নোবেলের দাবিদার, তাই হঠাৎ বাঙালির বাজি তারাশঙ্কর! কী ভাবছেন লেখকরা
Tarashankar Bandyopadhyay: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল মনোনয়ন প্রকাশ্যে আসার পর কী বললেন বাংলার সাহিত্যিকরা?
'লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এমন কঠিন কাজে হাত না দেওয়াই ভালো ছিল।'- 'আমার সাহিত্য জীবন'-এ আক্ষেপ করেছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা', 'পঞ্চগ্রাম', 'কালিন্দী', 'গণদেবতা', 'রাধা'- নানা অভিমুখে বিচরণ ছিল যাঁর কঠিন কথার, দৃঢ় কলমের জোরে এগিয়ে যাওয়া বারবার ছিল যাঁর, লেখার জন্য বহু ত্যাগ ছিল যাঁর জীবনে, সেই তারাশঙ্কর জীবনের শেষ পর্বেই রেখে গিয়েছিলেন অমোঘ এক স্মৃতি। রবীন্দ্র-প্রবাহের স্রোতে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে পুরস্কার নিয়ে বাংলা, বাঙালির আদিখ্যেতা একটু বেশি বলে কেউ কেউ দাবি করলেও পাশ্চাত্যের সেই বিখ্যাত পুরস্কার, নোবেল-বিজয়ী হতে পারতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
কেন? সম্প্রতি, ১৯৭১ সালের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে নোবেল কমিটি। যে তালিকাটি ওই বছরের সাহিত্যে পুরস্কারের মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেবার চিলি-র পাবলো নেরুদা সাহিত্যে নোবেল পান, ঠিক সেই তালিকাতেই নাম দেখা যাচ্ছে বাংলার তারাশঙ্করেরও। ৯০ জন সেরা সাহিত্যিকের ওই মনোনয়ন তালিকায় পাবলো নেরুদা, নাবোকভ, এডওয়ার্ড অ্যালবি, টেনেসি উইলিয়ামস, মেরি আন্ডারের সঙ্গে ৯ নম্বরে নাম রয়েছে 'গণদেবতা'-র স্রষ্টার।
আরও পড়ুন: কালে কালে জৌলুস হারিয়েছে পুজোসংখ্যা? কী মত লেখকদের
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই বাংলার সাহিত্য-মহলের একাংশ থেকে নেটিজেন- হইহই শুরু হয়েছে সব ক্ষেত্রেই। কেউ কেউ বলছেন, বরাবর মায়ের থেকে মাসির দরদে বিশ্বাসী বা সমকালে লেখককে পাত্তা না দেওয়া বাঙালিরাই গুগল সার্চের ওপরের সারিতে রাখছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে! যেন প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, নোবেল তালিকায় নাম থাকার ফলেই তারাশঙ্করের স্থান উঁচু হয়েছে ফের।
কিন্তু কেন? এই প্রসঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম, সমসাময়িক সময়ের খ্যাতনামা লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বললেন, "তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ্য। তিনি অবশ্যই নোবেল-বিজয়ী হতে পারতেন। শুধু তিনি কেন, ঠিকঠাক দেখলে এ দেশের কমপক্ষে ২০ জন সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন।" তাঁর দাবি, "আমরা নোবেল নিয়ে মাতামাতি করি বেশি। অর্থাৎ ইউরোপের বাইরে আমরাই সর্বাধিক একটু বেশি ভাবি নোবেল নিয়ে। কিন্তু এই বিশ্বে বহু পুরস্কার রয়েছে। যা বহু অর্থেরও। তুলনায় ভারতের মতো দেশে সাহিত্যিকদের জন্য বহু আর্থিক মূল্যের পুরস্কার তেমন একটা নেই!'' এদেশে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অভাব নিয়ে তাঁর মন্তব্য, "অনুবাদে সমস্যা। বাংলার সাহিত্য-অনুবাদ হয় কম। তুলনায় উড়িয়া, মালয়ালম- বহু ভাষার সাহিত্য নিয়মিত অনুবাদ করা হয়। এর ফলে একটা বড় অংশের পাঠকের কাছে বিভিন্ন লেখা, সৃষ্টি পৌঁছতে পারে। তারাশঙ্করের সাহিত্য বা সমসাময়িক সময়ের বাকিরা। যদি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকদের লেখার বিদেশি ভাষার অনুবাদ হত, তাহলে হয়তো এই প্রবণতা বেড়ে যেতে পারত।'' তাঁর মতে, ''আমি বিদেশি সাহিত্য পড়ি কম। কিন্তু