অতল খাদের আহ্বান থেকে হতভাগাদের মুক্তি নেই
বীজি রোজ এসে বসতেন ধাবার ক্যাশে। বোধহয় অপেক্ষা করতেন, বোধহয় রোজ উলের কাঁটায় উল জড়িয়ে, অবচেতনেও বীজি-রা পারেন নিরুদ্দেশের কর্কষ সত্যকে ডাহা অস্বীকার করতে, বোধহয় এই ওমের নামই অভাগীর স্বর্গ…
বরবিলে আমাদের বাড়িটা যেখানে ছিল, সেটা এক রকম বর্ডারই বলা যায়। মাত্র কয়েক পা হেঁটেই একটা রেলগেট। তার পরই দু’ধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যে সদ্য স্বাবলম্বী হওয়া রাস্তা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যেত অজানা সব পাখির ডাক, তাকে মানচিত্র বলেছিল, তুমি বিহার। ঝাড়খণ্ড তখনও বিপ্লবে-বিদ্রোহে। এক দিন যেমন অনেক আগে স্কুল ছুটি হয়ে গেল আমাদের। আমার স্কুল ছিল সেন্ট মেরি’জ। ঠিক মনে পড়ছে না, লাইব্রেরি ক্লাস না গেম্স, কীসের জন্যে যেন বেরোতে যাবো সব লাইন করে, হঠাৎ প্রেমদানী টিচার, আমাদের হিন্দি পড়াতেন, খানিক হতভম্ব হয়ে ক্লাসে ঢুকে খুব নিচু স্বরে বললেন, "সব ব্যাগ গুছিয়ে নাও। লাইব্রেরি বা গেম্স কিছুই হবে-টবে না, হেড ডাউন করে থাকো সবাই। যতক্ষণ না আমাদের প্রিন্সিপাল এরপর কী করা হবে, তা বলছেন।" আমরা সবাই থ। মানে কী? আগের সপ্তাহে টিভিএস রাও ঠিক গেম্স পিরিয়ডে যাওয়ার মুহূর্তে প্যান্টে পটি করে ফেলেছিল বলে আমাদের কয়েকজনকে স্যর পাঠালেন, ওর সঙ্গে। ওর সঙ্গে মানে, আমরা দাঁড়ালাম এক রকম গজগজ করতে করতে টয়লেটের বাইরে, টাস্ক হল দেখা যে রাও যেন আর নতুন করে ব্যাপারটা হাতের বাইরে নিয়ে না যায়! অবশ্য এই এত দিন পর লিখতে বসে গজগজটাই প্রথম মাথায় এল, কারণ এখন দিনকাল শেষে এমনটাই ডিফল্ট মোড, তবে সে সব মাঝ-আশি’র হাওয়া-রোদ যে হুডখোলা আশিকির জন্ম দিত, তাতে গজগজের চেয়ে অধিক আসত হুল্লোড়। রাও-য়ের ল্যাজেগোবরে অবস্থা দেখে আর কী! আমি, খুব সম্ভবত অজিত, অরুণাভ আর কেউ একটা ছিলাম টয়লেটের বাইরে। রাও বেরোল ভেজা প্যান্ট-ফ্যান্ট নিয়ে, ওই নিয়েই স্কুল বাসে বাড়ি যাবে, ভাগ্যিস লাস্ট পিরিয়ড ছিল।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
সে যাই হোক, সে দিন গেম্স মিস হল, কিন্তু এ দিন আবার মিস হবে গেম্স? কেন? প্রেমদানী টিচার এ দিকে আমাদের হেড ডাউন করিয়ে, নিজে আড়চোখে দেখি, দেখছেন বাইরে, ফিল্ডের দিকে। সুখবীর, তিন বার ফেল করে তখন আমাদের সঙ্গে পড়ছে, হঠাৎ পাকামো করে বলতে গেছে- টয়লেট যাবে, অমনি খেল ধ্যাতানি। আমাদের চাপা হাসি, ওর আবার হেড ডাউন। কিছুক্ষণে আমাদের বলা হল, লাইন করে চুপচাপ স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে। বেরিয়ে যাবো? তখনও খান তিনেক ক্লাস বাকি। লাস্ট পিরিয়ড অঙ্ক, সেটা হবে না বুঝে, মন পরজাপতি ফড়ফড়িং কিন্তু এ কী, আমাদের ফিল্ডে ওরা কারা? সিস্টার অ্যানি, আমাদের প্রিন্সিপাল, তাঁর ঘরের সামনে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। পাশেই একজন, অল্প ময়লাটে খাটো