যুদ্ধে মদত দিয়েও পেয়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার! প্রয়াত বিতর্কিত 'যুদ্ধবাজ' হেনরি কিসিঞ্জার
Henry Kissinger Dies : একদিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অন্যদিকে ইয়োম কিপুরের যুদ্ধবিরতি! এই দুইয়ের মাঝে আবার নোবেল শান্তি পুরস্কার!
নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছেন, আবার সেই পুরস্কারজয়ী নিজে একজন যুদ্ধবাজ! এমন বৈপরীত্য কি সম্ভব? যুদ্ধবাজ কি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন? যুদ্ধবাজ কি কোনওদিন শান্তির কথা ভাবতেও পারেন? রহস্যময় কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার এমন একজন ব্যক্তি, যাকে ঘিরে এমন অজস্র প্রশ্ন গোঁত্তা খায়। ১০০ বছর বয়সে কানেক্টিকাটের বাড়িতে সদ্য মারা গেলেন কিসিঞ্জার। ছিলেন শিক্ষাবিদ, রাতারাতি হয়ে ওঠেন সেলিব্রিটি। হেনরি কিসিঞ্জার আসলে ছিলেন সেই ইহুদি এক কিশোর যে নাৎসিদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছিল একসময়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিদের উপদেষ্টা ছিলেন কিসিঞ্জার। পাল্টে দিয়েছিলেন ইতিহাসের গতিপথ। কাজপাগল এই মানুষ জীবনের শেষ সময় অবধি ডুবে ছিলেন কাজেই।
কিন্তু প্রাক্তন মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কি সত্যিই একজন দক্ষ উপদেষ্টা নাকি নির্দয় এক মানুষ? দুই রাষ্ট্রপতির অধীনে কাজ করেছেন তিনি: রিচার্ড নিক্সন এবং জেরাল্ড ফোর্ড, দু'জনেই রিপাবলিকান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিনের কূটনৈতিক অবস্থান, মার্কিন-সোভিয়েত অস্ত্র চুক্তি এবং ইজরায়েলি ও আরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের বিষয়ে কিসিঞ্জারের কাজ বিতর্কিত নয়। তবে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে তার ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট বিরোধী স্বৈরশাসনের প্রতি তাঁর সমর্থন, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায়, আজও দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় বিশ্বকে।
২০২১ সালে ৯৮ বছর বয়সে হেনরি কিসিঞ্জার গুগলের প্রাক্তন সিইও এরিক স্মিড এবং এমআইটি কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল হাটেনলোচারের সঙ্গে মিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর একটি বইও লেখেন। ৯০ বছর বয়স অবধিও হেনরি কিসিঞ্জার ডিজিটাল বিশ্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মতামত ছিল প্রচুর।
আরও পড়ুন- অপরের জন্য লিখে সাহিত্যে নোবেল, কে এই জন ফসে?
