সোনার থেকেও দামী! বিরিয়ানির গোপন মশলার জন্য যেভাবে রক্ত ঝরিয়েছিল দুই দেশ
SpiceWar: জায়ফলের আসল জন্মভুমি কিন্তু পাপুয়া নিউগিনি। সেখান থেকে বীজ এনে বান্দা দ্বীপপুঞ্জে জায়ফলের চাষ শুরু হয়েছিল সুদুর অতীতে। তবে পাপুয়ার জায়ফল ছিল লম্বাটে আকারের।
সাধের বিরিয়ানি থেকে শুরু করে বহু মোঘল খানারই সিক্রেট মশলা কিন্তু জায়ফল-জয়ত্রী। শুধু যে রান্নায় সুগন্ধী হিসাবে ব্যবহার হয় সেটি, তা কিন্তু নয়। নানা অসুখে ভেষজ ঔষধি হিসাবেও তার ব্যবহার বহুল। তবে ওষুধের কথা তেমন বেশি কেউ না জানলেও রান্নার সঙ্গে এই বিশেষ মশলা সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। তবে রান্নাঘরের বাইরেও কিন্তু স্বপ্রতিভ এই বিশেষ ফলটি। অনেকেই জানেন না, এই জায়ফল ও জয়ত্রী কিন্তু একই ফলের অংশ। একই ফল থেকে জায়ফল এবং জয়ত্রী- দুই-ই পাওয়া যায়। তবে এই জায়ফল-জয়ত্রীর সঙ্গে কেবল সুবাসই নয়, জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধও। আর সেই ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে উপনিবেশ আর রক্তপাতের গল্প।
যতদূর জানা যায়, এই মশলার জন্মভূমি ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু ক্যারাবিয়ান দ্বীপ গ্রানাডার পতাকায় কীভাবে যেন স্থান পেয়ে গিয়েছিল এই জায়ফল। তার একটা কারণ অবশ্য এটাই যে এই জায়ফল তাদের রপ্তানী বাণিজ্যের বিরাট একটা অংশ। ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট অংশ এই বান্দা। তার মধ্যেও অতিক্ষুদ্র (প্রায় এক বর্গমাইল) এক দ্বীপ রাণ। জনবসতি বলতে হাজার খানেক লোক মাত্র। শুধু সন্ধ্যেবেলা কয়েক ঘন্টা বিদ্যুত থাকে। বাকি সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের সবথেকে দামি তরবারি! টিপু সুলতানের অস্ত্রের দাম শুনলে চোখ উঠবে কপালে…
৩৫০ বৎসর আগে ডাচ তথা ওলন্দাজদের দখলে ছিল নিউ আমস্টার্ডাম। ইংরেজরা পরে ওই জায়গাটির নাম বদলে রাখে নিউ ইয়র্ক। ডিউক অফ ইয়র্কের সম্মানেই এই নাম। এই নিউইয়র্কেরই প্রধান এলাকা ছিল ম্যানহাটন। ম্যানহাটনের বেশিরভাগটাই অবশ্য তখন জলাভূমি। আর সেই ম্যানহাটনের মালিকানা ছিল ওলন্দাজদের দখলেই। সেসময় ঘটেছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। ওলন্দাজেরা এই দ্বীপের মালিকানা ইংরেজদের সঙ্গে বদলাবদলি করে। বদলে তারা পায় ইন্দোনেশিয়ার একটি অতি ক্ষুদ্রদ্বীপ রাণ। না, তবে এমনি এমনি হাত বদল হয়নি ভুখণ্ড।
ইংরেজদের বেশিরভাগ নৌ বাণিজ্যপথ তখন ডাচদের নিয়ন্ত্রনে। আর লন্ডন পুড়েছে বিধ্বংসী আগুনে, প্লেগে অগুনতি মানুষ রোজ মরছে। এই অবস্থায় শুরু হয় দ্বিতীয় ডাচ-ইংরেজদের মধ্যে দু'বছরের যুদ্ধ। যুদ্ধে দু'পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৬৫টি যুদ্ধ জাহাজ নষ্ট হয়, প্রাণ যায় ১২০০ নৌসেনার। যুদ্ধে নাস্তানাবুদ ইংরেজরা বাধ্য হয়েই সাক্ষর করে ব্রেডা সন্ধি চুক্তিতে। ইংরেজরা মেনে নেয় ডাচদের দাবি। তুলে দেয় তাদের হাতে ইন্দোনেশিয়ার অতি অতি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাণ, ব্রিটিশদের হাতে থাকা একমাত্র জায়ফল উৎপাদনকারী ভূমিখন্ড। বদলে ডাচরাও কিছু দেয় বটে। উত্তর আমেরিকার ম্যানহাটন দ্বীপের মালিকানা পায় ব্রিটিশরা। সে সময় জলাজমিময় ম্যানহাটন দ্বীপ ছিল ডাচদের আমেরিকার উপনিবেশের রাজধানী। সেই রাজধানীও ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে দু'বার ভাবেনি ওলন্দাজরা। তার কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই যে জায়ফলের গাছ। যার মিলতে সেসময় একমাত্র ওই রাণ দ্বীপেই। আর ওই জায়ফলের দাম ছিল সেসময় সোনার চেয়েও বেশি।

