বাংলার এই দুঃসাহসী সাংবাদিককে ঠাণ্ডা করতে সেদিন লেঠেল পাঠিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি

হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬), যিনি নিজেকে কাঙাল হরিনাথ বলতেন, উনিশ শতকের উজ্জ্বল প্রান্তিক ব্যক্তিত্বদের একজন। প্রান্তিক- কারণ তিনি নিজের নামের আগে কাঙাল বিশেষণটি বসিয়ে সমাজের কেন্দ্রীয় মূলস্রোত থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছেন, নিজের অবস্থানকে নিয়ে গেছেন সমাজের প্রান্তে। সেখান থেকেই সমাজের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় ন্যারেটিভ, শাসক ও শাসিতের যাবতীয় ডিসকোর্স তিনি লিখে গেছেন। অনাথ, দরিদ্র, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বঞ্চিত, স্বশিক্ষিত এই মানুষটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জীবনভর সংগ্রামের কথা পড়লে আপামর বাঙালি পাঠক তাদের এক বিস্মৃতপ্রায় পূর্বসুরির সম্পর্কে গর্ববোধ করতে পারে।

উনিশ শতকে নবজাগরণ বা রেনেসাঁ-র কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষ। সেই সময় কলকাতা থেকে বহু দূরে, তৎকালীন নদিয়া জেলার কুমারখালি (বর্তমানে বাংলাদেশ) গ্রামে ওই রেনেসাঁ-র উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে বাংলায় প্রথম কাউন্টারকালচার সাংবাদিকতার সূত্রপাত করেন স্বশিক্ষিত হরিনাথ মজুমদার।

শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে চরম দারিদ্রের সঙ্গে বোঝাপড়া করে হরিনাথ লেখাপড়া শিখেছিলেন সামান্যই, আক্ষরিক অর্থে বিভিন্ন প্রতিবেশীর বাড়িতে খেয়ে তাঁর দিন কাটত, একটু বড় হলে তিনি কুমারখালি বাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ নিতে বাধ্য হন, তখনও তাঁকে বালকই বলা যায়। এরপর কৈশোরে ইংরেজদের নীলকুঠির হেড অফিস কুমারখালি নীলকুঠিতে (যার অধীনে ৫১টি নীলকুঠি ছিল) শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন নীলকুঠিতে চাকরি করার পর, নীলকর সাহেবদের অত্যাচার দেখে দেখে ক্লান্ত হরিনাথ যৌবনে পৌঁছে নীলকুঠির চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গেলেন। তখন ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ বিখ্যাত কাগজ, সটান সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে কাজ করার ইচ্ছে জানান, চাকরি হয়েও যায়। কিছুদিন কাজ করার পর হরিনাথ দেখলেন, এই কাগজ শুধু কলকাতার বাবুদের কথা লেখে এবং ইংরেজের বিরুদ্ধে কিছুই লেখে না। তখন হরিনাথ চাকরি ছেড়ে আরেক বিখ্যাত ইংরেজি কাগজ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এ সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ তখন ব্রিটিশ নীলকর সাহেবদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করছে। প্রথমে কিছুদিন হরিনাথ উত্‍সাহের সঙ্গে কাজ করলেও, তাঁর মনে হল, এই ইংরেজি ভাষার কাগজ তাঁর গ্রামের লোক পড়তে পারে না, যারা নীলকর সাহেবের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে বা অন্য কারণে ব্রিটিশ সরকারের শোষণের শিকার।

আরও পড়ুন: বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল

১৮৬৩ সালে, ৩০ বছর বয়সে হরিনাথ ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর চাকরি ছেড়েদিলেন, পরিকল্পনা করলেন নিজের কাগজের, সেই বছরই এপ্রিল মাসে কলকাতার ২৩ নং আপার সার্কুলার রোডের মির্জাপুরের গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের প্রেস থেকে প্রকাশিত হল বাংলা ভাষায় হরিনাথের নিজের কাগজ, মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’, তিনিই সম্পাদক ও প্রকাশক। এই বছর এপ্রিলে সেই সংবাদপত্রটি ১৫৯ বছর সম্পুর্ণ করল। মনে রাখতে হবে, এর আগে, ১৮৫৫ সালে, ২৫ বছর বয়সে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি কুমারখালিতে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং গ্রামের সাধারণ লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকরূপে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হরিনাথ সারাজীবন কাজ করেছেন।

পত্রিকা ছাপার ব্যাপারে কলকাতা-নির্ভরতা হরিনাথের পছন্দ ছিল না, তাঁর ইচ্ছে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ গ্রাম থেকেই প্রকাশ হবে, শহর থেকে নয়, যে শহর গ্রাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু টাকা নেই, যে নিজে ছাপাখানা কিনবেন। বছরদশেক কলকাতা থেকে ছাপানোর পর সুযোগ এল বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র (পরবর্তী কালে বিখ্যাত ঐতিহাসিক) কাছ থেকে। বন্ধুর বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয়-র একটি ছাপাখানা ছিল, নাম তাঁরই নামানুসারে ‘এম.এন. প্রেস’। মথুরানাথ ছেলের কথায় সেটি হরিনাথকে দান করে দেন। ছাপাখানায় ছিল লণ্ডনের ডিক্সন অ্যাণ্ড কোম্পানির কলম্বিয়া ১৭০৬ মডেলের ডাবল ক্রাউন সাইজের মেশিন। ১৮৭৩ থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ কুমারখালি থেকে প্রকাশ হতে শুরু করল, হরিনাথের স্বপ্নপূরণ হল।

