জীবন জুড়ে এখন শুধুই অ্যানুয়াল পরীক্ষা, শুধু হারিয়ে গিয়েছে ছুটির হাওয়া
Madhyamik Exam: সবাই মিলে কিছু টাকা চাঁদা দিলে এক সেট প্রশ্নপত্র ম্যানেজ হবে। তখন আমরা এক একজন সাক্ষাৎ টাইটানিকের মডেল, একটা কুটোই যথেষ্ট।
কুয়াশার শেষ ফ্লাইওভার মুছে দিয়ে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আর এরকম মোক্ষম রোম্যান্টিক সময়ে তার আগমন। আজ্ঞে না, প্রেমের কথা হচ্ছে না। প্রেম তো অতিথি। তার আসার আবার সময়, তিথি, নক্ষত্র কিছু হয় নাকি? তার আসার হলে সে গুমোট ভাদ্রমাসেও আসতে পারে। না, বসন্ত নিঃসন্দেহে প্রেমের পক্ষে সুন্দর কিন্তু কার দরজায় প্রেম কবে কড়া নাড়বে তা তো কেউ বলতে পারে না, কিন্তু মৃত্যুর মতো নিশ্চিত চরণে সে এসেছে এবং আমার শৈশব, কৈশোরকে জ্বালিয়ে খেয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার রুটিন পেলে সবার আগে দেখে নিতে হতো দোলের থেকে সে নিরাপদ দূরত্বে আছে কিনা। যদি তা না হতো তাহলে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চক দিয়ে বানানো রুটিন নিমেষে আমাদের পৃথিবীও সাদা কালো করে দিত। মনে হতো কে যেন আমাদের সমস্ত রঙ শুষে নিয়েছে, একটা গোটা দোল মিস হয়ে যাবে ভাবলেই চোখ অন্ধকার লাগত।
এরকম অঘটন খুব বেশি ঘটত না, তবে বার্ষিক পরীক্ষা নিজেই আমার কাছে একটা অঘটন। পড়তে বসলেই সারা বছর যার দিবাস্বপ্ন দেখে কেটে যায়, সিলেবাস পড়ে থাকে আগামিকালের জন্য, তার জন্য পরীক্ষা সুখবর হতে পারে না, আর যাই-ই হোক সুখবর হতে পারে না। তার উপর এই সময়টা মাঠে থাকার আদর্শ সময়। গোটা শীত ক্রিকেটের আধিপত্যে চুপসে যাওয়া ফুটবল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে পাম্পারের সাহচর্যে। মাঠের এ কোণ থেকে ও কোণ চিৎকার ছুটে যাচ্ছে 'ম্যান বি' অর্থাৎ পিছনে ডিফেন্ডার। ছোট গোলের খেলায় গোলকিপারের কোনই কৌলীন্য নেই, কাজেই কেউ হতে চায় না। রোজ ঝামেলা খেলা শুরুর আগে। তো এই সব মহাজাগতিক চিন্তায় মন যার আচ্ছন্ন তার পক্ষে ডিগবয়ের তেলের খনি নিয়ে ভাবিত হওয়া কঠিন শুধু নয়, সিধু জ্যাঠার ভাষায় আম পচে বেল! তাই এমনকী উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার সময়ও একটা দিন মাঠ ছেড়ে থাকিনি। থাকতে পারিনি। কিন্তু খেলার পর মাঠে বসে আড্ডার যে বিস্তারিত অনুষ্ঠানসূচি, তাতে বিলক্ষণ কাটছাঁট করতে হতো।
আরও পড়ুন-হাতকাটা দুঃখরা ফুলহাতা হয় শীতেই, খোসা ছেড়ে আসে কমলালেবু, না হওয়া প্রেমরা…
