নিত্যানন্দ || বাংলার সহজিয়া বৈষ্ণব আন্দোলনের এক চিরবিদ্রোহী

ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলায় সুলতানি শাসন চলছে।  সেই সময়  ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দনদেবীবর ঘটকধ্রুবানন্দ মিশ্র প্রমুখের মতো শাস্ত্রবেত্তারা যখন সমাজের বিধিবিধানকে কঠোর থেকে কঠোরতর করার নীতি নিয়েছেন, তখনই বাংলায় শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব এই রকম এক সামাজিক প্রেক্ষিতে ৩২ বছর বয়সে নবদ্বীপে আসেন মধ্যযুগের বাংলার এক আশ্চর্য চরিত্র, বৈষ্ণব আন্দোলনের বিদ্রোহী পুরুষ  নিত্যানন্দ (আনুমানিক: ১৪৭৩ -১৫৪২ খ্রিস্টাব্দ)। 

বয়সে ৮ বছরের বড় নিত্যনন্দের বাংলা তথা ভারতজোড়া খ্যাতি শ্রীচৈতন্যের ঘনিষ্ঠতম পার্ষদ হিসেবেই   বীরভূমের একচক্রা গ্রামে জন্মেছিলেন।  ১২ বছর বয়সে তাঁর বাড়িতে এক অতিথি সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার অনুচর হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, ২০ বছর সারা ভারত পর্যটন করে এই অবধূত সন্ন্যাসী নবদ্বীপে আসেন।

দু'টি দশকের এই বিচিত্র জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, বরাবর তিনি এ সম্পর্কে মৌন রয়ে গেছেন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবশ্য জানা গেছে প্রথমতঃ তিনি অবধূত অর্থাৎ সর্বসংস্কারমুক্ত শৈবতান্ত্রিক সন্ন্যাসী ছিলেন। ভক্তিরত্নাকর থেকে জানা যায়– তিনি পুরীসম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন। লক্ষীপতিপুরীর নিকট দীক্ষা লাভ করেছিলেন, কেউ কেউ বলেন নিত্যানন্দ শংকর সম্প্রদায়ের সারদামঠে দীক্ষিত সন্ন্যাসী। এ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে শাস্ত্রমতে অবধূতের ২৮ জন গুরু হয়, কোনও একজন গুরুর নাম নেওয়া তার নিষেধ।  দ্বিতীয়ত নিত্যানন্দ ছিলেন বেশে অবধূত, আকারে মহামল্ল এবং ভোজনপানে বীরাচারী।

সেই সময় নবদ্বীপ যে সব বিদ্যাচর্চার জন্য ভারতজোড়া খ্যাতি পেয়েছিল, সেগুলি হল, সাংখ্য-দর্শন, যোগ-দর্শনন্যায়বৈশেষিক, পূর্ব-মীমাংসাএবং  উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত-দর্শন। এছাড়াও ছিল কাব্য, অলংকার, নবন্যায়, স্মৃতি, আয়ুর্বেদ, ব্যাকরণ। সেই সময়ে নবদ্বীপে আছেন বাসুদেব সার্বভৌমরঘুনাথ শিরোমণি, স্মার্ত রঘুনন্দন , কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশবুনো রামনাথ, শঙ্কর তর্কবাগীশের মতো পন্ডিতরা। এই কারণে ভারতের সব সাধু – সন্ন্যাসী – পন্ডিতেরাই একবার নবদ্বীপতীর্থ ভ্রমণ করতেন।  নিত্যানন্দ নবদ্বীপের খ্যাতির কথা শুনে ছিলেন ঈশ্বরপুরীর কাছে, যিনি আবার চৈতন্যের আধ্যাত্মিক গুরু।  চৈতন্যের তরুণ পন্ডিত হিসেবে খ্যাতি তখনই ছড়িয়েছে, মাঝে গয়ায় গিয়ে ঈশ্বরপুরীর  কাছে দীক্ষা নিয়ে ফিরে এসে জ্ঞানমার্গ ছেড়ে ভক্তিমার্গের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।  সেটাই তখন নবদ্বীপের প্রধান আলোচনার বিষয়।  এমন সময় নিত্যানন্দ নবদ্বীপে এলেন।    

