তাদের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ শতাংশের মানুষ কেবল স্ট্রেস, দুঃশ্চিন্তা বা অবসাদের কারণে খাওয়ার খেতে থাকেন। অথচ এমন নয় যে তাঁরা শারীরিক ভাবে খিদে বোধ করায় খাওয়ার খাচ্ছেন। তাঁরা খাচ্ছেন নিজেদের দুঃশ্চিন্তা, অবসাদ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে।

এই দুই গোষ্ঠীর মানুষই কিন্তু খাওয়ার সময় সেই খাবারের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছেন না বা খাবার খাওয়ার মুহুর্তটাকে পুরোপুরি উপভোগ করছেন না। কেউ কেউ নিয়ম ভাঙার দায়ে অপরাধ বোধে ভুগছেন।আর যেহেতু সেই মুহূর্তকে তাঁরা উপভোগ করছেন না, তাই খেয়ে তাঁদের মন ভরছে না, ফলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই খেয়ে ফেলছেন তাঁরা।  আর খাওয়ার সময়ে নিজেদের অনুভূতিগুলির প্রতি নজর না দেওয়ায়, তাঁরা বুঝতেও পারছেন ঠিক কখন তাদের শারীরিক খিদে মিটে গিয়েছে।

আরও পড়ুন-কয়েক লক্ষ মানুষের টিফিন মানে আজও বাপুজী, ৫০ ছুঁইছুঁই বেকারির যাত্রাপথকে সেলাম

আপনি ডায়েট মেনে চলার ভয়ে হয়তো লুচি-আলুর দম বা লুচি- পাঁঠার মাংস এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, মাইন্ডফুল ইটিং-এ আপনার সে সবের ভয় নেই। আপনি আপনার পছন্দের থালায় লুচি-পাঁঠার মাংস সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসুন। দেখুন ফুলকো লুচি থেকে ধোঁয়াটা তখনও কী ভাবে বেরোচ্ছে, কীরকম গন্ধ আপনি পাচ্ছেন লুচি আর মাংসের গন্ধ মিলিয়ে। ভালো করে দেখুন কী ভাবে মাংসের আপনার পছন্দের টুকরোটা বাদামী বর্ণ ধারন করেছে, কী ভাবে তেল গড়িয়ে পড়ছে তার গা থেকে অল্প-অল্প। তারপর লুচির এক কোণ থেকে একটু লুচি ছিঁড়ে, মাংসের ঝোলে ছুঁয়ে দেখুন আপনি কী অনুভব করলেন। এবার সেই মুহুর্ত যখন আপনার মুখের খুব কাছাকাছি আপনার প্রিয় সেই খাবার। জিভে নিয়ে দেখুন কী ভাবে লুচি আর মাংসের ঝোল এক হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আপনার মুখে।

আপনি এখন কী অনুভব করছেন লক্ষ করুন, দেখুন আপনার মন কতটা তুষ্ট হল, দেখুন আপনার খাওয়ার সাথে সাথে কোনো নির্দিষ্ট স্মৃতি মনের কোনে ভেসে আসছে কি-না। আপনি ক্যালরির বোঝা ভুলে যতক্ষণ খেতে চান, খান। শুধু খাওয়ার আগে আর পরে নিজের খিদেকে এক থেকে দশের মধ্যে কত দেবেন মনে মনে লিখে রাখুন। খেয়াল করুন আপনার কোন মেজাজ অনুযায়ী কী খেতে ইচ্ছে করছে। আপনি কি দুঃশ্চিন্তা ভুলতে খাওয়ার খাচ্ছেন, বা অবসাদ ভুলতে? দুঃশ্চিন্তা আর অবসাদের বেলায় কি খাওয়ার ইচ্ছেগুলো আলাদা আলাদা? আলাদা আলাদা মেজাজে কি আপনি আলাদা-আলাদা পরিমাণ খাওয়ার খাচ্ছেন? খাওয়ার পরে কি আপনার মন ভালো লাগছে আগের থেকে আদৌ? বা খাওয়ার পর আপনার মন তুষ্ট হচ্ছে তো?  যখন আপনি মাইন্ডফুল ইটিং-এ জোর দিচ্ছেন-এই বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে।

