হিংসা মানবে না কিন্তু হরদীপের পক্ষেই ঝুঁকে কানাডা
India Canada Relation : কানাডায় বসবাসী সমস্ত ভারতীয়-হিন্দুদের কানাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল খলিস্তানি সংগঠন শিখ ফর জাস্টিস।
যে আশঙ্কা ছিল, তাই কার্যত সত্য়ি হতে চলেছে। খলিস্তানি-অশান্তিকে কেন্দ্র করে দু'দেশের মধ্যে টানাপোড়েন তো চলছিলই। এর মধ্যে আবার কানাডায় বসবাসকারীদের কাছে গোদের উপর বিষফোঁড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের হুমকি। কানাডারই আরেকটি খলিস্তানি সংগঠন একটি ভিডিও বার্তায় হুমকি দিয়েছে, দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার।
দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার বিরুদ্ধে খলিস্তানিদের মদত দেওয়ার অভিযোগ জানিয়ে আসছে ভারত। তবে এতদিন সেই অভিযোগে তেমন জোর ছিল না। গত জুন মাসে কানাডার একটি গুরুদ্বারের সামনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয় খলিস্তানি টাইগার ফোর্স (কেটিএফ)-এর প্রধান হরদীপ সিং নিজ্জর। সেই হরদীপ যে কিনা ২০২০ সাল থেকে ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার উপর দিক আলো করেছিল। তার নামে ইনাম পর্যন্ত ঘোষণা করেছিল এনআইএ। পঞ্জাবের জালন্ধরে এক পুরোহিত হত্যা-সহ একাধিক বিস্ফোরণ ও সন্ত্রাসমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই হরদীপকে ১৯৯৭ সাল থেকে ছায়া দিয়ে এসেছে কানাডা। ফলে সেই খুনের দায় স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ঘাড়েই চাপিয়েছে কানাডা সরকার। ভারতের সঙ্গে এতদিন ধরে দারুণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে এসেছেন যে প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো, তিনি কার্যত সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নিজের দেশের মাটিতে দেশের নাগরিকের এভাবে হত্যা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। তার দিন কয়েক আগেই, ওই অভিযোগে কানাডার এক ভারতীয় কূটনৈতিককে বরখাস্ত করে কানাডা প্রশাসন। ভারতীয় ওই কূটনৈতিক বেশ হাইপ্রোফাইল বলেই জানা গিয়েছে। আর এমন এক কূটনীতিককে কাঠগড়ায় তোলার ব্যাপারটি মোটেই ভালো চোখে দেখেনি নয়াদিল্লি। এর পরেই কানাডার নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা স্থগিত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভারতের তরফে।
আরও পড়ুন: কানাডার নাগরিকেরা আর এদেশের ভিসা পাবেন না, কেন?
আজ থেকে নয়, কানাডার বিরুদ্ধে খলিস্তানি আন্দোলন মদত দেওয়ার অভিযোগ আজকের নয়। মাস কয়েক আগেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের পুনর্নিমাণ করে রাস্তায় ট্যাবলো বের করে কানাডার একটি খলিস্তানি সংগঠন। যা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বেশ নিন্দা হয়। ভারত তো নিন্দা করেছিল বটেই। তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে বিষয়টি বাড়তে দেয়নি। কিন্তু হরদীপের হত্যা যেন সব দিক থেকে ঢেকে রাখা আগুনে ঘি ঢেলেছে। বিষয়টি নিয়ে উত্তরোত্তর টানাপড়েন বেড়েছে দু-দেশের। আসলে, ভারত থেকে প্রচুর সংখ্যক পড়ুয়া ও নাগরিক কানাডায় যান প্রতিবছর। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও এখন নয়া দুশ্চিন্তার বিষয় কূটনীতিক মহলের। আর সেই দুশ্চিন্তাকে সত্যি করেই এবার কানাডায় বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি ভিডিও বার্তায় হুমকি দিল শিখ ফর জাস্টিস। কানাডায় বসবাসী সমস্ত ভারতীয়-হিন্দুদেক কানাডা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এসএফজে।
আগেই ভারতের তরফে কানাডায় বসবাসকারী সমস্ত ভারতীয়কে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যেই এই ধরনের হুমকিতে সেই ভয় বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। যদিও এই পরিস্থিতিতে সেখানকার ভারতীয় নাগরিকদের পাশেই দাঁড়িয়েছে কানাডা সরকার। ইতিমধ্যেই কানাডার জনসুরক্ষা মন্ত্রী ডমিনিক লেব্ল্যাঙ্ক সেখানকার ভারতীয়দের আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, কানাডার মাটিতে সমস্ত নাগরিকেরা নিরাপদ। হিন্দু কানাডিয়ানদের লক্ষ্য করে যে ভাবে অনলাইনে ঘৃণাপ্রচার করা হচ্ছে, তার নিন্দা করে তিনি জানিয়ে দেন, তাঁর দেশে এইধরনের আগ্রাসন, ঘৃণা বা হুমকির কোনও জায়গা নেই। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কানাডার কাছে তাঁদের মূল্যবোধ সব কিছুর চেয়ে দামি। আশ্বাসের বাণী শোনা গিয়েছে কানাডার আরেক মন্ত্রী হরজিৎ সজ্জনের মুখেও। কানাডায় বসবাসকারী সমস্ত হিন্দু ভারতীয়কে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
