দিল্লি থেকে শুরু করে পোল্যান্ড, ফ্রান্স! কৃষিবিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে যে সব দেশ
Farmers protest: ইউরোপীয় দেশগুলোর বহু জায়গাতেই উন্নত বেতন, সুরক্ষার মতো একাধিক দাবিতে পথে নেমেছেন কৃষকেরা। অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের রাস্তায় হেঁটেছেন।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য-সহ একগুচ্ছ দাবি নিয়ে পথে নেমেছেন কৃষকেরা। ২০২০-২১ সালে কৃষকবিক্ষোভের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। সে সময় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল বিতর্কিত কৃষি আইন। তবে প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেনি সরকার। ফলে একগুচ্ছ দাবি নিয়ে ফের আন্দোলনে নেমেছেন পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকেরা। তাঁদের আন্দোলনকে রুখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না দিল্লির প্রশাসন। কার্যত নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে দিল্লি। হরিয়ানা ও পঞ্জাব থেকে যাতে কোনও কৃষকদের মিছিল কোনও মতেই রাজধানী ছুঁতে না পারে, তার জন্য বিভিন্ন সীমান্তে কড়া করা হয়েছে নজরদারি।
দিল্লিতে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। মঙ্গলবার থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন শুরু করেছে কৃষকেরা। সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন কৃষকনেতারা। তবে তেমন কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি। তার পরেই মঙ্গলবার থেকে আন্দোলন জোরদার করে কৃষক সংগঠনগুলো। ঋণমকুব, কৃষকদের জডন্য পেনশন-সহ একাধিক দাবি রয়েছে তাঁদের। ২০২০ সালের আন্দোলনের সময় কৃষকদের উপরে যে হামলা হয়েছিল, রয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবিও। মঙ্গল এবং বুধ, দু'দিনই হরিয়ানা সীমান্তে কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয় তাদের লক্ষ্য করে। এখনও পর্যন্ত সংবাদিক ও কৃষক-সহ শতাধিক মানুষের জখম হওয়ার খবর মিলেছে।
আরও পড়ুন: দিল্লি যেন ‘দুর্গ’! লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির পাশা পাল্টে দিতে পারে কৃষক-বিক্ষোভ?
শুধু দিল্লিতেই নয়, কৃষক আন্দোলনের এমন নজির রয়েছে দেশের বাইরেও। ইউরোপীয় দেশগুলোর বহু জায়গাতেই উন্নত বেতন, সুরক্ষার মতো একাধিক দাবিতে পথে নেমেছেন কৃষকেরা। অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের রাস্তায় হেঁটেছেন। যে কোনও দেশ, যে কোনও সভ্যতারই ভিত্তি কৃষি। কৃষকেরা দেশের অন্নদাতা। আর তাঁদের আন্দোলন যে কী ভয়ঙ্কর রূপ ধরতে পারে, তা দেখতে পাচ্ছে ফ্রান্স, জার্মানির মতো বহু দেশ।
ফ্রান্স
চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই প্যারিস ও ফ্রান্স জুড়ে কৃষক আন্দোলনের জের শুরু হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি দেশের সমস্ত বড় রাস্তা অবরুদ্ধ করে ট্র্যাক্টর-বিক্ষোভ দেখান কৃষকেরা। বেতন বাড়ানো, আমলাতন্ত্রের প্রভাব কমানো এবং বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে সুরক্ষার দাবিতে পথে নামেন তাঁরা। প্যারিসের একটি ফলের বাজারে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য অন্তত ৯০ জন কৃষককে গ্রেফতার করা হয়।
জার্মানি
একই রকম পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে জার্মানিতেও। গত ৮ জানুয়ারি নাগাদ গোটা দেশ জুড়ে কৃষক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশ। কৃষিকাজে জন্য দরকারি ডিডেলের উপর আয়কর কমানোর দাবিতে পথে নামেন তাঁরা। যার ফলস্বরূপ ২০২৪ সালের বাজেটে ব্যায় পরিকল্পনা সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে জার্মানির সরকার।