জায়ফল নামক সুগন্ধী মশলার গায়ে ছিটে আছে বহু মানুষের রক্ত। ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের সূত্রপাতের পেছনে একটা বড় কারণ ছিল মশলার বাণিজ্য। বেশির ভাগ মশলার উৎপাদন হয় গরমের দেশে। ঠান্ডা আবহাওয়ার ইউরোপে এসব মশলা তেমন জন্মায় না। ফলে চাহিদা মেটাতে এই সব মশলার দর ছিল তুঙ্গে। অবশ্য মশলার দাম বেশি হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল স্কার্ভি রোগ। মশলা কেনার জন্য দীর্ঘ সময়ের সমু্দ্রপথ পাড়ি দিতে জাহাজে ৭৫জন নাবিক নিয়ে যাত্রা করলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারত মাত্র ২৫জন। ফলে মশলার দাম তো বেশি হবেই। মশলার দাম বেশি ছিল বলেই সেই বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য পাওয়ার জন্যই তো সমুদ্রপথে পাড়ি দিত ইউরোপীয়রা। অতঃপর যুদ্ধ আর গরমের দেশগুলোতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন।
ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুদ্র দ্বীপের জায়ফল গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনেও ছিল ঔপনিবেশিক মশলা বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রথমে নাকি শ্রীলঙ্কায় জায়ফলের বীজ বপন শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। সফল হয়েছিল সেই চাষ। সেই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তাদের প্রায় সমস্ত উপনিবেশে জায়ফল চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ছড়ানো হয় বীজ। উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনও ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী ডাচদের জায়ফল-জয়ত্রীর ব্যবসার বাজারে হাত বসানো। ততদিন অবশ্য জায়ফলের চাষ শুরু করে রপ্তানি বাণিজ্যেব্যাপক লাভবান হয়েছে ক্যারাবিয়ান দ্বীপ গ্রানাডা। আর সেই লাভের পরিমাণ এতটাই যে অচিরেই তাদের রাষ্ট্রীয় পতাকায় স্থান পেল জায়ফল।

ষোড়শ শতাব্দীতে এই জায়ফলের সুগন্ধের জন্যই কিন্তু শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। কত দাম ছিল সেই জায়ফলের? ১৭৬০ সালের লন্ডন বাজারে এক পাউন্ড জায়ফলের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ শিলিং। কিন্তু দামের চেয়ে ঢেরগুণ বেশি ছিল চাহিদার উন্মাদনা। স্বাভাবিক ভাবেই মুনাফা লাভের আকাঙ্ক্ষাও ছিল আকাশছোঁয়া। বাজারে যাতে দাম পড়ে না যায় সেই জন্য ডাচরা কখনওসখনও তাদের আমাস্টার্ডামের গুদামে মজুত জায়ফল পুড়িয়ে দিত। ফলে প্রচুর মুনাফালোভী ডাচ আর ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। যুদ্ধ ও রক্তপাতের ইতিহাস সত্ত্বেও ডাচরা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও এই জায়ফল উৎপাদনকারী বান্দা দ্বীপপুঞ্জ হাতছাড়া করেনি।