তবে সেই গালভরা আশ্বাসে যে তুষ্ট নয় ভারত, তা তো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে নয়াদিল্লির ভিসা-সিদ্ধান্তেই। কারণ যেভাবে হরদীপকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে কানাডা সরকার, তা কার্যত অভাবনীয়। বারবার ভারতের বিদেশমন্ত্রক অভিযোগ জানিয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে খলিস্তানিরা। এমনকী পাকিস্তানের সব খলিস্তানি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কানাডার মাটিতে চলেছে জঙ্গিপ্রশিক্ষণ। হরদীপ ছিলেন সেই প্রশিক্ষণ শিবিরের মাথা। এমনকী ভারতে ফের হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল ওই ব্যক্তির, সে কথাও জানতে পেরেছিল দিল্লি। মুখে না বললেও তলে তলে খলিস্তানিদের মদত দিয়ে এসেছে কানাডা। এবং অজ্ঞাত কারণে খলিস্তানিদের আলাদা ভূখণ্ডের দাবিকে সমর্থনও করে এসেছে ট্রুডোর সরকার।
নব্বই দশকের একেবারে শেষের দিকে ভারত ছেড়ে কানাডায় পালিয়ে যায় হরদীপ। ধর্মীয় নিপীড়িত হিসেবে নিজেকে দাবি করে সে দেশে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছিল সে। শুধু হরদীপ বলে নয়, বহু খলিস্তানি জঙ্গিই সে সময় কানাডা, আমিরিকা ও জার্মানির মতো দেশগুলিতে আশ্রয় চেয়েছিল। জানা যায়, প্রাথমিক ভাবে নাম ভাড়িয়েই কানাডায় প্রবেশ করেছিল হরদীপ। রবি শর্মা নামে এক ব্যক্তির নামে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে কানাডায় ঢুকে পড়ে সে। অবৈধ ভাবে প্রবেশ করেও ধর্মীয় নিপীড়িত হিসেবে নিজেকে দাবি করে কানাডার শরণে আসার চেষ্টা করেন, তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় তার। এবার বিবাহ চুক্তির ফাঁক গলে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করে হরদীপ। সেই মহিলাও রাজি হয়ে যান হরদীপকে বিয়ে করতে। তিনিও কানাডায় এসেছিলেন অন্য একজনের স্পনসরশিপে।
যতবার নাগরিকত্ব পেতে ব্যর্থ হয়েছে, ততবার আরও মরিয়া হয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে হরদীপ। তবে শেষপর্যন্ত আদৌ খাতায় কলমে নাগরিকত্ব পেয়েছিল কিনা সে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রথমে কলের মিস্ত্রি হিসেবে এবং পরবর্তীকালে ট্রাকচালক হিসেবে কাজ করেছে হরদীপ। আরও পরে ফের খলিস্তানি সংগঠনগুলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এবং তার হাতে নানাবিধ সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম সংঘটিত হয়েছে। ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে সে। সব জেনেশুনেও কানাডা সরকার আশ্রয় দিয়ে গিয়েছে হরদীপকে। তার সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মে চুপচাপ মদত দিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: কলের মিস্ত্রির মুখোশে খলিস্তানি জঙ্গি! ভারত-কানাডা সম্পর্কের কাঁটা হরদীপ আসলে কে?
ভারতে একাধিক সন্ত্রাসের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালেই নয়া দিল্লি তার বিরুদ্ধে জারি করেছিল ইন্টারপোল রেড কর্নার নোটিস। ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে এনআইএ কালো তালিকাভুক্ত করে হরদীপকে। ততদিনে খলিস্তানি টাইগার ফোর্সের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেছে সে। যে সংগঠনকে ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ভারত। এই সংগঠনটির জগতার সিং তারা। যাকে থাইল্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এত সব কিছুর মধ্যে একবারই হরদীপের বিরুদ্ধে সামান্য পদক্ষেপ করেছিল কানাডা। ২০১৮ সালে তার নাম 'নো ফ্লাই' তালিকায় ঢোকায় সে দেশের সরকার। ব্যাস ওই টুকুই। ২০২১ সালে রাজনীতিতে ঢুকে কানাডার হোমরাচোমরাদের তালিকায় ঢুকে পড়ে হরদীপ। কার্যত জোরজাবস্তি করেই কানাডার ব্রিটিশ কলোম্বিয়া প্রদেশের সারে এলাকার ওই গুরুদ্বারের প্রেসিডেন্ট হয় সে। আর সেই গুরুদ্বারের সামনেই তাকে গুলি করে পালায় দুষ্কৃতিরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় হরদীপের। যে মৃত্যু ঘিরে প্রায় কিনারায় পৌঁছেছে দু-দেশের সম্পর্ক। বিপাকে পড়েছেন কানাডায় বসবাসকারী হাজার হাজার ভারতীয়। একদিকে যেমন নীতির কথা বলছে কানাডা, যে ভাবে কানাডার ভারতীয় হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, ঠিক তেমন ভাবে নিহত খলিস্তানি জঙ্গি হরদীপের মাথার উপর থেকে যে আশীর্বাদি হাত তুলে নিচ্ছে না ট্রুডোর দেশ, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ভালো মতোই।