নতুন বাংলাদেশ চলুক ছাত্রদের চেতনাতেই, দেশে ফিরে বার্তা নোবেলজয়ী ইউনূসের
Muhammad Yunus: বৃহস্পতিবারই শপথ নেওয়ার কথা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। তার আগে এদিন দুপুরে ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরলেন নোবেলজয়ী ইউনূস।
সংস্কার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ বৃহত্তর রূপ নিতে নিতে গণঅভ্যুত্থানের চেহারা নিয়েছে বাংলাদেশে। যা টলিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার গদি। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। সেই সময় দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ার কথা ঘোষণা করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মঞ্চের তরফে দাবি ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হওয়া চাই গণতান্ত্রিক। আর সেই সরকারের মুখ হিসেবে নোবেলজয়ী শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ ইউনূসকেই বেছে নিয়েছেন পড়ুয়ারা।
বৃহস্পতিবারই শপথ নেওয়ার কথা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। তার আগে এদিন স্থানীয় সময় দুপুর ২টো ১০ মিনিটে ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরলেন নোবেলজয়ী ইউনূস। বৃহস্পতিবার ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছন তিনি। বিমানবন্দরে ইউনুসকে স্বাগত জানান তিন বাহিনীর প্রধান। ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং আরও অনেকে। এ ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা।
আরও পড়ুন: হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
এদিন দেশে ফিরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খোলেন ইউনূস। সে সময় তাঁকে ঘিরে ছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। পুষ্পস্তবক গ্রহণ করার পর পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে ছবিও তোলেন তিনি। তার পরেই দেশবাসীর উদ্দেশে ছোট্ট করে একটি বার্তা রাখলেন ইউনুস। যেখানে বারবার উঠে এল লড়াকু পড়ুয়াদের কথা, বাংলাদেশের নতুন এই স্বাধীনতা অর্জনের কথা। বাদ গেল না দেশের শান্তিশৃঙ্খলার প্রসঙ্গও।
২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেন ইউনূস। তাঁকে ওই সম্মান দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর তৈরি মাইক্রোফিন্যান্স ব্যাঙ্কের জন্য। ওই ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে ইউনূস বাংলাদেশের লক্ষাধিক দরিদ্র মানুষকে দারিদ্রসীমা থেকে টেনে তুলেছেন বলে মনে করেছিল নোবেল কমিটি। যদিও তাঁর নিজের দেশের সরকারের ভিন্নমত ছিল। প্রকাশ্যেই ইউসুফের সমালোচনা করতে দেখা যেত হাসিনাকে। ইউনূসের সংস্থা গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে দেশের শ্রম আইন ভাঙারও অভিযোগ ওঠে। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী যে কোনও সংস্থায় কর্মীদের কল্যাণমূলক তহবিল তৈরি করতে হয়। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমে ওই তহবিলের ব্যবস্থা ছিল না। বাংলাদেশের শ্রম আইন ভাঙার অভিযোগে গত জানুয়ারি মাসে অর্থনীতিবিদকে ছ’মাসের জেলের সাজাও শুনিয়েছিল ঢাকার আদালত।
এদিন পড়ুয়াদের পাশে নিয়ে ইউনূস জানান, "আজকে আমাদের গৌরবের দিন, যে বিপ্লবের মাধ্য়মে বাংলাদেশ আজকে নতুন বিজয়দিবস সৃষ্টি করল, তাকে আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এটা সম্ভব করেছে যে তরুণ সমাজ, আমি তাঁদের প্রতি আমার সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাঁরা আমার পাশে আছে। এরা দেশকে রক্ষা করেছে, দেশকে নতুন ভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছে। এই পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সেই বাংলাদেশ যেন অতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ।