১৯২৩ সালে জার্মানির ফুর্থে ধর্মপ্রাণ ইহুদি মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম তাঁর। ক্রমেই বাড়তে থাকা ইহুদি-বিদ্বেষের মুখে পড়ে থার্ড রাইখ থেকে পালিয়ে যান তারা এবং ১৯৩৮ সালে নিউইয়র্কে আশ্রয় নেন সপরিবারে। কিসিঞ্জার জার্মানিতে মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন। বুলগের নৃশংস যুদ্ধ নিজের চোখে দেখেন তিনি। স্থানীয় জার্মানভাষী হিসেবে তাঁকে গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রাক্তন গেস্টাপো অফিসারদের পিছু নিয়ে, তাঁদের খবরাখবর, তথ্য, গতিবিধি জানিয়ে ব্রোঞ্জ পদকও জেতেন কিসিঞ্জার।
১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ধীরে ধীরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি এবং লিন্ডন জনসনের অধীনে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিসিঞ্জার কোল্ড ওয়ারের সময় 'নৈতিকতা' ভুলে বাস্তববাদী হওয়ার উপরেই জোর দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রিচার্ড নিক্সন ১৯৬৮ সালে কিসিঞ্জারকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেন। ওয়াশিংটনের বিদেশনীতির পুনর্নির্মাণ শুরু করেন তিনি। প্রদেশগুলির ক্ষমতাকে কমিয়ে ধীরে ধীরে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। কিসিঞ্জার এমন এক জটিল গণতন্ত্রের মডেল তৈরি করেছিলেন যাতে কৌশলগত দিক থেকে অসাধারণ মনে হলেও, জনসমর্থনের অভাব ছিল। বিতর্কিত কিসিঞ্জারের বাস্তব রাজনীতি দুই প্রজন্মের নীতিনির্ধারকদেরই প্রভাবিত করেছে।
কিসিঞ্জারই চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র সীমাবদ্ধতা চুক্তির পথ প্রশস্ত করেন। কিসিঞ্জার একবার লিখেছিলেন, বৈদেশিক বিষয়ে ওয়াশিংটনের কোনও স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু ছিল না, শুধুমাত্র স্বার্থ ছিল।
তবে কিসিঞ্জারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। কিসিঞ্জার একদিকে বিধ্বংসী বোমা হামলার চালিয়ে যান, অন্যদিকে উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে আলোচনায় বসে 'শান্তি' ফেরানোর ডাকও দেন। কিসিঞ্জারের এই পরিকল্পনার ফলেই যুদ্ধ চার বছর ধরে চলে। লাওস এবং কম্বোডিয়ায় গোপন বোমা হামলা চলে যা ২২,০০০ আমেরিকান সৈন্য এবং আরও অনেক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় মানুষের প্রাণ নেয়। কম্বোডিয়ায় গণহত্যাকারী খেমার রুজকে ক্ষমতা দখল করতে সাহায্য করে কিসিঞ্জারের পরিকল্পনাই। কিসিঞ্জার তো বরাবরই মনে করতেন, "ক্ষমতাই হলো চূড়ান্ত কামোদ্দীপক!"
আরও পড়ুন- নোবেলের জন্য চার বার মনোনয়ন! বাংলাতেই তবু জাতের লড়াইয়ে কোণঠাসা ছিলেন মেঘনাদ সাহা
১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিই কিসিঞ্জারকে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দেয়। সেই বছর কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক চালেই, ইজরায়েল, মিশর এবং সিরিয়ার মধ্যে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ থামে। কিসিঞ্জারের উপদেষ্টা পদে মেয়াদ শেষ হলেও প্রেসিডেন্টদের বিশ্বস্ত পরামর্শক ছিলেন তিনি।
বাস্তববাদী হতে গিয়ে যে নির্মমতার আশ্রয় কিসিঞ্জার নিয়েছিলেন তা নিয়ে আজও প্রচুর দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অন্যদিকে ইয়োম কিপুরের যুদ্ধবিরতি! এই দুইয়ের মাঝে আবার নোবেল শান্তি পুরস্কার! কম্বোডিয়ায় বোমা হামলা, ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর দখলকে সমর্থন এবং ডানপন্থী স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোচেটের পক্ষ নিয়ে চিলির মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করার নেপথ্যে রয়েছেন কিসিঞ্জার। এই মানুষটিই আবার বিশ্বের শান্তির দূত হয়েও দেখা দিচ্ছেন!
হয়তো নাৎসিদের জার্মানিতে বেড়ে ওঠার কারণেই কিসিঞ্জারের সন্দেহ ছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমে সবসময় উদার গণতন্ত্র আসে না। নির্বাচন উল্টে একনায়কত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিতর্কিত এই মানুষটি নিজেই তাই লিখে গিয়েছেন, "রাজনীতির সবচেয়ে মৌলিক সমস্যা দুষ্টের নিয়ন্ত্রণ নয়, সমস্যা হচ্ছে ন্যায়ের সীমাবদ্ধতা।"