স্পাই নাকি প্রেমিক? পারমাণবিক বোমার সূত্র ‘পাচারের অভিযোগে’ মরতে হয়েছিল যাঁদের
The Rosenberg Trial: ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল রোজেনবার্গ দম্পতিকে। জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও এথেল রোজেনবার্গ। পরমাণু বোমার সূত্র পাচারে একমাত্র প্রাণদণ্ড পাওয়া আসামী।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট। আমেরিকার বানানো দুটো পারমাণবিক বোমা পুরোপুরি মুছে দিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরদু'টির অস্তিত্ব। অবশেষে সাফল্য পেল ১৯৪২ সালে অত্যন্ত গোপনে শুরু হওয়া আমেরিকার ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। বিজ্ঞানী রবার্ট. জে. ওপেনহাইমারের অধীনে তখন এই প্রজেক্ট জড়ো হয়েছিলেন সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা। প্রজেক্টের চূড়ান্ত গোপনীয়তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী ক্লাউস ফুকস ক্যামেরার ফিল্মে করে পরমাণু বোমার ফর্মুলা পাচার করে দিয়েছিলেন রাশিয়ার গুপ্তচরের কাছে। নারায়ণ সান্যালের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিশ্বাসঘাতক’ যারা পড়েছেন তাঁদের কাছে এই গল্প নতুন নয়। কিংবা ক্রিস্টোফার নোলানের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’-এ এই ক্লাউস ফুকস সমহিমায় উপস্থিত আছেন। অথচ ফুকস তো বটেই, অন্য পাচারকারীরাও প্রাণে বেঁচে গেলেন। মাঝখান থেকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল রোজেনবার্গ দম্পতিকে। জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও এথেল রোজেনবার্গ। পরমাণু বোমার সূত্র পাচারে একমাত্র প্রাণদণ্ড পাওয়া আসামী।
আরও পড়ুন: উল-কাঁটার নকশায় গোপনে খবর পাচার! বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন বাড়ির মেয়েরাই
কিন্তু আদৌ কি তাঁরা বোমার খবর পাচার করেছিলেন, নাকি তাঁদের শাস্তির পিছনে ছিল কোনও গভীর চক্রান্ত? কারাই বা এই রোজেনবার্গ দম্পতি? তার জন্য কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হয়। তাঁদের প্রেমকাহিনি শুরু হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। কিছুদিনের মধ্যে তাঁঁরা বিয়েও করেন। দু'জনেই ছিলেন ইহুদি আমেরিকান। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জুলিয়াস রোজেনবার্গ আমেরিকান যুদ্ধবিভাগের বিশেষ গবেষণা দপ্তরে চাকরি পান। ১৯৪৫ সালে জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জুলিয়াসকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। কারণ, তিনি আগে আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কথাটা সত্যি। তার থেকেও বড়ো সত্যি হল যে ইউরোপের পূর্ব দিকে স্তালিনের হাত ধরে সোভিয়েত রাশিয়ার উত্থান। শুরু হল ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ। নামেই সাম্যবাদ বা পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব, আসলে সাম্রাজ্যবাদের নতুন অঙ্ক কষতে গিয়ে গোটা বিশ্ব দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। দু’দেশেই শুরু হল ‘গুপ্তচর’ খোঁজার কাজ।
১৯৪৯ সালে রাশিয়া তাদের প্রথম অ্যাটম বোমা পরীক্ষা করার সাথে সাথেই আমেরিকার টনক নড়ে। যুদ্ধের সময় কোটি কোটি ডলার খরচ করে, অত্যন্ত গোপনে যে অস্ত্র তারা তৈরি করেছে, তার হদিশ রাশিয়া কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে গেল? তবে কি তাদের বোমার সূত্র গোপনে পাচার হয়ে গেছে? কীভাবে হল, কারাই বা করল? ১৯৫০ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা, মানে এফ.বি.আই ক্লাউস ফুকস, হ্যারি গোল্ড ও ডেভিড গ্রিনগ্লাসকে গ্রেফতার করে। এই ডেভিড ছিলেন এথেল রোজেনবার্গের ভাই। জেরায় ডেভিড জানায় এথেল তাঁকে গুপ্তচরের কাজে নিয়োগ করেন এবং জুলিয়াসের মাধ্যমে ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর গুপ্ততথ্য তাঁর কাছে এসে পৌঁছত। যে খবর তারা পাঠিয়ে দিত রাশিয়ায়।