একই সঙ্গে কথা বলতে বলতে উঠে আসে আন্দোলনে প্রাণ হারানো পড়ুয়া আবু সইদের কথা। কার্যত তাঁর কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে প্রবীণ এই নোবেলজয়ীর। তিনি বলেন, "আবু সইদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে, যে ছবি কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পর থেকে কোনও যুবক, কোনও যুবতী হার মানেনি। তাঁরা এগিয়ে গেছে।" ইউনূস জানান, আবু সইদের কারণেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় বার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আর এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই তাঁদের কাজ। শুধু তা-ই নয়, এই স্বাধীনতার সুফল যাতে দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এই স্বাধীনতার কোনও দাম নেই। মানুষ যেন জানে, এই স্বাধীনতার অর্থ হল ব্যক্তির পরিবর্তন।
পাশাপাশি দেশ শাসনে তরুণ প্রজন্মের উপর ভরসা রাখার কথাই উঠে এসেছে তাঁর কথা থেকে। তিনি মনে করেনএই দেশ তরুণ সমাজের হাতে। একে মনের মতো করে গড়ে তুলবে তাঁরাই। একই সঙ্গে তাঁর মত, পুরনো চিন্তা দিয়ে মুক্তি সম্ভব নয়। তরুণদের মধ্য়ে যে সৃজনশীলতা রয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। তাঁরা এই স্বাধীনতা অর্জন করে এনেছে। সরকার যে কোনও রকম দমনপীড়নের যন্ত্র, সেই আস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে মানুষকে, এমনটাই মনে করেন তিনি। সরকার কেমন হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে একটি বলিষ্ঠ ধারণা এদিন তুলে ধরেন নোবেলজয়ী। তাঁর কথায়, "আমার সরকার আমার জন্য দাঁড়াবে। মানুষের আস্থাভাজন হবে। সরকার হবে আমার রক্ষা করার লোক। তবে মানুষ সেই সরকারে যোগ দেবে।" একই সঙ্গে তাঁর মত, সারা বাংলাদেশ একটা বড় পরিবার। ফলে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়ে, যারা বিপথে চলে গিয়েছে, তাঁদেরকেও ফিরিয়ে আনতে চান তিনি।
কিছুদিন ধরেই বারবার সামনে এসেছে অশান্ত বাংলাদেশের ছবি। বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট। এগুলিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখছেন ইউনূস। তাঁর কথায়, "আমাদের কাজ প্রত্যেককে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই-বোন। দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা আমাদের অগ্রগতির বড় শত্রু । আমাদের যে নতুন যাত্রা শুরু হল, তার শত্রু এই সহিংসতা। ইউনূস জানান, দেশের প্রকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়াই হবে এই সরকারের অন্যতম একটি লক্ষ্য। সেই বাহিনী এমন হবে, যাতে মানুষের আস্থা থাকবে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্ভয়ে থাকুন, মানববন্ধনে যে বার্তা দিলেন আন্দোলনকারীরা
এর পরেই দেশের মানুষের উদ্দেশে তিনি জানান, তাঁর উপর আস্থা রেখে ছাত্ররা তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ,সেই ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছেন। দেশবাসীর কাছে তাঁর আবেদন, তাঁরা যদি ইউনূসের কথা না শোনেন, তাহলে এখানে থাকার তাঁর প্রয়োজন নেই। আর সেই হিসেবে তাঁর প্রথম আবেদন, মানুষ যাতে সহিংসতা, বিশৃঙ্খলতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। তাঁর মতে, ছাত্রদের দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পাই। নতুন সম্ভবনার দেশ, বীজতলা তৈরি হবে এখান থেকেই। একই সঙ্গে তাঁর বার্তা, সরকারি কর্মকর্তা, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনী- এই পরিবারে যেন কোনও গোলযোগ না হয়। তড়িৎ গতিতে বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগোনোর বার্তাই দিয়েছেন তিনি।
সব ঠিক থাকলে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৮টা নাগাদ ঢাকার বঙ্গভবনে শপথ নেবে অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। বুধবার সাংবাদিক সন্মেলনে সেনাবাহিনীর প্রধান জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের সদস্য ১৫ জনের মতো হতে পারেন। তবে এই তালিকায় কারা রয়েছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। নতুন সরকারের সদস্যদের বেছে নিতে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে বলে জানান পড়ুয়ারা। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘লিয়াজোঁ কমিটি’।