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই আরব বণিকরা ইউরোপে জায়ফলের বাণিজ্য করত। সেই ব্যবসা হাতে নেওয়ার জন্যই নাকি জন্য ভাস্কো-দা-গামা ১৫১২ সাল নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার জায়ফল ব্যবসার কেন্দ্র মালুকু দ্বীপ দখল করে। কিন্তু মালুকু দ্বীপে জায়ফল বিক্রি করা হত মাত্র। উৎপাদন হতো অন্য সব দ্বীপে। একশো বছর বাদে ১৬১২তে সেই দ্বীপগুলির দখল নিতে শুরু করে ডাচ 'ইষ্ট ইন্ডিয়া' কোম্পানী। ১৭৯৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা দখল করে নেয় রাণ দ্বীপ। আর সেই রাণ দ্বীপই ডাচদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় ইংরেজরা মশলা যুদ্ধের হারের। কিন্তু তারই ফাঁকে ইংরেজরা জায়ফলের বীজ পাচার করে ফেলেছিল তাদের বেশ কয়েকটি উপনিবেশে।

বান্দা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা দীর্ঘকাল ধরে আরব বণিকদের সঙ্গে জায়ফলের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল কোনও ঝুট ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু ইউরোপীয়দের যে বরাবরের দখলদারী মনোভাব, তা প্রথম থেকেই মেনে নেয়নি বান্দা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা। ফলে ইউরোপীয়দের জন্য মোটেও সহজ হয়নি বান্দা দ্বীপপুঞ্জের উপনিবেশ স্থাপন। প্রায় একশো বছর ইউরোপীয়দের সঙ্গে লড়েছে বান্দা দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা। একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অনন্তকাল তো আর ব্রিটিশদের ওরম সর্বব্যাপী শক্তিকে আটকানো সহজ ছিল না সামান্য জনসংখ্যার ওইসব ছোট ছোট দ্বীপের বাসিন্দাদের পক্ষে।
তবে ইতিহাস বলছে, জায়ফলের আসল জন্মভুমি কিন্তু পাপুয়া নিউগিনি। সেখান থেকে বীজ এনে বান্দা দ্বীপপুঞ্জে জায়ফলের চাষ শুরু হয়েছিল সুদুর অতীতে। তবে পাপুয়ার জায়ফল ছিল লম্বাটে আকারের। বান্দার জমিতে সেগুলো গোলাকার চেহারা পেতে শুরু করে। জমির গুণেই হোক বা বান্দাবাসীদের দক্ষ ব্যবসায়ী চালে, ক্রমশ বান্দা দ্বীপপুঞ্জ হয়ে দাঁড়াল জায়ফল উৎপাদন ও বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। বান্দার বাসিন্দারা যে কেবল দক্ষ ব্যবসায়ী ছিল তাই নয়, তার সঙ্গেই ছিল সুদক্ষ নাবিক। ফলে চিন থেকে শুরু করে পাপুয়া সব এলাকাতেই তারা বাণিজ্য শুরু করে। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ায় মালয়, জাভা, আরব- নানা জায়গার বণিকেরা বান্দা দ্বীপপুঞ্জে এসে তাদের বাণিজ্যতরী ভেড়াতে শুরু করে। সম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠে বান্দাবাসীরা । মালয় ভাষায় যাকে বলে ওরাং কায়া বা ধনী ব্যক্তি। একটা সময় আসে, যখন বান্দার এই অভিজাতরাই এক একটি বান্দা দ্বীপ কিনে নেন। তাঁরাই হয়ে ওঠেন সে সব দ্বীপের স্বতন্ত্র-স্বাধীন শাসকে পরিণত হন।

মশলা আর টাকার গন্ধে গন্ধে ততদিনে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করেছে বান্দা দ্বীপপুঞ্জে। বান্দায় জায়ফল ছাড়াও পাওয়া যেত দারুচিনি, এলাচ। কিন্তু ইউরোপীদের মূল আকর্ষণ ছিল জায়ফল। ততদিনে জায়ফলের নানা ঔষধি গুণের কথাও প্রচার হয়ে গেছে ইউরোপ জুড়ে। জায়ফল নাকি প্লেগের ওষুধ, ঠান্ডা লাগলেও দারুণ উপকারী জায়ফল, পেটে গ্যাস হলেও মোক্ষম দাওয়াই জায়ফল, এমনকী যৌন উত্তেজনা ও ক্ষমতা বাড়াতেও নাকি অব্য়র্থ জায়ফল। শুধু কি তাই, ক্রমে নেশার বস্তু হিসেবেও নাম ছড়িয়ে পড়ল জায়ফলের। ফলে যা হওয়ার তাই হল। সোনার দামে বিক্রি হতে শুরু করল জায়ফল।
