ফুটপাতের মেয়েটির জন্যেও আমরা গলা ফাটাবো কবে?
RG Kar Protest: যে সব মেয়েরা ফুটপাতে থাকে, রাতের অন্ধকারে যাঁদের উপরে নেমে আসে ধর্ষণ, নির্যাতন, কুমারী শরীরে রাতারাতি গর্ভসঞ্চার হয়, তাঁদের হয়ে একটিও প্রশ্ন কি করেছি আমরা কোনওদিন সমাজকে?
‘ না’ শব্দটা শুনলেই কনসেন্ট-ভাবনা কাজ করে আমাদের মাথায়। আর নারীর ক্ষেত্রে সেই সম্মতি-অসম্মতির ধারণাটাই এখনও তৈরি হয়নি সমাজে যেন। সিনেমা, গল্পেই এসব শুনতে ভালো। নারীশরীরের প্রশ্ন উঠলে সেখানে এইসব 'হ্যাঁ-না'-র তত্ত্ব গুলিয়ে যায় ভীষণ রকম। আসলে তেমনটাই তো শিখিয়েছে সমাজ। নারী শরীর— পণ্য থেকে শুরু করে অবাধ অত্যাচারের ক্যানভাস। আজ থেকে নয়, বিগত কয়েক শতাব্দী ধরেই। এখনও কোথাও যুদ্ধ বাধলেই নারী শরীরের উপর আঘাত নেমে আসতে আমরা দেখি। সিরিয়া থেকে গাজা কিংবা ধরা যাক সুদানের গৃহযুদ্ধ, যেখানে খাবার পেতে রাষ্ট্রের সেনার হাতে বিকোতে হয় নারীশরীর। পাড়ায় অশান্তি বাঁধলেও আমরা দেখি, কত সহজে বলে দেওয়া যায়, প্রতিপক্ষের বোন বা মাকে তুলে নিয়ে গিয়ে 'সবক' শেখানোর কথা। আসলে এর চেয়ে কঠিন আঘাত বা শাস্তি এ সমাজে বোধহয় আর হয় না।
আর এই শিক্ষাটাই সমাজ দিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। বাড়ি শিখিয়েছে মেয়েদের— একা বেরোতে নেই। আবার একটা ছেলেকে কীভাবে ক্ষমতাবান পুরুষ করে তোলা যায় , সেই শিক্ষাটাও প্রথম দিন থেকে দেওয়া হয় বাড়িতেই। বাড়িতে ছোট্ট দুই ভাইবোন। ভাইটিকে শেখানো হয়, “বোনকে দেখে রেখো, তুমি না পুরুষ!”, “কাঁদছো কেন? তুমি না পুরুষ মানুষ!” এই ভাবে একটি শিশুর অন্দর থেকে সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আর সেই গোটা মহাযজ্ঞটাই সম্পন্ন হয়ে যায় বাড়িতেই।
দিন যায়। ক্রমশ তাঁরা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। তাঁদের ভিত্তিতে ঢুকে গিয়েছে ততদিনে মেয়েরা 'সফট টার্গেট'। যৌন নির্যাতন করলেই একটি মেয়েকে সব চেয়ে বেশি আঘাত করা হবে। সমাজে তথাকথিক 'ধর্ষিতা'-র সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই 'ধর্ষিতা' শব্দটা ব্যবহারেই আমার আপত্তি আসলে। ধর্ষণে আহত বা নিহত, কেন বলি না আমরা? লাঠি, গুলি বা বন্দুকের মতোই ধর্ষণও তো একটি পুরুষতান্ত্রিক হাতিয়ার। তাহলে কেন সম্পূর্ণ একটি আলাদা শ্রেণি তৈরি করা হয় 'ধর্ষিতা' শব্দের মাধ্যমে? যে কোনও ঘটনা ঘটলে সেখানে আহত, নিহতের পাশে একটি লম্বা দাগ টেনে আলাদা করে দেওয়ার চেষ্টা 'ধর্ষিতা'-কে। কেন? এই ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁকে আরেকটু বেশি করুণা করা যায় বলে, দয়া করা যায় বেশি? নাকি ধর্ষিতা বললে তাঁর অপরাধীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের মাত্রাটা এক পারদ চড়ানো যায়?