পত্রিকাটি প্রথমে মাসিক, পরে পাক্ষিক ও শেষে এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও কৃষকদের প্রতি তখনকার নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হত। ফলে ব্রিটিশ সরকার এবং স্থানীয় জমিদারদের পক্ষ থেকে তাঁকে নিয়মিত ভয় দেখানো হত। কিন্তু তিনি নির্ভীকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। এসব কারণে পত্রিকাটি তখন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে হরিনাথ পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকা প্রকাশ, ইস্কুল পরিচালনা, মামলার খরচ এইসব সামলানোর জন্য টাকা দরকার। অনেক দৌড়ঝাঁপের পর রাজশাহীর রানি স্বর্ণকুমারী দেবী রাজি হলেন অর্থসাহায্য করতে, টানা ১৮ বছর তিনি হরিনাথকে টাকা জুগিয়ে গেছেন বিনা শর্তে।

‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সে যুগে জমিদার, মহাজন, পুলিশ, ব্রিটিশ সরকার, এমনকী জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিল। এজন্য তার জন্য প্রায়ই কোর্ট থেকে মানহানির শমন ও সতর্কতাপত্র আসত এবং সরকারি নির্দেশে মাঝে মাঝে পত্রিকা বন্ধ রাখতে হত। কুমারখালি ছিল ঠাকুরদের জমিদারির আওতায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হরিনাথকে শায়েস্তা করতে লাঠিয়াল বাহিনী পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন। এই খবর পেয়ে হরিনাথের বন্ধু ও প্রতিবেশী লালন ফকিরের শিষ্যরা একতারা ফেলে সড়কি-বল্লম নিয়ে লাঠিয়ালদের কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-তেই লালন ফকিরের গান প্রথম প্রকাশিত হয়।

এছাড়াও পত্রিকায় গ্রামসমাজের সমস্যা ও সংস্কৃতির বিষয়গুলো নিয়ে লেখা এবং গ্রামসমাজ সম্পর্কে নির্লিপ্ত শহরের মানুষকে সচেতন করে তোলার বিষয়েও লেখা থাকত।

পাবনা কৃষক বিদ্রোহের সময় কলকাতার 'সোমপ্রকাশ', 'অমৃতবাজার পত্রিকা' কৃষকপ্রজাদের পক্ষ নেয়নি, কিন্তু ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ অসহায় কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। পাবনার কৃষক বিদ্রোহ-কালে তাকে জমিদার-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও হরিনাথ জানান- ‘গ্রামবার্ত্তা জমিদার কি প্রজা কাহারও স্বপক্ষে বা বিপক্ষে নহে। অত্যাচার ও অসত্যের বিরোধী।' নীল চাষ করার ফলে চাষীদের ঘরে আর্থিক দুরবস্থা কোন পর্যায়ে ছিল এবং নীলচাষীদের অত্যাচারের ফলে তাদের দুরবস্থা ঠিক কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, সেটাও হরিনাথ তাঁর পত্রিকায় তুলে ধরেছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-য় নদী ও জলনিকাশি সংস্কার, ডাক ও পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কার- ইত্যাদি গ্রামীণ মানুষের দাবিদাওয়া উপস্থাপিত করা হয়েছিল। ডাকঘরের মাধ্যমে মানি অর্ডারের ব্যবস্থা প্রচলনের কথা বলা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: বাংলা কল্পবিজ্ঞান শুরু হয়েছিল তাঁর হাতেই, জগদানন্দকে মূলস্রোত ঠাঁই দেয়নি

হরিনাথের জীবন ও কর্ম উদ্দীপিত করেছিল এমন কয়েকজন মানুষকে, যাঁরা হরিনাথের ভাবশিষ্যরূপে পরিচিত ছিলেন, যাঁদের আমরা উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি মণীষার জগতে নক্ষত্র বলেই জানি। তাঁরা হলেন জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব, দীনেন্দ্রকুমার রায়, মীর মোশাররফ হোসেন। বলা বাহুল্য, এঁরা হরিনাথের বন্ধু ছিলেন। হরিনাথ ‘বিজয় বসন্ত’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) ও কুমারখালির হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ (১৮৫৯) গ্রন্থদু'টিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেন। ‘বিজয় বসন্ত’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ শ্রেণির পাঠ্যতালিকাভুক্ত ছিল।

বিভিন্ন বাস্তবিক কারণে একসময় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন হরিনাথ। লালন ফকির ছিলেন হরিনাথের বন্ধু ও প্রতিবেশী, লালনের প্রভাবে তিনি অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই পর্বে, ১৮৮০ সালে তিনি ফিকিরচাঁদ ফকির নাম নিয়ে বাউলগানের দল তৈরি করেন। হরিনাথ ১০০টি বাউলগান লেখেন এবং তাঁর গানের দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়াতেন। গানের দলটি ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল নামে পরিচিতি পায় এবং গ্রামসমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে’- এই বিখ্যাত গানটি হরিনাথের লেখা ও গাওয়া ।

এই যে জীবনকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতে বইয়ে দেওয়া, এক জীবনে বহু জীবনযাপন করা, কোনও স্থায়ী পেশায় যুক্ত না থেকে- এভাবে বেঁচে থাকা বড় কঠিন। হরিনাথ তাঁর ৬৩ বছরের জীবন এভাবেই কাটিয়ে গেছেন।

More Articles