কিন্তু পড়াশোনা একটা অভ্যাস, সারা বছর যে পড়েনি সে শেষদিন পড়তে বসে উলটে দেবে তা তো আর হতে পারে না। কাজেই অচিরেই নিউটন ছেড়ে শাহরুখ বা শচিনের কথা ভাবছি, নিজেই খেয়াল করে নিজেকে বকে আবার ফেরাতাম সিলেবাসের রাস্তায়। এই আসা যাওয়ার মাঝেই চলে আসত পরীক্ষার সময়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথমদিন! জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, হলঘর জুড়ে কপালে লাগানো দইয়ের পরিমাণ যেকোনও মিষ্টির দোকানকে টেক্কা দেবে। আমাদের সঙ্গে নিয়মমাফিক অন্য স্কুলের সিট পড়েছে। উত্তরপত্র দিয়ে গেছে, ঘণ্টা পড়লে প্রশ্নপত্র দেবে। হঠাৎ শুনি কে যেন কাঁদছে। তাকিয়ে দেখি, আমার পাশে বসা অন্য স্কুলের ছেলেটা উত্তরপত্রে মুখ দিয়ে কাঁদছে। স্যারও দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। কান্না সামলে ছেলেটি যা বলল তার মর্মার্থ, সে জানত আজ বাংলা পরীক্ষা, ইংরেজি প্রশ্নপত্র পেয়ে সে যারপরনাই ভেঙে পড়েছে। শুনে তো ক্লাস হাসছে। স্যার ওকে বোঝালেন, ওর তথ্য অভ্রান্ত। অর্থাৎ আজ বাংলা পরীক্ষাই বটে। প্রথম পাতায় যেটা দেখে ও আঁতকে উঠেছে তা ইংরেজি প্রশ্নপত্র নয়, নিয়মাবলী! সেই শুনে ও নিরস্ত হল।
আরও পড়ুন- বাবা বলেছিল, এই দুঃখটা কখনও ভুলবি না
উচ্চমাধ্যমিক সামনে। হঠাৎ উদভ্রান্তের মতো সেন্টু হাজির। চোখ দুটো বনবন করে ঘুরছে, ঘনঘন থুতু ফেলছে। সিঁড়ির নিচে পাম্পের ঘরে মিটিং হলো।আমরা যারা যারা বুঝেছি সায়েন্স নিয়ে কেস গুবলেট করেছি, তারা সকলেই উপস্থিত। সেন্টুর কাছ থেকে জানা গেল, কোনও এক খুফিয়া সূত্রে ও খবর পেয়েছে, সবাই মিলে কিছু টাকা চাঁদা দিলে এক সেট প্রশ্নপত্র ম্যানেজ হবে। তখন আমরা এক একজন সাক্ষাৎ টাইটানিকের মডেল, একটা কুটোই যথেষ্ট।পরীক্ষার আর একমাস বাকি সাকুল্যে, চোখে নার্সারি দেখছি। শুধু সর্ষে নয়, নানা রকম ফুল সেই বাগানে। জোগাড় করা হলো টাকা, আমরা পুরোদমে শুরু করতে যাব মুখস্থ করা, তক্ষুণি খবর পেলাম চুনা লেগে গেছে! ওটা পুরুলিয়ার একটা স্কুলের টেস্টপেপার! সুমিত সেন্টুকে কী করেছিল জানি না তবে পুরো পরীক্ষা সেন্টু খুঁড়িয়ে হেঁটেছিল। শঙ্কর স্যার স্কুলে অঙ্ক প্রশ্ন করলে হাহাকার পড়ে যেত। স্যার খাতা দেখিয়ে ক্লাস থেকে বেরচ্ছেন, ক্লাসরুম না কলিঙ্গ যুদ্ধপ্রান্তর বোঝা দায়। আমি আজও বা আমরা বন্ধুরা কেউই আজ অবধি শঙ্কর স্যারের অত কঠিন প্রশ্নের যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি।
যেদিন থেকে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল সেদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেল পরীক্ষার পরের অবিমিশ্র ছুটিও। আজ হয়তো রোজ পরীক্ষা দিচ্ছি কিন্তু ছুটি ঘোষণা করার আর কেউ নেই। আমাদের ছুটির পুকুর বুঁজিয়ে কেউ বেআইনি বহুতল তুলে দিয়ে চলে গেছে। নিচের তলায় এটিএম। শুধু অনেকদিন না খেলে ফেলে রাখা ক্যারাম বোর্ডে রয়ে গেছে ছুটির দুপুর কিছু। জানি, কিন্তু দুপুর ফেরত পাওয়ার উপায় যে আর নেই তাও জানি। ফাইন দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই যে।