আরও পড়ুন: প্রতিটা রাত হোক নারী-পুরুষের সমান সমান
এ অভ্য়াস আজকের নয়। আগে রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধলে পরাজিত রাষ্ট্রের নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রথা দেখেছি আমরা ইতিহাসে। এ আসলে অন্য কিছু নয়। সর্বোচ্চ মাত্রায় আঘাতের এক অতি পরিচিত কৌশলমাত্র। রাজনীতি করতে এসেও দেখেছি, আমাদের উপর আঘাত নেমে এসেছে বারংবার। নকশালবাড়ি আন্দোলনেও দেখেছি, কীভাবে অর্চনা, লতিকা কিংবা বীণা দাসেদের উপর কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার। শুধু নকশালবাড়িই নয়, মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তীসগঢ় প্রভৃতি জায়গাতেও কীভাবে ছোট ছোট আদিবাসী মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়। তাঁদের স্তন টিপে দেখা হয়। এই যে অত্যাচারের প্রথা, তা আসলে সমাজ তৈরি করে দিয়েছে। মনেই করে নেওয়া যায়, নারী নামক সফট টার্গেটটিকে আঘাত করলেই সবচেয়ে বেশি আঘাত নামিয়ে আনা সম্ভব সমাজে।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে ফুলের মতো মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হল, এর নেপথ্য়েও কি আসলে কাজ করছে না প্রতিহিংসা। এখানে যদি 'অভয়া' না থেকে 'অভয়' নামের একটি ছেলে থাকত, তাঁর পরিণামও কি এক রকম হত না? সে-ও যদি দুর্নীতির ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে গিয়ে থাকত, তাহলে অভয়া বা তিলোত্তমার মতো শেষ হয়ে যেত হত না তাঁকে? আসলে মেয়ে হলে ধর্ষণ করা যায়, তা-ই এখানে প্রতিহিংসার অস্ত্র ধর্ষণ। আর আজকের দিনে ছেলেরাও যে এই হাতিয়ারের সীমানার বাইরে, তা ভাবা বোধহয় ভুল হবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে স্বপ্নদীপকে যেভাবে দাদাদের হাতে খুন হতে হয়েছে, তাঁকেও কিন্তু যৌনহেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। বারবার তাঁর যৌনাঙ্গে নিপীড়ন চালানো হয়েছে, উলঙ্গ করা হয়েছে, প্রশ্ন করা হয়েছে, সে ছেলে না মেয়ে? এ-ও এক ধর্ষণ। ফলে সমাজে শিশুরা তো বটেই, একজন পুরুষও কিন্তু নিরাপদ নয় এই ধর্ষণ নামক হাতিয়ারের হাত থেকে। এখন তো পায়ুধর্ষণও পুরুষকে নির্যাতনের একটা বড় পন্থা। হ্যাঁ, আজও সমাজে মেয়েরা পিছনের সারিতে বসে, তা-ই তাঁদের উপর আঘাতটা বেশি।
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কান পাতলেই ধর্ষণের খবর। যোগী আদিত্যনাথের মতো দেশের বিজেপি নেতারা বলছেন, কবর থেকে তুলে এনে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করার কথা। তার পরেও কি বুঝতে বাকি থাকে, পুরুষতন্ত্রের, প্রতিহিংসা পূরণের ঠিক কতখানি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠছে এই ধর্ষণ শব্দটি। একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন এমন শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন, তা বিশেষ মাত্রা পায় বটেই।