একটা ধুতি আর সাদাটে পাঞ্জাবি পরে। সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, স্মিত হাসি। লাইন করে বেরিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের তিনি সন্তর্পণে শুধোচ্ছিলেন স্নেহকুচি। কিন্তু ফিল্ডে ওরা যে ভাবে দাঁড়িয়ে, তা দেখে আমাদের স্নেহকুচি মাথায়, দেহ কুচি কুচি না হয়ে যায় সে ভাবনায় প্রাণ গিয়েছিল কুঁকড়ে। অন্তত শ’খানেক পেটানো চেহারার যুবক, খালি গা খাটো ধুতি পরা, ধনুকে তির ভরা আর ওঁচানো তির মাখা সাদা কোনও এক পদার্থ। অন্য একটা ক্লাসের বি সেকশনের কেউ এক জনের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেয়েই, সেই খোঁচা দাড়ি ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সিস্টার অ্যানিকে কিছু একটা বলেই, অন্য এক ভাষায় দু'টি কথা বললেন সঙ্গীদের। ওরা সে দিন আর ওভাবে তির উঁচিয়ে দাঁড়ায়নি।
সেই আমার প্রথম বন্ধ দেখা, সেই আমার প্রথম শিবু সোরেন দেখা। আমি, আমাদের পাশের বাড়ির বান্টি, ছোটু আর এক-দু’জন, সবাই মিলে সাধারণত আমাদের একটা জিপ ছিল, তাতে করেই স্কুল আসতাম যেতাম। হঠাৎ করে শিবু সোরেন এসে স্কুল বন্ধ রাখার অনুরোধ জানালেন। কী করেই বা সবাইকে খবর দেবেন সিস্টার অ্যানি, সবার বাড়িতে তো ফোন-ও নেই। তো বাবাকে জানানো হয়েছে, কিন্তু বাবা তখন কাজে নোয়ামুন্ডি। মায়েরও হঠাৎ আসতে সময় লাগবে, তাই ব্যবস্থা হল যে কিছুটা পথ আমরা কয়েক জন হেঁটে চলে আসব, ততক্ষণে বান্টি-ছোটুর বাবা, আমি যাঁকে ডাকতাম আন্টিকাকু বলে, তিনি চলে আসবেন। বাকিটা তাঁর সঙ্গেই। আন্টিকাকুকে আন্টিকাকু বলতাম কারণ প্রথমে আমি দেখেছিলাম বান্টির মা’কে- আন্টি। তার পর দেখি অপুর সংসারের সেই বিখ্যাত স্টিল ছবিটির মতো, আন্টির পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছেন এক কাকু, তো ইনি কে? আলবাৎ আন্টিকাকু।
আন্টিকাকু অবধি পৌঁছনোর আগে সহসা দিনের আলোয় নিভতে বসা দোকান-বাজারের মধ্যে দিয়ে আসার সময় আমার পাশে ছিল সেই সুখবীর। চুলে নাকি মেহেন্দি করত তখনই, তাই ওরম হলুদ রং। আর ওর হাত থেকে অপূর্ব একটা আচার খাওয়ার পর অনেক দিন হাত না ধুলে, শুকিয়ে গেলে যে চমৎকার একটা গন্ধ বেরোয়, তেমনই একটা গন্ধ বেরত। ওদের একটা ধাবা ছিল বরবিলেই। সুখবীরের বাবা চালাতেন। সুখবীর বলত 'ঢাবা', আদত উচ্চারণ। ধাবা মানে ওই খাবার হোটেল আর কী। হাইওয়ের’র ধাবা তো নয় যে খাটিয়া পাতা থাকবে। অপূর্ব একটা সুখা মাটন করত, কালো কালো দেখতে, তেল চুঁইয়ে পড়ত আর জিভে ঝালের যা সংসার রচত না..! ওই বলে না 'বাপের নাম খগেন' হয়ে যাবে। সুখবীর-ও জানত, কয়েক দিন পর ওর বাবার জায়গায় ও-ই বসবে, তাই ক’বার ফেল করল, তাতে ওর বয়েই গেছিল। তো কৌতূহলবশত হোক বা ঠিক মনে পড়ছে না কেন, আমি ওকে প্রশ্ন করি যে, "তুঝে কুছ ফরক নহি পড়তা, ইতনি বার ফেল করতা হ্যায়? ঘর মে কোই কুছ নহি কেহতা? পিটাই-উটাই হোতি হ্যায় কেয়া?" সুখবীর বলেছিল, "হাঁ পহলে পাপা এক দো ঝাপড় লগায়া করতে থে, ফির বীরজি বিচ মে আ গয়ি তো ব্যস, অব কোই অওর তকলিফ নহি হ্যায়।"
