বিতাড়িত হয়েছিলেন কর্মক্ষেত্র থেকে, যে আবিষ্কার নোবেল এনে দিল এই বিজ্ঞানীকে
Nobel Prize 2023 in Medicine : যে প্রযুক্তি মেনে কোভিড-ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে সেই কালজয়ী আবিষ্কারের জন্যেই যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন ডঃ কারিকো এবং ডঃ উইজম্যান।
গবেষকের পদ থেকে হঠাৎই একদিন সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ফলে রাতারাতি সব গুটিয়ে, নিজের পরিবার নিয়ে জার্মানি ফিরে আসতে বাধ্য হলেন
এই বিজ্ঞানী। প্রচণ্ড হতাশা এবং মানসিক অবসাদের মধ্যেই শুরু করলেন নতুন চাকরির খোঁজ। চাকরি পেলেনও। তারপর কেটে গেল দশটা বছর। নোবেল অ্যাসেম্বলির সেক্রেটারি পদে আসীন থমাস পার্লম্যান ২ অক্টোবর ঘোষণা করলেন- সেই বিজ্ঞানী, যাঁকে পত্রপাঠ বিদেয় করেছিল তাঁর প্রাক্তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাঁকে ২০২৩ সালে শারীরবিদ্যা অথবা চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেলের মতো সর্বোচ্চ সম্মানীয় পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। পার্লম্যান তখন যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। কথা বলতে বলতে থেমে যাচ্ছেন খানিক আশ্চর্যে, খানিক আনন্দে।
সেই 'কামব্যাক' বিজ্ঞানী হলেন ডঃ ক্যাটলিন কারিকো। ডঃ ড্রিউ উইজম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে শারীরবিদ্যা কিংবা চিকিৎসাবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি। এই দুই বিজ্ঞানী মিলে একটি 'মডিফায়েড' মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) প্রযুক্তির আবিষ্কার করে ফেলেছেন পনেরো
বছর আগেই। যে প্রযুক্তি মেনেই ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মোডারনার মতো দুই তাবড় ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা কোভিড-ভ্যাক্সিন তৈরি করেছে। এই কালজয়ী আবিষ্কারের জন্যেই যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁরা।
৬৮ বছর বয়সি ডঃ কারিকো বর্তমানে হাঙ্গেরির সিজেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এর পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসরও। ৬৪ বছর বয়সি ডঃ উইজম্যানও বর্তমানে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত। কালজয়ী এই আবিষ্কারের নেপথ্যে যে 'ল্যাব-ওয়ার্ক', তার পুরোটাই করা হয়েছে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই।
আরও পড়ুন- ৬১ বছর ছিল গোপনে, নোবেলজয়ী মেরি কুরিকে কেন শোয়ানো হয় সীসার কফিনে?
পার্লম্যান কিছুটা বিভোর হয়ে বলে চলেছেন, “ক্যাটালিনের জীবনে এ যেন এক নাটকীয় মোড়”। কারণ দশ বছর আগে পার্লম্যানের কাছে যখন প্রফেসর ক্যাটালিন নিজের পদ খোয়াবার দুঃখ করছিলেন, তিনি তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, হতাশ। কিন্তু ডঃ ক্যাটলিন থেমে থাকেননি। আরএনএ অণু জীবকোশে কী কী কাজের জন্যে দায়ী, তা নিয়ে খুঁটিয়ে গবেষণা করে গেছেন তিনি। লক্ষ্য একটাই– নানা রকম রোগের চিকিৎসার কথা মাথায় রেখে এমন একটি এমআরএনএ অণু গড়ে তোলা, যেটি জীবকোশে পাঠানো হলেই সেগুলি থেকে প্রোটিন তৈরি হবে। আর সেই প্রোটিন আটকাবে নানা রোগ। কোভিড ভ্যাক্সিনের উদাহরণই না হয় এখানে দেওয়া যাক। কোভিডেরিম এমআরএনএ-ভ্যাক্সিন শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। যে অ্যান্টিবডি পরবর্তী করোনা-সংক্রমণ থেকে আমাদের বাঁচায়। নিদেনপক্ষে, কোভিড হ’লেও শরীরে রোগের প্রকোপ কমায় সেই ভ্যাক্সিন, এমনটাই দাবি করেন ভ্যাক্সিন বিশেষজ্ঞরা।
ডঃ উইজম্যানের গবেষণাও আরএনএ নিয়েই। পাশাপাশি মানুষের জন্মগতভাবে পাওয়া রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ 'ইনেট ইমিউন সিস্টেম' নিয়েও তিনি সমান আগ্রহী। তিনি দেখছিলেন, গবেষণার এই দু’টি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ভ্যাক্সিন তৈরি করা যায় এবং পাশাপাশি জিন থেরাপির দিকেও নজর দেওয়া যায়।