মাইন্ডফুল ইটিং-এ কিন্তু দেখা যাচ্ছে নিজের শরীর এবং মন কখন কী চায়, সেই বোধগুলো তৈরি হয়। এখানে আপনি অযথা নিজের শরীর ও মনের ওপর তালিবানি শাসন জারি করেন না। নিয়ম ভাঙলে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আবার পরদিন থেকে মুখ বেজার করে ওট্স খান না ( এবং আবার বিরক্ত হয়ে নিয়ম-ভঙ্গের একই ফাঁসে পড়েন না)। মাইন্ডফুলনেস এবং “মাইন্ডফুল ইটিং কিন্তু আপনাকে নিজের প্রতি ক্ষমাশীলও হতে শেখায়। সুতরাং বুঝতে বাকি থাকে না, কেন এই পদ্ধতি আপনার শরীর ও মনের ভালো থাকার জন্যে জরুরি।

তার থেকেও বড় কথা, কেন এই পদ্ধতি আপনাকে আপনার খাদ্যাভাস এবং শরীর-জনিত মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখবে?  কম্পালসিভ ইটিং (compulsive eating), স্ট্রেস ইটিং  (Stress eating) বা বিন্জ ইটিং ডিসঅর্ডারে (Binge eating disorder) ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মাইন্ডফুল ইটিং বুঝতে সাহায্য করে কখন তাঁরা প্রয়োজনের থেকে বেশি খাচ্ছেন অথবা স্ট্রেস বা অবসাদের সম্মুখীন হয়ে খিদে না থাকা সত্ত্বেও খেয়ে চলেছেন। শুধু তাই নয় দেখা যাচ্ছে “মাইন্ডফুল ইটিং” বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক চাপ, দুঃশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

অন্য দিকে স্ট্রেস বা মানসিক চাপও খাওয়ার ঠিকঠাক হজম না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। আর খাওয়ার হজমে গোলমাল দেখা দিলে, তা অধিকাংশ সময়ে শরীরে ফ্যাট হিসেবে জমা হয়।

স্ট্রেস,উত্তেজনা, রাগ, ভয় এমনকী অবসাদের মত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এইচপিএ অ্যাক্সিস (HPA Axis)। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ এবং পিট্যুইটারি গ্রন্থি, এদিকে কিডনীর উপরে অবস্থিত অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি দিয়ে তৈরি হাইপোথ্যালামাস- পিট্যুইটারি - অ্যাড্রেনাল অ্যাক্সিস (HPA Axis)। দেখা যাচ্ছে খাদ্যপাচনে দায়ী অনেক উৎসেচকের ক্ষরণই নিয়ন্ত্রণ করে হাইপোথ্যালামাস- পিট্যুইটারি - অ্যাড্রেনাল অ্যাক্সিস।

ডায়েটের কড়া অনুশাসন, তার থেকে তৈরি মানসিক চাপ এবং ওজন নিয়ে ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তা করলে অধিক সক্রিয়তা দেখায় এইচপিএ অ্যাক্সিস। যার ফলে খাদ্যনালীতে রক্তপ্রবাহ কমে, হজমের সমস্যা দেখা যায়, গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড বেশি তৈরি হতে থাকে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভেগাস নার্ভাস সিস্টেমের কাজ। ভেগাস নার্ভাস সিস্টেম খাদ্যের পাচনে গুরুত্বওপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; এছাড়াও রক্ত সরবরাহ, হৃদপিন্ডের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে একদম সরাসরি দেখা যাচ্ছে মাইন্ডফুল ইটিং-এ এই উল্টে রক্তপ্রবাহ বাড়ে পাচননালীতে, খাওয়ার ভালোভাবে হজম হওয়ার পাশাপাশি ভেগাস নার্ভ সিস্টেম সঠিক ভাবে কাজ করে। আর খাওয়ার ভালোভাবে হজম হলে, অপাচ্য খাওয়ার দেহে ফ্যাট হিসেবে জমা হওয়ার সম্ভাবনাও কমে।

এখন আপনি ভেবে দেখুন আপনি আপনার খাওয়ারের প্রত্যেকটি কণা শেষ অবধি উপভোগ করে, নিজের শরীর ও মনের গতিবিধি বুঝে ওজন কমাবেন; নাকি চিরাচরিত ডায়েটের কড়া অনুশাসনে থেকে ওজন কমাবেন ।

More Articles