যেটুকু দেখেছি, তাতে আমাদের বাংলার সাহিত্য, ছোটগল্প, উপন্যাস বিদেশিদের তুলনায় গুণগত মানে কোনওভাবেই কম নয়। সমকালে সমকালের গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সকলেই পিছিয়ে। তাই এই অবস্থা হয়ত।" স্বপ্নময় চক্রবর্তী আরও বলেন, "শুধু তারাশঙ্কর নন, আমি তো শুনেছি ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে যেবার বইমেলায় ভারত থিম হলো, মহাশ্বেতা দেবী উদ্বোধনে গেলেন, আমিও ছিলাম- সেই অনুষ্ঠানে তো তাঁকে পরিচয় করানো হল নোবেল পুরস্কারে মনোনীত সাহিত্যিক হিসেবে।''
অর্থাৎ, শুধুই তারাশঙ্কর নন, বাংলার, বাঙালির সাহিত্যের উচ্চমানে মহাশ্বেতা দেবীও মনোনয়ন পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারের। নোবেল মানেই বিরাট, তা না পেলে বড় সাহিত্যিক হওয়া যাবে না, একথা মানতে নারাজ বাংলার সাহিত্য জগৎ। তাঁদের অনেকেরই দাবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার ইংরেজি অনুবাদ না হলে, তাঁর ব্যক্তিগত পরিচিতি না থাকলে ওইটুকুও জুটত না, কারণ ইউরোপের বাইরে যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়, একথা ভাবাও যেত না তখন। যদিও পরবর্তীকালে ভারতে এসেছে একাধিক নোবেল পুরস্কার। ভারতীয় হিসেবে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত অথবা ভারতের সঙ্গে জড়িয়েও নোবেল পেয়েছেন অনেকে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাহিত্যিক অমর মিত্র ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, "তিনি অনন্য। অভিনব। যোগ্য হিসেবে এই পুরস্কার পেতেই পারতেন। তাঁর মতো দৃঢ়চেতা লেখক এই দেশে কেন, বিশ্বেও কম আছেন। তাই এই সম্মান তাঁর জন্য অবশ্যই যোগ্য ছিল।'' তাঁর কথায়, "জীবনে কত ত্যাগ করেছেন তারাশঙ্কর! একবার বম্বে গিয়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখার সুযোগ আসলেও তিনিই না বলেছিলেন। তাঁর বদলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন লিখতে। মাত্র ৪০-৫০ টাকা মাসিক আয়। মেসবাড়ি, থাকা-খাওয়ার খরচ। একাধিক লড়াই করতে হয়েছে রোজ। তবুও তিনি লিখেছেন। রোজ তৈরি করেছেন এক একটি দৃষ্টান্ত।'' তারাশঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অমর মিত্রর। তিনি বলেন, "১৯৭১ সাল। তাঁর প্রয়াণের কয়েক মাস আগেই একটি অনুষ্ঠানে তিনি আসেন। বক্তব্য রাখেন। তখন আমরা অনেক ছোট। একাধিকবার একই এলাকায় থাকার সুবাদে দেখেছি মানুষটিকে।''
প্রসঙ্গত, যে বছরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবিদার হিসেবে তাঁর নাম মনোনীত হয়েছিল, সেই বছরেই মৃত্যু হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
তারাশঙ্কর আজ নয়, অনন্যতায় চিরন্তন। বরাবর মৌলিক লেখনীতে তিনি অভিনব। মহাশ্বেতা দেবীর আগে সমসাময়িক কথায়, সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর কথকতার ক্ষেত্রে তিনিও বিশিষ্ট। প্রকৃতি, পরিবার, সম্পর্ক, টানাপোড়েন রাজনৈতিক আবহের মানিক, বিভূতিভূষণ ছাড়িয়ে তারাশঙ্কর ছিলেন আঁতের কথার বাহক। যিনি জল, জঙ্গল, নদী, প্রেম আর লড়াইকে মুখ্য করে চালিয়েছেন নিজ সৃষ্টির নৌকো। যে নৌকো চলেছে কখনও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথার ঘাট পেরিয়ে, কখনও মনস্তত্ত্বের নদীর ওপর দিয়ে সম্পর্ক-ঘাটের উদ্দেশ্যে। তাই, সামগ্রিকভাবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল-যোগ আলোচনা-বিতর্ক আর বিশেষত্বর প্রকাশ ঘটালেও আসলে তিনি অনন্য। বাংলার শুধু নয়, দেশের কথাসাহিত্যের আঙিনায় গণদেবতা যেন তিনিই, বলছেন অনেকেই।