স্পেন
সম্প্রতি কৃষক বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে স্পেনও। গোটা দেশ জুড়ে বিরাট আন্দোলনে নেমেছিল সেখানকার কৃষকেরা। ফেব্রুয়ারি মাসের দশ তারিখে রণক্ষেত্রের রূপ নেয় পরিস্থিতি। স্পেনের মাদ্রিদে কৃষক ও ট্রাকচালকের সংঘর্ষও বেঁধেছিল। পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামে পুলিশ। এখনও তাদের আন্দোলন শেষ হয়নি। ফেব্রুয়ারি জুড়ে সেই আন্দোলন জারি রাখার পরিকল্পনা রয়েছে কৃষকদের।
ইটালি
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৃষিনীতির বিরুদ্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করেছে ইটালির কৃষকেরাও। কৃষি খাতে সরকারি বরাদ্দ কমানোর প্রতিবাদে ইটালির রাজধানী রোমে বিক্ষোভ-আন্দোলনে নামে কৃষক সংগঠনগুলি। ট্র্যাক্টপ এনে করা হয় রাস্তা অবরোধ। ফ্লোরস, লিগুরিয়ায় সারা রাত ধরে বিক্ষোভ দেখান কৃষকেরা। সেই বিক্ষোভের আঁচ এখনও ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।
বেলজিয়াম
বেলজিয়ামে বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা ব্রাসেলসে ঢুকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। অতিরিক্ত আয়কর, ক্রমবর্ধমান ব্যায় কমানোর দাবিতে আন্দোলনে নামে তাঁরা। ইউক্রেন থেকে শস্য রফতানির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ তুলে নেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে তাঁদের তরফে।
পোল্যান্ড
পোল্যান্ডেও রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখান কৃষকেরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবেশ নীতির বিরুদ্ধে সরব হন তাঁরা। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে পোলিশ কৃষকেরা একমাস ব্যাপী ধর্মঘট ডেকেছে। জাতীয় সরকার এবং ব্লক উভয়ের কাছ থেকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, মুনাফা হ্রাস এবং নন-ইইউ দেশগুলির থেকে অন্যায্য প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যবস্থার দাবি করছে।
গ্রিস
গ্রিসেও পরিস্থিতিটা একই। সেখানেও একই রকম কৃষক আন্দোলনের ছবি ধরা পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মোকাবিলায় সরকারি সাহায্যের দাবি জানিয়েছেন তারা। ইতিমধ্যেই গ্রিক সরকারের তরফে কৃষকদের জ্বালানি খরচে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কৃষি ডিজেলের জন্য কর রেয়াত-সহ, বন্যার জন্য ক্ষতিপূরণ-সহ একাধিক দাবি রয়েছে তাঁদের।
রোমানিয়া ও লিথুয়ানিয়া
একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে রোমানিয়া ও লিথুয়ানিয়াতেও। সেখানেও কৃষক ও ট্রাকচালকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ট্র্যাক্টর ও ট্রাকের কনভয়ে ঢেকেছে রাস্তা। রোমানিয়ায় যানচলাচল ব্যহত হয় কৃষকদের বিক্ষোক্ষে। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে দু-দিনের বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল কৃষক সংগঠনগুসি। সরকারের কাছে ছ'টি দাবি পেশ করেছেন আন্দোলনকারীরা। তৃণভূমির সমস্যা সমাধানেরও দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
আরও পড়ুন: জারি ১৪৪ ধারা, ভোটের আগে দিল্লির পারদ চড়াছে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ
অন্নদাতাদের এই বিশ্বজোড়া আন্দোলনে কি কান দেবে সংশ্লিষ্ট সরকার। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কার্যত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসটাই কৃষিবিক্ষোভের মাস হিসেবে ধরা দিয়েছে ২০২৪ সালে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা শস্য ফলান রোদ-জল-ঝড়ে পুড়ে-ক্ষয়ে, সরকার কি তাঁদের অধিকার রক্ষায় কোনও পদক্ষেপ নেবে? প্রশ্নটা থেকেই যায়।