নতুন ধাঁধার খেলা 'ক্লিক কেমিস্ট্রি'! রোগ নির্ণয়ে কীভাবে বাজিমাত করবে নোবেলজয়ী এই আবিষ্কার?
Click Chemistry: কোশটির আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় সেটিকে প্রাণীদেহে মার্কার বা রিপোর্টার কোশ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
জিগ্স-পাজ়ল খেলাটির কথা মনে আছে? অল্প বয়সে হয়তো অনেকেই খেলেছেন। কাগজের ছোট ছোট টুকরো, যা সাজিয়ে জুড়ে দিলেই তৈরি হয়ে যায় সুন্দর এক দৃশ্য। পাজ়লের কথা না হয় বাদই রাখলাম। ছোটদের আরেক ধরনের খেলনা থাকে যাকে বিল্ডিং ব্লকস বলা হয়। সেখানে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের ছোট ছোট ব্লক বা খণ্ড থাকে। সেই ব্লকগুলি একে অপরের সঙ্গে জুড়ে একটি খেলনা বাড়ি বা খেলনা গাড়ি অনায়াসেই তৈরি করে ফেলা যায়। পৃথিবীর তাবড় রসায়নবিদরা যদি বছরের পর বছর তাঁদের গবেষণাগারে এমন খেলাই খেলেন! নাহ, ঘনাদার মতো বিজ্ঞান নিয়ে গুল দেওয়ার দুঃসাহসিকতা করছি না। প্রকৃতপক্ষেই, রসায়নের জগতে বিজ্ঞানীরা ভিন্নধর্মী রাসায়নিক ব্লক গুলিকে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টাই চালাচ্ছেন গত দু’দশক ধরে।
নব্বইয়ের দশকে আমেরিকান বৈজ্ঞানিক কার্ল ব্যারি শার্পলেস (Karl Barry Sharpless) সর্বপ্রথম এই পদ্ধতির ধারণা দেন এবং একে ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ নামে অ্যাখায়িত করেন। আক্ষরিক অর্থেই দুই বা ততোধিক অণু একে অপরের সঙ্গে ক্লিক করে এই পদ্ধতিতে, তাই এটি সার্থকনামা। বিষয়টি বোঝার সুবিধার্থে ধরে নেওয়া যাক, দু’টি ভিন্ন ধারার জৈব-আণবিক ব্লক যা প্রচলিত কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একে অপরের সঙ্গে জোড়া লাগে না বা তার কিয়দংশ জুড়ে গেলেও সেই বিক্রিয়ার হার একেবারেই নগণ্য। সেক্ষেত্রে তৃতীয় একটি অণু বা আয়নকে সংযোগকারী সুতো হিসেবে ব্যবহার করে আণবিক ব্লক দু’টিকে সহজেই একে অপরের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া সম্ভব। ফলত, নতুন ধরনের জটিল ও বৃহৎ আকৃতির অণু নির্মাণ করাও সম্ভব। তাই ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ আদতে বৃহৎ জৈব-রাসায়নিক অণু নির্মাণকারী এক ‘ইঞ্জিনিয়ারিং টুল’।
বিজ্ঞানী শার্পলেস ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও জোড়া দেওয়ার জন্য উপযুক্ত জৈব-আণবিক ব্লক বা দড়ির সন্ধান সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০০২ সালে ড্যানিশ রসায়নবিদ মর্টেন পিটার মেলডাল (Morten Peter Meldal) ও তাঁর সহকর্মীরা এই সমস্যার সমাধান করলেন। উদ্ভাবিত হল অন্যতম প্রধান ক্লিক প্রক্রিয়া- ‘কপার ক্যাটালাইজড অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লো এডিশন (CuAAC : copper catalyzed azide-alkyne cycloaddition)।
আরও পড়ুন- বারবার নিজের স্মৃতির ময়নাতদন্ত, নোবেল জয়ী অ্যানি এরনোঁর সাহিত্য যে কারণে জনপ্রিয়
এই সাইক্লো এডিশন পদ্ধতি ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ শাখার সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন। অ্যাজাইড এবং অ্যালকাইন এই দুই ধরনের জৈব যৌগের সাধারণভাবে বিক্রিয়ার হার অতি নগণ্য। বিক্রিয়ায় অবাঞ্ছিত বাই-প্রোডাক্টও তৈরি হয়। রসায়নবিদ মেলডাল তাঁর গবেষণায় দেখান, অ্যাজাইড এবং অ্যালকাইনের মিশ্রণে একটি মাত্র কপার আয়ন যোগ করলেই অ্যাজাইড ও অ্যালকাইন জুড়ে ট্রায়াজোল নামক একটি স্থায়ী যৌগ তৈরি হয় এবং বিক্রিয়ার হারও দ্রুত হয়। এভাবেই জৈব রসায়নের শাখায় ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ নিয়ে গবেষণা করার এবং বিভিন্ন অবিক্রিয়াকারী যৌগকে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে আরও জটিল ধরনের যৌগ তৈরি করার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’-র একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অসংখ্য জৈব যৌগের একটি মিশ্র মাধ্যমে নির্দিষ্ট দু’টি যৌগের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি অভিমুখে ক্লিকিং করা সম্ভব। ঠিক যেন মেলার ভিড়ে শুধুমাত্র পরিচিত বন্ধুকে খুঁজে নিয়ে আড্ডায় জমে যাওয়া। আরও মজার বিষয় হলো, একটি মিশ্র জৈব যৌগের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দু’টি যৌগের মধ্যে ক্লিক করা, ওই মাধ্যমের অন্য কোনও যৌগ বা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয় না, এমনকী তাদেরকেও প্রভাবিত করে না। এই সুবিধার ফলে জীবন্ত প্রাণী কোশ যা কিনা সবচেয়ে জটিল জৈব মাধ্যম সেখানেও রাসায়নিক ক্লিক করা সম্ভব হয়েছে। আর এই কাজের সূত্রপাত ঘটে আরেক মার্কিন বৈজ্ঞানিক ক্যারোলিন রুথ বার্তোজ়ির (Carolyn Ruth Bertozzi) গবেষণাগারে। ২০০৩ সালে তিনি জৈবরসায়ন শাস্ত্রের এই নতুন ধারার নামকরণ করলেন ‘বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রি (Bioorthogonal Chemistry)’। যেহেতু, মাত্রাতিরিক্ত কপার জীবিত কোশের পক্ষে ক্ষতিকর তাই পূর্ববর্তী কপার ক্যাটালাইজড বিক্রিয়া পদ্ধতিটির পরিবর্তে ক্যারোলিন বার্তোজ়ি কপার মুক্ত ক্লিক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন।