নবদ্বীপে গিয়ে শ্রীবাসের বাড়িতে উঠলেন।  সেখানেই ব্যাসপুজোর সময়  চৈতন্যর সঙ্গে তার দেখা, যেন পুরোনো দুই বন্ধুর বহুদিন পর দেখা হয়েছে। এরপর দুজনে নবদ্বীপে হরিনাম বিলোতে লাগলেন। কী সেই নাম? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। নিত্যানন্দ শ্রীবাসকে বাবা ও তার স্ত্রী মালিনীকে মা বলতেন, শুধু তাই নয়, বালকভাবে মালিনীর স্তন্যপানও করতেন, যা নিয়ে নবদ্বীপে ছিছিক্কার হয়েছিল। চৈতন্য বুঝেছিলেন, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বন্ধুর। নিত্যানন্দ প্রথম যে রাত শ্রীবাসের বাড়িতে কাটালেন, সেই রাতেই তাঁর জীবনে এক নতুন উপলব্ধি হল, তিনি বুঝলেন চৈতন্যর সঙ্গে তাঁর অনেক কাজ করতে হবে। এটা যুগ প্রয়োজন। বিরাট এক অন্তর্বিপ্লবের তাড়নায়, পরের দিন ভোরে তাঁর সন্ন্যাসীজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন  দণ্ড-কমণ্ডুলু  গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন, কোনো ভারতীয় সন্ন্যাসী যা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না, এ পাপাচার।  এরপর চৈতন্যের নির্দেশে নিত্যানন্দ ও যবন হরিদাস নবদ্বীপের ঘরে ঘরে হরিনাম প্রচার করতেন। সেই কাজে প্রতিদিন তাঁদের গৃহস্থের কাছে বহু গঞ্জনা অপমান সহ্য করতে  হতো, যার চূড়ান্ত হয় নবদ্বীপের দুই মদ্যপ কোটাল জগাই আর মাধাইয়ের হাতে মার খেতে হয় নিত্যানন্দকে। শুনে চৈতন্য পর্যন্ত এদের মারতে গিয়ে ছিলেন, নিত্যানন্দ ওদের ক্ষমা করে দেন ও তারা চৈতন্যের ভক্তে পরিণত হয়। নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজি  সংকীর্তন বন্ধের ফতোয়া দিলে নিত্যানন্দের নেতৃত্বে চৈতন্য ও তাঁর পার্ষদরা সংকীর্তন মিছিল করে কাজির বাড়ি ঘেরাও করে দীর্ঘক্ষণ সংকীর্তন চালিয়ে যায়, কাজি ফতোয়া তুলে নিতে বাধ্য হয়     