অথচ সোভিয়েত রাশিয়া তাদেরকে ‘গুপ্তচর’ বলে মেনে নেয়নি। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে আমেরিকার তথ্য ছাড়া অ্যাটম বোম বানানোর ক্ষমতা আমাদের আছে। ফলে আমেরিকাকেও রোজেনবার্গদের শাস্তি দিয়ে এটা দেখাতেই হত যে, এই এরাই হচ্ছে সেই গুপ্তচর। যাদের সাহায্য ছাড়া রাশিয়া কখনই বোমা বানাতে পারত না। বিশ্বের বহু বিখ্যাত মানুষ সেদিন রোজেনবার্গদের শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই তালিকায় নাম ছিল পোপ দ্বাদশ পিয়াস, জঁ পল সাত্র, জন কঁকতো, আলবার্ট আইনস্টাইন, বের্টোল্ট ব্রেশট, ফ্রিদা কাহলো, পাবলো পিকাসো প্রমুখের। কিন্তু হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। সব মিলিয়ে ১৯৫৩-র ২০ জুন আমেরিকার সিং সিং কারাগারে তাঁদের ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়।
অনেক পরে, ২০০১ সালে ডেভিড গ্রিনগ্লাস একটি সাক্ষাৎকারে জানান, সেদিন আমেরিকা সরকারের পরামর্শে স্ত্রী ও নিজেকে বাঁচাতে তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দেন । এমনকী কিছুদিন যন্ত্রপাতি পরিচালনার কাজে ম্যানহাটান প্রজেক্টেও ছিলেন ডেভিড। অথচ তাঁকে মাত্র সাড়ে ন’বছর জেল খাটতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯৫ সালে ফাঁস হয়ে যাওয়া ‘ভেনোনা প্রজেক্ট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী জুলিয়াস গুপ্তচরবৃত্তির কাজে যুক্ত থাকলেও এথেলের যুক্ত থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শাস্তির সত্তর বছর পরেও রোজেনবার্গদের দুই ছেলে রবার্ট ও মাইকেল তাঁদের মা-কে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন।
কেউ বলেন তাঁরা গুপ্তচর, কেউ বলেন তাঁরা এ যুগের রোমিও-জুলিয়েট। যখন রোজেনবার্গ দম্পতিকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে , তখন তাঁদের চুম্বনরত ছবি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। জেলে থাকা অবস্থায় বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ। বহু বাধার দুয়ার, সেন্সর পেরিয়ে তাঁরা একে-অপরকে বেশ কিছু চিঠি পাঠাতে পেরেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে ‘রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ’ নামে যেগুলি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। কোর্টরুমে দেওয়া জবানি নয়, এই চিঠিগুলোই তাঁদের কাহিনির শেষ প্রমাণ।
আরও পড়ুন: ১০০ বছর পর এসে পৌঁছল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ‘রহস্যময়’ চিঠি, কী লেখা রয়েছে সেখানে?
এ চিঠি কোনও বিশ্বাসঘাতকের নয়, নয় কোনও কমিউনিস্ট গুপ্তচরের, কিংবা মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকা দু'টি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষেরও নয়। চিঠিগুলি মধ্য তিরিশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই স্বপ্ন দেখা প্রেমিক-প্রেমিকার আশাবাদের সলজ্জ প্রকাশমাত্র। যে প্রেম মানুষকে দেউলিয়া করে, যে ভালোবাসা নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে জানে, বিদ্যুৎ চেয়ারের প্রবাহ তাঁর আর কী করতে পারে? সেই প্রেমের আত্মত্যাগের কথা মনে রেখে পরবর্তীকালে বব ডিলান গাইলেন,
Someone said the 50s was the age of great romance
I say that’s just a lie, it was when fear had you in a trance
Julius and Ethel.