আজ আরজি করের সেই তরুণী চিকিৎসকে সুবিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে বিরাট সংখ্যক মানুষ। আসলে মানুষের মধ্যে দীর্ঘ ক্ষোভ ছাইচাপা হয়েছিলই। তাকে আরও বেশি করে ইন্ধন জুগিয়েছে এই ঘটনা। বিরাট আন্দোলনের রূপ নিয়েছে সেই প্রতিবাদ। স্বাভাবিক ভাবেই আমরা ভাবছি, এই আন্দোলন রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাবে। এ আমাদের একটু বেশিই আশা। কিন্তু সত্যিই কি তেমনটা হবে, সংশয় জাগে। আমরা এককালে যে লড়াই লড়েছি, তা সরাসরি রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলের, দখলের লড়াই। অভয়াও সিস্টেমের বিরুদ্ধেই লড়েছে। তাঁর সঙ্গে সেদিন ঠিক কী হয়েছিল, তা কখনও জানা যাবে কিনা জানিনা। তবে আমার ধারণা, সেই মেয়েটিও লড়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এ লড়াই সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে না হলেও রাষ্ট্রের ছোট ছোট ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে। ঠিক মৌচাকে ঢিলটা মেরেছিল বলেই আজ পরিস্থিতি এতটা উত্তাল।
সময় পাল্টেছে। আজকের এই আন্দোলনে তরুণ সমাজ এগিয়ে এসেছে। রাতের অধিকার, রাত দখলের লড়াইয়ে নেমেছে তাঁরা, নারীর অধিকার নিয়ে লড়াই করতে নেমেছে। কিন্তু কোথাও একটা ধর্ষণের সুবিচার চাওয়ার থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই বিচার চাইছেন তাঁরাদ। তবে শুধু বিচারের দাবি থাকলে তো স্বাস্থ্যভবন বা লালবাজার ঘেরাও হত না। আদালতের সামনে অবস্থান করেই ক্ষান্ত হতেন তাঁরা। অভয়াও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধেই লড়াই করেছে আসলে। যে দুর্নীতিতে কোথাও না কোথাও প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রও জড়িত আসলে। যে কোনও জায়গাতেই এত বড় ঘটনা, এত বড় দুর্নীতি মুখ্যমন্ত্রীর চোখের তলা দিয়ে ঘটে যেতে পারে না। ফলে এই দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর দূরদূরান্ত পর্যন্ত সম্পর্ক নেই, এ কথা বলা যায় না।
নকশাল আমলে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রাখার শাস্তি ছিল জেল, গুলি। বাম আমলেও নন্দীগ্রামে গুলি চলতে দেখেছি। সিঙ্গুরে তাপসীকে মরতে হয়েছে। যেদিন সিঙ্গুরে গুলি চলল, ওখানেই ছিলাম। মানুষ আমাদের রাতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। নিজের চোখে দেখেছি, কীভাবে মানুষের উপর অত্যাচারের খাঁড়া নেমে আসে বিক্ষোভ দমনের নামে। যেসব জুনিয়র ডাক্তারেরা বা আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, আন্দোলন করছেন, তাঁদের উপরেও যে কোনও দিন রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন নেমে আসবে না, এমনটা বলা যায় না। শিক্ষাদুর্নীতির প্রতিবাগে রাস্তায় বসেছিলেন শিক্ষকেরা, তাঁদের উপরেও নেমে এসেছে আঘাত। আন্দোলন আলগা হয়েছে।
তবে যেটা আশার কথা, আরজি কর কাণ্ডের প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত। তা সত্ত্বেও আন্দোলনে ভাটা পড়েনি এখনও। এটা একটা ভালো দিক নিশ্চয়ই। আশা করা যায়, এই আন্দোলন নকশালবাড়ি আন্দোলন বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আন্দোলনের পথে যাবে না। এর আগেও তো ২০১১ সালে বদল দেখেছে মানুষ। আবার হয়তো আরও একটা বদলের প্রত্যাশা করছে তাঁরা। কিন্তু এই ভাবে কি আদৌ বদল আসে? "রাজা আসে যায়, লাল জামা গায়ে, নীল জামা গায়ে" কিন্তু দেশ কি সত্যিই বদলায়? সত্যি বলতে কত সরকারের শাসনই তো দেখলাম। কংগ্রেস আমল দেখলাম, বাম আমল দেখলাম। এখন তৃণমূল জমানা দেখছি। আমার খুব মনে হয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ছাড়া বদল হয় না।