জীবকোশের বাইরে তৈরি ইনভিট্রো এমআরএনএ দিয়ে যখন ভ্যাক্সিন তৈরি করা হতো, তখন প্রয়োজনের তুলনায় কম প্রোটিনই তৈরি হতো। এত কম প্রোটিনে ভাইরাসকে ঠেকানো মুশকিল। কিন্তু এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে, দেখা গেল প্রচুর ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইনিন তৈরি হচ্ছে। ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন কী, সামান্য কথায় তা বলা যাক। সাইটোকাইন খুব ছোট ছোট প্রোটিন অণু, যেগুলি আমাদের নানা রকম ইমিউন সেল থেকে তৈরি হয়। সাইটোকাইন প্রোটিন ছাড়া জীবাণুকে আটকানো বস্তুত অসম্ভব। কিন্তু ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইন তৈরি হলে হিতে বিপরীত হয়। নাম শুনেই আঁচ পাওয়া যায়, ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইন যে ইনফ্ল্যামেশনের জন্যে দায়ী। আর তা হলে জ্বর, গায়ে ব্যথা থেকে শুরু করে সেরিব্রাল এবং কার্ডিয়াক স্ট্রোক পর্যন্ত হ’তে পারে। অচল হতে পারে শরীরের একাধিক অঙ্গও। মৃত্যুই সেক্ষেত্রে অনিবার্য পরিণতি।
ডঃ কারিকো এবং ডঃ উইজম্যান দেখলেন জীবকোশের বাইরে তৈরি ইন ভিট্রো এমআরএনএ, মানুষের শরীরে তৈরি এমআরএনএ মলিকিউলের থেকে ভীষণ আলাদা। ইন ভিট্রো এমআরএনএ ডেনড্রাইটিক সেলে প্রবেশ করালে অনেক বেশি ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইন তৈরি হচ্ছে। এদিকে মানুষের শরীরে তৈরি এমআরএনএ-এর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইনের পরিমাণ চোখে পড়ার মতো কম।
আবার দেখা গেল, ব্যাকটেরিয়া থেকে পাওয়া এমআরএনএ যদি ডেন্ড্রাইটিক সেলে ঢোকানো হয়, সেক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইন তৈরি হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ডেনড্রাইটিক সেল আমাদের ইমিউন সিস্টেমের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এমআরএনএ প্রবেশ করালে ডেনড্রাইটিক সেল থেকে অ্যান্টিবডি তৈরির হওয়ার পাশাপাশি, রোগপ্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যক টি-সেলও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ডেনড্রাইটিক সেলের কিছু লক্ষণীয় বিশেষত্ব রয়েছে। ঠিক যে কারণে, এমআরএনএ নির্ভর ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা বিচার করতে এদেরকেই বেছে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এবারে ফেরা যাক আরএনএ-এর কথায়। এতে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং ইউরাসিল নামে চারটি নাইট্রোজেন বেস রয়েছে। এই নাইট্রোজেন বেস আর আরএনএ-এর সুগার মলিকিউলকে একত্রিত ভাবে নিউক্লিওসাইড বলে। তবে আমাদের কোশে এই নাইট্রোজেন বেসগুলির সামান্য
পরিবর্তনও ঘটতে পারে। যার ফলে পরিবর্তন আসতে পারে নিউক্লিওসাইডের কাঠামোতেও। মজার বিষয় হলো, এই জাতীয় পরিবর্তন ব্যাকটেরিয়ার এমআরএনএ-তে যত না ঘটে, তার থেকেও বেশি মানুষের শরীরে ঘটে এবং সেই কারণেই ব্যাক্টেরিয়ার এমআরএনএ মানুষের এমআরএনএ-র তুলনায় অনেক বেশি ইনফ্ল্যামেটারি সাইটোকাইন তৈরি করে।
আরও পড়ুন- মাস্ক মোটেই ঠেকায়নি কোভিড-১৯ কে! কেন তবে দেশে বাধ্যতামূলক হলো মাস্ক?
এই সাত-পাঁচ মাথায় রেখে ডঃ কারিকো এবং ডঃ উইজম্যান ইন ভিট্রো আরএনএ-র চার ধরনের নিউক্লিওটাইড বেসকে অদল-বদল করে দেখতে লাগলেন। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় নিউক্লিওটাইড বেস মডিফিকেশন বলে। তাঁরা দেখলেন, ইউরিডিন বেস মডিফিকেশনের ফলে প্রায় একেবারেই ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন তৈরি হচ্ছে না। এই ইউরিডিন হলো ইউরাসিল এবং আরএনএ-এর সুগার মলিকিউল অর্থাৎ রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের যুগলবন্দি।
তাঁরা ইউরিডিনেরই একটি প্রতিরূপ (বা আইসোমার) সিউডোইউরিডিন এমআরএনএ-তে ব্যবহার করে দেখলেন ইনফ্ল্যামেশনের সম্ভাবনা একেবারেই কমে গেছে। শুধু তাই নয়, এই 'মডিফায়েড' এমআরএনএ থেকে অ্যান্টিবডি তৈরির হারও বেড়েছে। যদিও এই আবিষ্কার কোভিড-মহামারী শুরুর পনেরো বছর আগেই হয়ে গিয়েছিল, তাও নোভেল করোনাভাইরাসের উপযুক্ত ভ্যাক্সিন তৈরির সময়ে একটু অন্যভাবে ভাবতে হয় এই দুই বিজ্ঞানীকে। তাঁরা স্পাইক-প্রোটিন তৈরির জন্য দায়ী এমআরএনএ-তে ইউরিডিনকে সরিয়ে সিউডো-ইউরোডিন ব্যবহার করেছিলেন। এই স্পাইক প্রোটিন নোভেল করোনাভাইরাসের একদম বাইরের আস্তরণটি তৈরি করে। দেখতে খানিক সূর্যের বাইরের অংশ বা করোনার মতো। যে কারণে ভাইরাসটির নামেই 'করোনা' শব্দের উল্লেখ রয়েছে।
এই আবিষ্কারের যে বাস্তবিক প্রযোগ, তা কিন্তু কেবল কোভিড ভ্যাক্সিন তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি নোভেল করোনাভাইরাসের মতো একাধিক সংক্রামক জীবাণু প্রতিরোধ করা তো বটেই, পরবর্তীতে প্রোটিন-নির্ভর চিকিৎসাতেও কাজে লাগবে। তার থেকেও বড় কথা, ক্যান্সারের ভ্যাক্সিন তৈরিতেও 'মডিফায়েড'
এমআরএনএ প্রযুক্তির উপযোগিতা এই মুহুর্তে পরীক্ষা করে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।