সমপ্রেমে সমস্যা নেই, সমকামের বিয়েতে কেন 'না' সুপ্রিম আদালতের?

Same Sex Marriage Supreme Court Verdict : আদালত স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এই রায়ের মানে এই নয় যে ক্যুইয়ার ব্যক্তিরা প্রেম বা যৌনতার সম্পর্কে যেতে পারবেন না।

সারা দেশের একটা বড় অংশই তাকিয়ে ছিল আদালতের দিকে। তাকিয়ে ছিল স্বীকৃতির লক্ষ্যে, তাকিয়েছিল সমানাধিকারের লক্ষ্যে। প্রেমের একটি প্রকাশ বিয়ে, অন্তত অনেকেই তা মনে করেন ও গুরুত্ব দেন। তবে তা হতে হবে বিপরীত যৌন পরিচয়ের মানুষের মধ্যেই। সমকামী মানুষ প্রেম ও বিয়ের দিকে এগোলেই ত্রাহি ত্রাহি রব। প্রশ্ন উঠবে, এই যে সিনেমা-সিরিজে এবং বাস্তবেও এত এত সমকামী বিবাহ দেখানো হচ্ছে, সমকামে বিয়ে হচ্ছে, তাহলে অসুবিধা কোথায়? আসলে বিয়ে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। কেউ অনুষ্ঠান করে বিয়ে করতেই পারেন, কিন্তু বৈধ কাগজ না থাকলে মান্যতা পাওয়া যায় না। এই দেশে সমপ্রেমে বিবাহ যে সম্ভব নয় তাই আবারও জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। ৩:২ রায়ে, ভারতে সমকামী বিবাহের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে শীর্ষ আদালত। ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ এই বিষয়টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচজন বিচারকই সম্মত হয়েছেন, সমকামী দম্পতিদের বিয়ে করার কোনও মৌলিক অধিকার নেই।

সংবিধান কেন একথা বলছে, তা খানিক আলোচনা সাপেক্ষ। সমকামকে বা সমপ্রেমকে অস্বীকার করেনি আদালত, আদালত বরং জানিয়েছে নিজের ইচ্ছেমতো সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার সকলের আছে। যে আদালত একথা বলে, সে আদালতই তাহলে কেন সমকামীদের বিয়ে করার অধিকার দিচ্ছে না? আইনের জটিলতায় পড়ে রয়েছে এই বিষয়টি। ওই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কৌল, এস রবীন্দ্র ভাট, পি এস নরসিমা এবং হিমা কোহলি। আদালতের এই বেঞ্চ বলছে, আইনসভাকে সমকামী বিবাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরাসরি আদালতের কিছু করার নেই। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলছেন, সর্বোচ্চ আদালত বিশেষ বিবাহ আইনের বিধানগুলি নিয়ে কিছু করতে পারে না। সংসদের উচিত এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তিনি ক্যুইয়ার কমিউনিটির প্রতি বৈষম্য রোধ করার জন্য কেন্দ্র এবং পুলিশ বাহিনীর জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকাও জারি করেন। প্রধান বিচারপতির রায়ের পরে, বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কৌলও সমকামীদের হয়ে সওয়াল করা সংগঠনগুলির পাশেই দাঁড়ান।

আরও পড়ুন- সমকামিতা এখনও কেন স্বাভাবিক হয়ে উঠল না সমাজের চোখে?

এই বিষয়ে তর্ক শুরু হয়েছিল ১৮ এপ্রিল। আবেদনকারীদের একাংশ সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেন যে, শীর্ষ আদালত যেন তার ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজকে এই ধরনের সম্পর্ক বা সম্প্রদায়কে স্বীকার করার জন্য চাপ দিতে পারে। যাতে LGBTQIA+ গোষ্ঠী আর সকলের মতোই মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে, বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কৌল, এস রবীন্দ্র ভাট, হিমা কোহলি এবং পিএস নরসিমহার সমন্বয়ে গঠিত একটি পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ১৮ এপ্রিল, ২০২৩ এই আবেদনের শুনানি শুরু করেছিল৷ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৭ অক্টোবর চারটি রায় ঘোষণা করে৷ বিচারকদের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে দ্বিমত ছিল তা স্পষ্ট। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর রায়ে বলেছেন, আদালত 'প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার' কারণে বিশেষ বিবাহ আইনের বিধানগুলিকে বদলাতে পারে না কারণ এটি সংসদ এবং আইনসভার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে।