এই যে বাংলাদেশ এমন এক সুন্দর আন্দোলনের জন্ম দিল, তার শেষে কী দাঁড়ালো? হয় সেখানে জামাত আসবে নয় বিএনপি? খুব আলাদা কিছু কি সেখানে হবে তাদের আমলেও। অথচ আন্দোলনের ভিতরে যে প্রভূত শক্তি নিহিত ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আজ বাংলায় যে আন্দোলন হচ্ছে, তা যেভাবে এত সংখ্যক মানুষকে রাস্তায় টেনে আনতে পেরেছে, তা দেখে ভালো লাগছে বৈকি। তার পরেও সন্দেহ থেকে যায়, সত্যিই কি এই আন্দোলন সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে টানতে পারছে আসলে। অভয়া নিয়ে যে মানুষের এত ক্ষোভ, এত বিক্ষোভ, এর আগেও তো ঝুড়ি ঝুড়ি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যেও। যাঁরা বেশিরভাগই নিম্নশ্রেণির, নিম্নবর্ণের। তাঁদের যন্ত্রণা আমাদের সেভাবে ছোঁয়নি কি শুধু তাঁরা আমার শ্রেণির নয় বলেই? সেসব নিয়ে তো এমন আন্দোলনের জোয়ার ওঠেনি? তবে এ কথাও সত্য, কাল করিনি বলে আজও করব না, এমন কোনও মানে নেই। আমরা যে শেষমেশ জেগেছে, পথে নেমেছি, তা অবশ্যই ভালো দিক।
কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই কোথাও, এই মেয়েটি আমাদের নাড়া দিয়েছে, সে আমাদের মতো, আমাদের শ্রেণির বলেই। নির্যাতিতা মেয়েটির মায়ের কাছে সজল প্রশ্ন ওঠে, "আপনার মেয়ে এত মেধাবী, এত সুন্দর। তাঁর উপর এমন অত্যাচার!" নির্যাতিতার মা সম্ভবত বলেননি যে আমার মেয়ে এতটা মেধাবী, এতটা সুন্দর না হলেও তাঁর উপর ধর্ষণ বা নির্যাতনের আঘাত নেমে আসতে পারে না একটি সভ্য সমাজে। যে সব মেয়েরা ফুটপাতে থাকে, রাতের অন্ধকারে যাঁদের উপরে নেমে আসে ধর্ষণ, নির্যাতন, কুমারী শরীরে রাতারাতি গর্ভসঞ্চার হয়, তাঁদের হয়ে একটিও প্রশ্ন কি করেছি আমরা কোনওদিন সমাজকে? জিজ্ঞেস করেছি, রাষ্ট্র তাঁদের নিরাপত্তার জন্য কী করেছে? আসল রাত তো দখল করে থাকে তাঁরা, রাত দখলের মিছিলে তাঁরা কোথায়? আজ ছিল পেট খালি, কাল পেট কীভাবে ফুলে যায় তাঁদের? প্রশ্ন করেছি আমরা? কেন তাঁদের রাত পাল্টায় না, কেন তাঁদের 'পাগলি' বলে দেগে মাথা বাঁচাই আমরা? নাকি নিরাপত্তার অধিকার, সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাঁটোয়ারা হয় আসলে? সেই জায়গাটায় কি চিৎকার করে 'না' বলার প্রয়োজন নেই আমাদের?
এই যে তিলোত্তমার জন্য প্রতিবাদ, তা সকলের জন্য হলে, তবেই তা একটা জায়গায় যাবে। সন্দেশখালিতে যে সব মেয়েদের উপর অত্যাচার হল, পরে শোনা গেল সেসব 'সাজানো ঘটনা', সবই বিজেপির প্রচার। সেটুকু শুনে আশ্বস্ত হয়ে আমরা ঘরেই বসে রইলাম। একবারও সেখানে গিয়ে দেখা হল না, ঠিক কতটা অত্যাচারিত হয়েছেন সেখানকার মেয়েরা। হাঁসখালির ঘটনা নিয়েও একই অবস্থানে থেকে গেলাম। আসলে আমরা সবটা দেখি না, দেখেও চুপ করে থাকি বহু ক্ষেত্রে। সরকার আসে যায়, সরকার পাল্টায়। আবার বড় কিছু ঘটলে আমরা রাস্তায় নামি, চিৎকার করি কয়েকদিন। মূল জায়গাটা ধরে নাড়া দেওয়া আর হয় না। লুপে চলতে থাকে এটা।
মাওবাদী মেয়েদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচারের কথা শুনি। ছত্তীসগঢ় প্রভৃতি জায়গায় তো বটেই, এমনকী জঙ্গলমহলের বহু এলাকাতেই। বন্দিদের সঙ্গে জেলে ভয়াবহ আচরণ করা হয়, তাঁদের যোনির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখা হয়, কোনও কাগজপত্র লুকানো রয়েছে কিনা সেখানে। যন্ত্রণায় চিৎকার করেন তাঁরা। অথচ সেই চিৎকার আমরা শুনতে পাই না। মাওবাদী বলে এড়িয়ে যাই। ব্রিটিশ আমল থেকে নকশাল আমল হোক বা মাওবাদী, কেন রাষ্ট্রের বিচার বা শাস্তির অস্ত্র আজও যৌন-অত্যাচার?