তিনি প্রথমেই জীবিত কোষের উপরের স্তরে থাকা গ্লাইকেন নামক একটি জটিল সুগার স্ট্রাকচার কে চিহ্নিত করলেন। তারপর কোশের মধ্যে যোগ করলেন অ্যাজাইড যৌগ। কোশযন্ত্র অ্যাজাইড যৌগকে সহজেই গ্রহণ করে তাকে গ্লাইকেনের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এরপর, ওই কোশটিতে স্ট্রেইন্ড অ্যালকাইন যোগ করলেন। স্ট্রেইন্ড অ্যালকাইন অন্য কোনও মেটাল আয়নের সাহায্য ব্যতিরেকে অ্যাজাইডের সঙ্গে জুড়ে তৈরি করল ট্রায়াজোল। এই ট্রায়াজোল দ্বারা লেবেল করা কোশটি এক ধরনের সবুজ আলো বিকিরণ করতে পারে। এই আলো বিকিরণ করার ক্ষমতার জন্যই এই ধরনের লেবেলড কোশের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও সম্ভব হয়েছে কোশের গতিপ্রকৃতি বোঝা। এহেন উদ্ভাবন রসায়নবিদ্যা ও জৈব আণবিক বিদ্যার জগতে অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি করে।
এমন কাজে নোবেল ঠেকায় কে? ঠিক তাই। এমন অভিনব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিন বিজ্ঞানী- ক্যারোলিন বার্তোজ়ি, মর্টেন মেলডাল ও ব্যারি শার্পলেস যৌথভাবে এবছর, ২০২২-এ রসায়ন বিভাগে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ ও ‘বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রি’র সামগ্রিক উন্নতিকল্পে ‘দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ এই পুরস্কার প্রদান করেছে। এঁদের মধ্যে ব্যারি শার্পলেস ২০০১ সালে রসায়নশাস্ত্রে অন্য একটি গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- বিবর্তনের টাইমমেশিন আবিষ্কার! চিকিৎসায় নোবেলজয়ী প্যাবোর গবেষণা বদলে দেবে ইতিহাস
‘বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রি’র সবথেকে বেশি গুরুত্ব আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায়। প্রাণী কোশে জৈব-আণবিক ক্লিকিংয়ের ফলে কোশটির আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় সেটিকে প্রাণীদেহে মার্কার বা রিপোর্টার কোশ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ, কোশটি তার গতিপ্রকৃতি, চালচলন এবং তার ভেতরে ঘটে চলা জৈবরাসায়নিক পরিবর্তনের হাল হকিকত জানাতে পার। সেই কারণেই একটি রোগাক্রান্ত কোশকে ক্লিক পদ্ধতিতে মার্ক করা গেলে সেই কোশের যাবতীয় তথ্য আমরা মুহূর্তের মধ্যে জেনে নিতে পারি। আর তারই ব্যবহারিক সুবিধাকে কাজে লাগানো হচ্ছে মানবদেহে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে। সেই রোগের টার্গেটেড ওষুধ তৈরি এবং তার প্রয়োগও সম্ভব হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। এছাড়াও আলো বিকিরণকারী যৌগ ক্লিক প্রক্রিয়ায় লেবেল হিসেব যুক্ত করে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা সহজ হয়েছে। মানব দেহ ছাড়াও, জৈব রসায়নের অন্যান্য ক্ষেত্রে (যেমন- পলিমার সায়েন্স এবং ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স) জটিল এবং কার্যকরী পদার্থ তৈরি করার জন্য ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ ভীষণভাবে উপযোগী।
নোবেল প্রাপক বিজ্ঞানী ক্যারোলিন বার্তোজ়ির মতামত অনুযায়ী, এই নতুন ধরনের জৈবআণবিক টুল ব্যবহার করে মানব শরীরের জৈবরাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার অনেক অজানা তথ্য খুঁজে বের করা সম্ভব হবে আগামী দিনে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বার্তোজ়ি তাঁর তৈরি পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্যও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তবে, এই নতুন ধারার ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ তথা ‘বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রি’-র পরিসর এখনও ক্ষুদ্র ও সীমিত। নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতি এই ধরনের গবেষণায় নতুন গতি সঞ্চার করবে এমনটাই আশা বিজ্ঞানীমহলের।