তবে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলছেন, কেন্দ্র সরকারকে ক্যুইয়ার ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা এবং অধিকার নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে হবে। তাঁর রায়ে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন যে, যে সমস্ত রূপান্তরকামী মানুষ বিষমকামী সম্পর্কে রয়েছেন, তাঁদের কিন্তু ব্যক্তিগত আইন সহ বর্তমান আইনের অধীনে বিয়ে করার অধিকার রয়েছে। তিনি এও জানাচ্ছেন, ক্যুইয়ার দম্পতি সহ অবিবাহিত দম্পতিরা যৌথভাবে সন্তান দত্তক নিতে পারেন। সেই প্রেক্ষাপটেই চন্দ্রচূড় জানান, CARA রেগুলেশনের ৫(৩) রেগুলেশনে অবিবাহিত এবং ক্যুইয়ার দম্পতিদের সন্তান দত্তক নেওয়া নিষিদ্ধ, কিন্তু তা আসলে সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করছে। বিচারপতি এস কে কৌল জানাচ্ছেন, বিশেষ বিবাহ আইনটিও বৈষম্যমূলক, তা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে লঙ্ঘন করছে। এত কিছু সত্ত্বেও বিশেষ বিবাহ আইনে সমকামীদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে আদালতের হাত-পা বাঁধা কারণ এই বিষয়ে একমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংসদ। আদালত আইন করতে পারে না। আদালত কেবল আইনের ব্যাখ্যা করতে পারে এবং আইনকে কার্যকর করতে পারে। ফলে বিবাহের আইন বদলানো যাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সংসদের উপরই নির্ভর করতে হবে। শীর্ষ আদালত অবশ্য স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এই রায়ের মানে এই নয় যে ক্যুইয়ার ব্যক্তিরা প্রেমের বা যৌনতার সম্পর্কে যেতে পারবেন না। সেই অধিকার সকলের আছে।

 

আরও পড়ুন- সমকামিতা, উভকামিতার ইঙ্গিত ছিল গানেই, দেশের প্রথম ‘ক্যুইয়ার’ আইকন ছিলেন ফাল্গুনী পাঠক

সমকামীদের বিয়ের স্বীকৃতি চেয়ে আন্দোলন আজকের নয়। সমকামী দম্পতি, রূপান্তরকামী এবং LGBTQIA+ অ্যাক্টিভিস্টদের দায়ের করা ২০ টি পিটিশন জমা পড়ে আদালতে। এই পিটিশনগুলি সম্মিলিতভাবে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪, হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৫ এবং ফরেন ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর বিধানগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা দাবি করেন যে, এই আইনগুলি নন-হেটেরোসেক্সুয়াল বিবাহকে স্বীকৃতি দেয় না, এই আইনগুলি LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যকেই তোল্লাই দেয়। শুনানির সময়, আদালতের বেঞ্চ স্পষ্ট করে জানায় যে এই চ্যালেঞ্জটিকে শুধুমাত্র বিশেষ বিবাহ আইনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ব্যক্তিগত আইনের সঙ্গে এর যোগ নেই। একইভাবে, হিন্দু বিবাহ আইনের সঙ্গেও এর যোগ নেই।

শুনানির সময় কেন্দ্র সরকার, বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতি ছাড়াই সমকামী এবং ক্যুইয়ার দম্পতিদের নির্দিষ্ট আইনি অধিকার দেওয়া যেতে পারে কিনা তা দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে ইচ্ছুক ছিল। অর্থাৎ সরকার সমকামী এবং ক্যুইয়ার দম্পতিদের জনকল্যাণমূলক নানা সুবিধা- যেমন যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি, জীবনসঙ্গীর নামে জীবন বীমা পলিসি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ইত্যাদিতে মনোনীত সঙ্গীকে জোড়ার বিধি বলবৎ করা যায় কিনা তা দেখতে চায়।

বরিষ্ঠ আইনজীবী মুকুল রোহাতগি, ডঃ অভিষেক মনু সিংভি, রাজু রামচন্দ্রন কেভি বিশ্বনাথন, ডঃ মেনকা গুরুস্বামী, জয়না কোঠারি, সৌরভ কিরপাল, আনন্দ গ্রোভার, গীতা লুথরা, অরুন্ধতী কাটজু, বৃন্দা গ্রোভার, করুণা শ্রীনাথ, প্রমুখরা আবেদনকারীদের হয়ে লড়েন। ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা কেন্দ্র সরকারের পক্ষে লড়েন। রাকেশ দ্বিবেদী, কপিল সিবাল এবং অরবিন্দ দাতারের মতো বরিষ্ঠ আইনজীবীরা কিন্তু এই পিটিশনের বিরোধিতা করেছিলেন।

More Articles