চৈতন্য যখন স্থির করেন যে সন্ন্যাস নেবেন একথা শুধু নিত্যানন্দকেই বলেছিলেন, তিনিই কটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীর সঙ্গে কথা বলে চৈতন্যের সন্ন্যাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে জানতে পেরে চৈতন্যর মা ও শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্য ক্রোধে নিত্যানন্দকে গালিগালাজ করেন, নিত্যানন্দ হাসি মুখে মেনে নেন। সপার্ষদ চৈতন্য সন্ন্যাস নিয়ে বাংলা ছেড়ে পদযাত্রায়  নীলাচলে যাচ্ছেন, সঙ্গে প্রধান সঙ্গী নিত্যানন্দ, ভার্গী নদীর তীরে বিশ্রাম নিচ্ছেন চৈতন্য, সেই অবসরে নিত্যানন্দ চৈতন্যের সদ্য প্রাপ্ত দণ্ড – কমণ্ডুলু নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন।  চৈতন্য মেনেও নিয়েছেন, তিনিই জানতেন নিত্যানন্দ তাঁর চেয়ে বড় সন্ন্যাসী। এক বিচিত্র স্বভাবের মহাসাধক ছিলেন নিত্যানন্দ। তিনি সমস্ত নিয়মের ঊর্ধে ছিলেন। এই নিত্যানন্দকে বুঝেছিলেন সমকালে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যাক্তি। যাঁর মধ্যে চৈতন্য ছিলেন অন্যতম।   শ্রীচৈতন্যর অনুরোধে তিনি সন্ন্যাস ত্যাগ করে গার্হস্থ্য গ্রহণ করেন, কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনের অনুশাসন তিনি মানতেন না।  এমনকী দুটি বিবাহ করেন। বৈষ্ণব হয়েও তিনি বৈষ্ণবোচিত আচরণ করতেন না। তন্ত্রমতে গৃহদেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর পুজো করতেন, সূত্রপাত হয় সহজিয়া তান্ত্রিকতা,  মদ- মাংস খেতেন, এই নিয়ে যাঁরা অভিযোগ তুলেছিলেন, নিত্যানন্দ শিষ্যরা তার জবাব দিয়েছেন, যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায় / তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়। তিনি থাকতেন পানিহাটিতে, সেখানে তিনি প্রথম চিঁড়া মহোৎসব করেন, সেই উৎসবে চণ্ডাল – যবন ইত্যাদি ৩৬ জাতের মানুষকে এক পংক্তিতে ভোজন করিয়ে জাতপাতের বেড়া ভেঙেছেন। এই  মহোৎসব ছিল বাঙালি হিন্দু সমাজে এক বৈপ্লবিক ঘটনা, নিত্যানন্দ এরকম অনেক মহোৎসবের আয়োজন করে জাতিভেদ ভেঙে মানুষকে সংগঠিত করেন।          

তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, যারা যবনদের আক্রমণে ভীত আর হিন্দু ব্রাহ্মণদের বিধানে সদা সন্ত্রস্ত,  নিত্যানন্দ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহজিয়া ভঙ্গিমায়। ধর্ম ত্যাগের রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গোটা বাংলায় তিনি চেয়েছিলেন সেই স্রোতকে বৈষ্ণব সহজিয়া রাজনীতি দিয়ে রুখে দিতে। তার জন্যে হিন্দু ধর্মের গোঁড়া ব্রাহ্মণদের সঙ্গেও সমান বিদ্রোহে যেতে হয়েছিল তাঁকে। এই আন্দোলনকে সফল করতে পাশে পেয়েছিলেন সপ্তগ্রামের ধনী বনিক সমাজকে।  সহজিয়া বৈষ্ণব আন্দোলনের জন্য থিম সং লিখলেন তিনি, ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ / কহ গৌরাঙ্গ / লহ গৌরাঙ্গের নামরে / যেই জনা গৌরাঙ্গ ভজে / সে হয় আমার প্রাণরে। বৈষ্ণবদের পরিচয় চিহ্ন দিলেন কপালে আর বাহুতে তিলক এবং গলায় কন্ঠি, বাদ্য যন্ত্র খোল – করতাল, প্রচলন করলেন চৈতন্যর মূর্তি পুজোর। একটি আন্দোলনের জন্য যা যা করার দরকার নিত্যানন্দ তাই করলেন, থিম সং হল, সেই গানের জন্য বাদ্যযন্ত্র হল, যা বাজাতে বাজাতে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা যায়, শরীরে পরিচয় চিহ্ন হল, যাতে লোকে দেখেই চিনতে পারে আর হল আন্দোলনের আইকন, চৈতন্য মূর্তি। শুধু আন্দোলন করেই ক্ষান্ত হলেন না, আন্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাস নথিবদ্ধ করার জন্য শিষ্য বৃন্দাবন দাসকে নির্দেশ দিলেন, যাতে ভবিষ্যতে মানুষ জানতে পারে, তাঁরা কী করেছিলেন, বৃন্দাবন দাস লিখলেন শ্রীচৈতন্যভাগবত’, বৈষ্ণবদের কাছে যা বেদপ্রতিম।                                                                                                               