ও বীরজি বলত ঠাকুমাকে। আমরা শুনতাম বীজি। কয়েক বার বাবার সঙ্গে যখন তড়কা-রুটি বা ওই সুখা মাটন কিনতে গেছি, বীজিকে দেখেওছি তো ক্যাশে বসতে। আর সুখবীরের বাবা হেঁটে হেঁটে তদারকি করতেন, রান্না প্লাস সে রান্না কাঠের বেঞ্চিতে বসে খাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের। তো সুখবীরের কথা শুনে আমি স্বভাবতই অবাক, যে মাঝখানে বীজি এসে এমন কী করল যে সুখবীর ফেল করার ব্যাপারে আরও বেপরোয়া হয়ে গেল? সুখবীর বলেছিল, পাস করতে ওর-ও খুব ইচ্ছে করে, সে চেষ্টাও যে ও করেনি বা করে না, তা নয়, কিন্তু বীরজির কথা কী করে ফেলে ও? একদিন বিকেলবেলায়, যখন ও আর ওর বীজি একলা ছিল ছাতে, বীজি বলেছিলেন ওকে চোখে জল নিয়ে, "আমার একটা কথা রাখবি? কখনও বড় হোস না। কারণ বড় হলে তো তুই-ও কুলজিৎ হয়ে যাবি।" সেই পড়ন্ত আলোয়, বীজি অতঃপর ধীয় লয়ে সিঁড়ির আঁধারে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন আর হতভম্ব সুখবীর সহস্র ফুট গভীর এক খাদে নিক্ষেপিত।
কুলজিৎ ছিলেন বীজি’র ছোট ছেলে। খালিস্তানি হয়ে যান আর কেউ কখনও তার কথা জানতে পারেনি। শোনা যায় পালিয়ে যাওয়ার অনেক পর সুখবীরদের কাপুরথালার আদি বাড়িতে এক রাতে নাকি বীজি দেখেছিলেন কুলজিতের ছায়া। সবাই বলেছিল ভ্রম। ওরা তার পর সব ছেড়ে বরবিল চলে আসে। সুখবীরের তখনও জন্ম হয়নি। এ সব আমি আমার বাবার কাছেও পরে শুনেছি। বীজি রোজ এসে বসতেন ধাবার ক্যাশে, খুব যে কাজ সামলাতেন তা নয়, শুধু দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন। বোধহয় অপেক্ষা করতেন, বোধহয় রোজ উলের কাঁটায় উল জড়িয়ে, অবচেতনেও বীজি-রা পারেন নিরুদ্দেশের কর্কশ সত্যকেও ডাহা অস্বীকার করতে, বোধহয় এই ওমের নামই অভাগীর স্বর্গ…
সে দিন টেনশনরত আন্টিকাকু আরও কিছুটা এগিয়ে আসার ফলে আমার আর জিজ্ঞেস করা হয়নি সুখবীরকে আর কিছু। যে সে সন্ধেয় বীজি কী করবেন? ধাবা তো খোলা যাবে না, ২৪ ঘণ্টার বন্ধ। যদি সত্যিই কুলজিৎ…
আরও পড়ুন: একানড়ে নয়, সেদিন অন্ধকারে দুলেছিল যে গোল ছায়া…
এখন এত বছর পর আমিই কেমন ব্যথার রাজ্য জরিপ করে করে ফেলি নিঃশ্বাস। এখন আমি কেমন অসহায়ের মতো আবেগী, খড়কুটোর ন্যায় নিয়ন্ত্রণহীন। এখন যেন আমি নিজভূমেই অন্তরীণ। আঁধার আরও এক নিকষ কালো রূপ ধরলে বেরোই, অজান্তেই খুঁজে খুঁজে ফিরি ফেলে আসা সব সুখবীরদের। আমি তো ’৯২ সালের ডিসেম্বরে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে চলে এলাম কলকাতা, এই তো পরের বছরই ১ সেপ্টেম্বর বাবাও হয়ে যাবে শূন্য, আমার বরবিল ছেড়ে আসার পাশে বসবে চিরতরে শব্দটি। ক্রমে আবছায়া হবে পূর্বজন্মের স্মৃতি আর জানা হবে না সুখবীর আজও ফেল করে চলেছে কি না, বীজি’র জন্যে।
এ অতল খাদের আহ্বান থেকে কিছু হতভাগার আর কখনওই মুক্তি এল না, না?