বারবার নিজের স্মৃতির ময়নাতদন্ত, নোবেল জয়ী অ্যানি এরনোঁর সাহিত্য যে কারণে জনপ্রিয়
Annie Ernaux Nobel Prize: ষাট বছরের জীবনে এরনোঁ শুধু নিজের কথাই বলে গিয়েছেন, তা নয়। সেখানে জড়ো হয়েছে তাঁর প্রজন্ম, তাঁর বাবা মায়ের প্রজন্ম এবং নানান শোষিতের কথকতা।
"হয়তো আমার শরীর, আমার অনুভূতি আর আমার চিন্তাদের লেখা করে তোলাই এ বেঁচে থাকার পাখির চোখ। অন্যভাবে বললে, এমন একটা বোধের আয়ত্তে থাকা বিশ্বজনীন, যা আমার অস্তিত্বকে আর পাঁচজনের মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারে।"হ্যাপেনিং, অ্যানি এরনোঁ
এবার নোবেল পেলেন লেখিকা। হ্যাপেনিং উপন্যাসটি আবর্তিত হয় বাইশ তেইশ বছর বয়েসি এরনোঁর একটি ট্রমাকে কেন্দ্র করে। তখন ফ্রান্সে অ্যাবর্শন আইনি বৈধতা পেয়েছে। ১৯৬৩ নাগাদ সেই অপার যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল লেখিকার। একা এক তরুণীর সেই ভয়, আতঙ্ক, দিনের পর দিন তাঁকে কুরে কুরে খায়। এসব অভিজ্ঞতা সারা জীবনের মতো দাগ রেখে যায়। এই বিষয়ের উপরই ডানা ছড়িয়ে পাক খায় উপন্যাসের বয়ান। এ বছর লেখিকা ৮২-তে পড়লেন। সারা জীবনের নানান অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখার উপাদান হয়ে উঠেছে। নোবেল কমিটিও এ কথা স্বীকার করেছে। ১৯০১-এ নোবেল পুরস্কার শুরু হয়েছিল। ১২১ বছরে মাত্র সতেরো জন লেখিকা পুরস্কার পেলেন। আর্নোই সেই সপ্তদশতম লেখিকা।
আর্নো ফ্রান্সে অত্যন্ত বিখ্যাত লেখিকা, দীর্ঘদিনের। তবে ইংরেজি শাসিত জগৎ তাঁর খোঁজ পেয়েছে সদ্য। এর আগে, ২০১৯ নাগাদ তাঁর আরেকটি বই বুকারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল। ১৯৪০-এ লেখিকার জন্ম থেকে ২০০৭, সাতষট্টি বছরের নানান টুকরোটাকরা অভিজ্ঞতা নিয়ে সে আত্মজীবনী। ২০০৮-এই ফ্রান্স এবং ২০১৬-য় ইতালিতে বইটি পুরস্কৃত হয়েছিল। নর্ম্যান্ডির সেইন-ম্যারিটাইমে জন্ম তাঁর। বাবা মা মুদির দোকান চালাতেন। বাবার হাতে মায়ের নিগ্রহ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বছর বারো বয়স যখন এরনোঁর, নিজের বাবাকে দেখেছিলেন মাকে খুন করার চেষ্টা করতে। 'শেম' উপন্যাসের প্রথম পংক্তিতেই লিখেছিলেন, "জুনের এক রোববার বিকেল বিকেল, বাবা আমার মাকে খুন করতে গিয়েছিল।" এই সোজাসাপটা ন্যাকামিহীন বয়ান তাঁর আজীবন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি শুরু। কিন্তু প্রকাশকরা ছাপতে চাননি। বরং শুনিয়ে ছিলেন, এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভাল না। ফলে, লেখালেখি থামিয়ে দেন সে সময়। ফের কলম ধরেন বিয়ের পরে। তখন দুই সন্তানের মা। ফেঞ্চ শিক্ষক হিসেবে কাজও ধরেছেন একটা। এরই মাঝে লেখালেখি।
আরও পড়ুন- বিবর্তনের টাইমমেশিন আবিষ্কার! চিকিৎসায় নোবেলজয়ী প্যাবোর গবেষণা বদলে দেবে ইতিহাস
১৯৭৪-এ প্রথম উপন্যাস 'ক্লিনড আউট'। বর তাঁর লেখালেখিকে কেবল ছোট করতেন। কাজেই তাঁকে বিন্দুমাত্র আভাস পেতে দেননি। গ্যালিমাহ্-র মতো নাম করা প্রকাশনা এরনোঁর বই ছাপার পর সে ভদ্রলোকের কী দাপাদাপি! খুব গায়ে লেগেছিল এরনোঁর সাফল্য তাঁর। বলেছিলেন, এরনোঁ নাকি পিএইচডি থিসিস লেখার নাম করে এইসব কাজ করেছে, তাঁকে জানাবার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তাও বিয়েটা টিকে ছিল কোনও মতে। ১৯৮১-তে এরনোঁর তৃতীয় বই বেরলো। 'আ ফ্রোজেন উওম্যান'। বিষয়, বিয়ে এবং মাতৃত্বের হাজারো সমস্যা। পতিদেবতাটি আর নিতে পারলেন না। বিয়ের বাঁধন থেকে অবশেষে মুক্তি। আর বিয়ে করেননি আর্নো। একা থাকার স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন।