আজও কোনও মেয়ে ধর্ষিত হলে, সেটা নিয়ে মুখ খুলতে সে লজ্জা পায়। সে মনে করে, সে সমাজের মূল স্রোত থেকে ছিটকে গিয়েছে যেন। আমরাই এই পরিস্থিতিটা তৈরি করে দিয়েছি। নন্দীগ্রামের গুলি চলার পর হাসপাতালে গিয়েছি। মেয়েদের উপর রাষ্ট্র, সরকার কীভাবে অত্যাচার করছে সচক্ষে দেখছি। কারওর হাতে গুলি, কারওর পায়ে। শরীরে বিভিন্ন অংশ ঝাঁঝরা করে দিয়েছে রাষ্ট্রের বন্দুক থেকে ছিটকে আসা গুলি। সেই জখম হওয়ার মধ্যে তবু কোথাও প্রচ্ছন্ন রয়েছে ভূমির লড়াই লড়তে পারার গৌরব। তার মধ্যেই এক মহিলাকে দেখি নীরব, চুপ করে বসে রয়েছেন। একজনকে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে ওঁর? খুব অসুস্থ উনি? ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, 'ওঁর উপরে খারাপ কাজ হয়েছে।' যা বোঝার বুঝে যাই তাতেই। কাছে গিয়ে ওঁর পিঠে হাত রাখি। মহিলা দু'হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, "আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আমি কিছু বলতে পারব না।" আমি ওঁকে বোঝাই— "দেখো, ওঁরা ভূমিরক্ষার জন্য আহত হয়েছেন, তার জন্য তাঁরা গর্বিত। ধর্ষণও একটা অস্ত্র মাত্র, হাত-পায়ের মতো স্তন-যোনিও একটা শরীরের অঙ্গমাত্র। যেখানে তোমাক আঘাত করা হয়েছে।"
আসলে ধর্ষণ হওয়া মানেই সমাজ তাঁকে কীভাবে একটা আলাদা বলে দেগে দেয়। যুগ যুগ ধরে এটা হয়ে আসছে। যেন তাঁর স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার অধিকারটুকুও কোনওভাবে কেড়ে নিয়েছে একটা ঘটনা। ধর্ষিতার নাম-পরিচয় লুকিয়ে রাখা হয়। অভয়া মামলাতেও আমরা দেখেছি, আদালত নির্দেশ দিয়েছে মেয়েটির নাম গোপন রাখতে। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে সুজেট কিন্তু নাম বলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন সে নিজের নাম গোপন করবে? নির্ভয়ার মা নিজে সংবাদ মাধ্যমের সামনে নিজের মেয়ের নাম ঘোষণা করেছিলেন। সত্যিই তাঁরা তো অন্যায় করেননি। তাহলে কেন এই লুকোছাপা? অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় সমাজে। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে কিংবা হাসে। সমাজের এই চলে আসা প্রথার বিরুদ্ধে 'না' বলার প্রয়োজন আছে। শুধু ধর্ষণ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলাই যথেষ্ট নয়। ধর্ষণটাকে যদি ক্ষমতাবানের এক হাতিয়ার হিসেবে দেখা না শুরু হয়, তবে সমাজ থেকে ধর্ষণ সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা যাবে না কোনও ভাবেই।
আরও পড়ুন:এ লড়াই নিজের বিরুদ্ধে নিজের
রাতের শহরে আজও একটা মেয়ে ধর্ষণের ভয় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অথচ প্রাণ যাওয়ার ভয় নেই তাঁদের। ভয় শরীরের ওই একটা-দু'টো অঙ্গ নিয়েই। মেয়ের ফিরতে রাত হলে পরিবারের লোকেরা শিউরে ওঠে, কোথাও মেয়ের সঙ্গে কোনও কিছু হয়ে গেল না তো? যেন রাস্তাতেই সমস্ত বিপদ? আজকের সমাজেও কোনও রাত নিরাপদ নয় কারওর জন্যই। সকালও কি নিরাপদ? আনিশকে খুন হয়েছিল নিজের বাড়িতেই। নিরাপদতম স্থান। স্বপ্নদীপ মারা গেল তাঁর কলেজের হস্টেলে। খড়্গপুর আইআইটি-র মেধাবী পড়ুয়া ফয়জান আহমেদ, তাঁকেও মরতে হল কলেজের হস্টেলেই। সেই সব জায়গাই আপেক্ষিক ভাবে নিরাপদ। ফলে রাত যে শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও সমান অসুরক্ষিত, তা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
আসলে পারিবারিক শিক্ষার জায়গাতেও যে বড়সড় গলদ। সেই শিকড়েও সমূলে টান দেওয়া দরকার। একটি ছেলেকে ছোট থেকে বোঝানো প্রয়োজন, শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগত ভাবে ছাড়া একটি ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। তাঁকে ক্ষমতাবান হওয়ার শিক্ষা থেকে সরে আসতে হবে। ছেলে হয়ে চোখে জল, মেয়েদের মতো কান্না— এই সব শব্দগুলো পাল্টে ফেলার প্রয়োজন রয়েছে ভীষণরকম। ছেলেকে ক্ষমতাবান হিসেবে তৈরি করব, অথচ সেই ছেলে ক্ষমতার প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে কিনা কোথাও, তার খবর রাখব না। নারীতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক নয়, সমাজতান্ত্রিক হয়ে ওঠার শিক্ষা কি আদৌ আমাদের কোথাও তৈরি হয়েছে এতদিনেও? সেই জায়গাটায় জোরালো 'না' বলার সময় এসেছে ভীষণ রকম।
(অনুলিখন: সোহিনী দাস)