আনুমানিক ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দই ছিল গোটা আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। নিত্যানন্দের  আন্দোলনের এই বৃহৎ তাঁবুর নীচে জড়ো হয়েছিল অগুনতি মানুষ, এঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, বণিক, শুদ্র সবাই ছিলেন, তাঁদের একটাই পরিচয় তাঁরা সহজিয়া বৈষ্ণব। দক্ষ সংগঠকের মতো নিত্যানন্দ সারা বাংলায় ১২ জন প্রধান সাংগঠনিক কর্মকর্তা নিয়োগ করেন, যাঁরা দ্বাদশ গোপাল নামে খ্যাত, এঁদের মধ্যে  ৯ জন ব্রাহ্মণ, ১ জন বৈশ্য, ২ জন বৈদ্য। এই তালিকায় যারা ঠাঁই পাননি অথচ প্রভাবে প্রতিপত্তিতে এই পদের দাবি রাখেন তাদেরও তিনি হতাশ করেননি, দ্বাদশ গোপালদের প্রত্যেকের অধীনে ৮ জন  উপ-গোপাল নিয়োগ করেন।   এইভাবে জাতপাতের বাইরে এক বিরাট সংগঠন তৈরি করেন তিনি, শাসকও এঁদের সমঝে চলতো। আরেকটি বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন তিনি তা হল,  তিনিই প্রথম সংকীর্তনে মেয়েদের অংশ গ্রহণ করতে বলেন,এব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয়  স্ত্রী জাহ্নবা।  জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে নিত্যানন্দের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, কুলবধূ নাচাইমু কীর্তনানন্দে / অন্ধ – বধির – পঙ্গু নাচিবে স্বছন্দে  এমনকী নারী যে গুরু মা হতে পারে, দীক্ষা দিতে পারে – এই সবই নিত্যানন্দ প্রচলন করেন।  

চৈতন্য জানতেন তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, সমাজের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ নেই, তাহলে যে আন্দোলনের বীজ তিনি আর নিত্যনন্দ রোপণ করলেন, সেটা তো নষ্ট হয়ে যাবে, কারণ গৃহীর কথাই গৃহী মানুষ শুনবে, সন্ন্যাসীর কথা শুনবে না।  তাই নিত্যানন্দকে বিবাহ করে গৃহী হতে বলে তাঁকে আন্দোলনের প্রধান পুরুষ নির্বাচিত করলেন, তাঁর নামে চৈতন্যর কাছে কম নিন্দা করেননি অন্য ভক্তরা, যাঁরা নিত্যানন্দর বিরোধী , এসব শুনে চৈতন্য শুনে হাসতেন।             

তাই সহজিয়া বৈষ্ণবদের কাছে নিত্যানন্দ, তাঁদের প্রিয় নিতাই বা নিতাইচাঁদ বড় আদরের, তাঁরা প্রথমে তাঁকে স্মরণ করেন, তারপর চৈতন্যকে স্মরণ করেন। বাউলরা গান শুরু করার আগে যে গুরুবন্দনা করেন, তার প্রথম লাইন জয় জয় শ্রীগুরু প্রেমানন্দে / নিতাই গৌর হরি হরি বলো। বৈষ্ণবরা মাধুকরীতে এলে বাড়ির দরজায় জয় নিতাই বলে জানান দেন।  লালন তাঁর গানের প্রথম লাইনে নিতাইকে স্মরণ করেছেন এইবলে আগে ধর চরণ ছেড়ো না / নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না আর শেষ লাইনে লিখেছেন, ফকির লালন বলে মন চল যাই / এমন দয়াল মিলবে না ভবে / নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না   

More Articles