১৯৯২ নাগাদ বেরলো তাঁর 'সিম্পল প্যাশন'। এক বিবাহিত বিদেশি ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে তাঁর প্রেমের গল্প। কোনও রকম বিবেক দংশন ছাড়া খোলাখুলি নিজের যৌন চাহিদাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরলেন এরনোঁ। বইটি বিপুল জনপ্রিয় হল। প্রথম দু'মাসে ২০০০০০ কপি বিকিয়ে গেল। আর্থিক সাফল্যের স্বাদ সেই প্রথম।
'ইন আ উওম্যানস্ স্টোরি'তে লেখিকা বলেন, "আমি কেবল কুড়ুনি মাত্র"। ষাট বছরের জীবনে এরনোঁ শুধু নিজের কথাই বলে গিয়েছেন, তা নয়। সেখানে জড়ো হয়েছে তাঁর প্রজন্ম, তাঁর বাবা মায়ের প্রজন্ম এবং নানান শোষিতের কথকতা। এই বিশাল ব্যপ্তির স্তরে স্তরে গাঁথা যৌনতা ও অন্তরঙ্গতার থিম, সামাজিক বৈষম্য, যন্ত্রণা, লজ্জা— এই ইঁটেদের ফাঁকে ফাঁকে সময় আর স্মৃতির দ্বৈরথ। অথচ এমন থিমের বয়ান অত্যন্ত সাদামাটা গদ্যে। পাঠকের হাত ধরে সেই গদ্য করে তোলে নানান দ্বন্দ্বের মধ্যমণি। সে কারণেই এমন সরল গদ্য বেছে নেওয়া। অথচ এই সরলতার মধ্যেও এরনোঁর নিজস্ব বোধ কাজ করে ক্রমাগত। যে বোধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কোনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা এক নির্দিষ্ট সমাজ-রাজনীতির অংশ। এই রাজনৈতিক বোধ অভিজ্ঞতাকে 'ব্যক্তিগত' বলে ঝেড়ে ফেলা যায় না। স্মৃতিও পিচ্ছিল। যার একদিক অস্বচ্ছ, অপরিষ্কার, সেদিকটা পক্ষপাতিত্বের ভার জমে জমে ক্রমশ ঝুঁকে গিয়েছে। কাজেই ভরসার অযোগ্য। তাতে ভরসা করলে আছাড় অনিবার্য। সেদিক থেকে তাঁর উক্তির সত্যটা খানিক খাটে বৈকি! কুড়ুনি হিসেবে তাঁর কাজ আদতে নৃতত্ত্ববিদের মতোই। খুঁড়ে খুঁড়ে ধ্বংসাবশেষ টুকু তোলা, ফসিল জমানো, সেই সব টুকরো জীবন তারপর এক তালে বাঁধার চেষ্টা। তাতে এই মহাকালের নিরিখে ব্যক্তির অবস্থান ফুটে ওঠে। যতটা ফোটানো যায় আর কী! তারই চেষ্টা মাত্র।
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু সত্ত্বেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের দৌড়ে! যেভাবে মিথ্যে খবরের জাল ছিঁড়েছেন এই দু’জন
এবং এই পাঠ ধ্রুব নয়। গতিহীন নয়। পড়ার প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি স্মৃতিচারণে, যতবার সে পাঠের দিকে নজর ফেরে পাঠ বদলে যেতে থাকে। অনবরত নিজের স্মৃতির প্রতি পাঠককে সন্দিগ্ধ করে তোলেন এরনোঁ। নিজ অতীতের ময়নাতদন্তে লেখিকা খোদ পাঠকের ভিড়ে মিশে যান। থোকে থোকে উঠে আসে বিবিধ ধারাবিবরণী। তাঁর অ্যাবর্শনের ট্রমা, খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়ে হওয়ার লাঞ্ছনা, নিজেকে শিক্ষিত করার অবিরত চেষ্টা পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটে ওঠে কালের কাগজে। পুরুষশাসিত এই দুনিয়ায় নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কতটুকু স্বীকৃত? হয় এক নিমেষে বাতিল করা, ছোট করা নয় নিজের আকাঙ্ক্ষার সামগ্রী হিসেবে আপন করা— এই দুই গত পুরুষের। এর বাইরে নারীকে একজন মানুষ হিসেবে কি আজও স্বীকৃতি দিয়েছেন পুরুষেরা? আত্মনির্ভরতার হিসেব নারীর এখনও বুঝে নেওয়া বাকি— এরনোঁর 'কুড়ুনিয়া' সাহিত্য আমাদের বারবার এই নগ্ন সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রলেপের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করেই।