১৫১০ সালে এই বাণিজ্য দখলের চেষ্টা করে প্রথম পোর্তুগীজরা। প্রবল বাধা পায় বান্দাবাসীদের থেকে। আর সেই বাধা এতটাই ছিল যে, পরবর্তী কয়েক দশক ব্রিটিশরা আর পা বাড়ানোর সাহস করেনি এদিকে। ১৫৯৯ সালে ডাচরা রণতরী নিয়ে হাজির হয়। বাধ্য করে বান্দার কয়েক জন ওরাং কায়াকে তাদের শর্তে ব্যবসা করতে। কিন্তু অচিরেই ফিরে গেল ডাচ রণতরী, আর আবার নিজেদের শর্তে নিজেদের নিয়মে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন শুরু করল বান্দা ব্যবসায়ীরা।

জায়ফলের কথা শেক্সপিয়রের তিনটি নাটকে দেখা যায়। 'পঞ্চম হেনরি' নাটকে জায়ফলের রঙের প্রসঙ্গ টেনেছেন নাট্যকার। 'লাভ লেবার লস্ট' নাটকে বড়দিনের উপহারে মিলেছে জায়ফলের ব্যবহার। বোঝাই যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে এই মশলা ছিল মহার্ঘ্য এক উপহার। জায়ফলের কথা শোনা গিয়েছে 'দ্য উইন্টার'স টেল' নাটকে ভাঁড়ের মুখে, 'ওয়ার্ডেন পাই' নামে এক ধরনের ইউরোপীয় কেক বানানোর জন্য। শেক্সপীয়রকে নিয়ে কাজ করা ঐতিহাসিক ব্রিগেট ওয়েবস্টার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, মশলার সুগন্ধে কীভাবে জমে উঠেছিল শেক্সপীয়রের নাটক। ডাচদের চরম রাজনৈতিক একচ্ছত্রতা ক্রমশ অর্থনৈতিক ভাবে সমস্যায় ফেলেছিল ইংল্যান্ডকে। সে কারণেই সম্ভবত শেক্সপীয়রের ইংল্যান্ডের কাছে জায়ফল হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মশলা। বড়দিনের উপহারের জন্য তা ব্যবহার হত বটে, কিন্তু সাধারণের সেই মশলা কেনার ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে।
১৬০৩ সাল নাগাদ শত্রু ইংরেজদের সঙ্গে বানিজ্যচুক্তি সেরে ফেলে বান্দার বণিক সম্প্রদায়। ডাচদের পক্ষে এ ঘটনা বিশ্বাস করা ছিল শক্ত। ১৬০৯ সালে ডাচরা ফের এল। সঙ্গে হাজার খানেক ডাচ সেনা ও একদল জাপানি ভাড়াটে সৈন্য। তবে এবারেও বান্দা কবজায় করতে পারল না তারা। স্বাভাবিক ভাবেই বান্দা দ্বীপপুঞ্জে নজর পড়ে ডাচদের। এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাচ প্রতিনিধি জঁ পিটারসুন কোয়েন সিদ্ধান্ত নেন জায়ফলের নিরঙ্কুশ ব্যবসা হাতে পেতে হলে ব্যবসা আর উৎপাদন দু'টোরই নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকা দরকার। আর সেই কাজ কোনওমতেই বান্দাবাসীর মারফৎ হবে না, তার জন্য প্রয়োজন অনুগত ডাচ প্রতিনিধি।
বান্দা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় বান্দা বেসার দ্বীপ। আর সেখানেই ডাচ বিরোধী শক্তি সবচেয়ে বেশি জোরালো ছিল। কোয়েন ১৬০০ ডাচ সেনা, ৮০ জন ভাড়া করা জাপানি সৈন্য আর আশপাশের এলাকা থেকে জোগাড় করা কয়েকজন ক্রীতদাস নিয়ে বান্দা বেসার আক্রমণ করে বসলেন। বান্দাদের তরফ থেকে প্রবল বাধা এল, কিন্তু তারই ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকল ধনবান বান্দা ব্যবসায়ীদের সাথে গোপন আঁতাত, চুক্তি। দল বদলাতে শুরু করল গোপনে। কয়েকদিন পরে দেখা গেল সেই দ্বীপজুড়ে শুধু ডাচ আর ডাচ। বান্দা সেনারা কোণঠাসা হতে হতে জঙ্গলের দিকে হটে গেছে। জঙ্গল থেকে গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় মাঝে মাঝে ডাচদের আক্রমণ করলেও ততক্ষণে দ্বীপের দখল ডাচদের হাতে।
৪৮ জন বান্দা ব্যবসায়ী ডাচদের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য এসেছিল বটে, তবে তাঁদের কাউকেই কোনও সুযোগ দেয়নি জাপানি ভাড়াটে সেনারা। গলা কেটে খুন করে ওই ৪৮ জনের কাটা মস্তক টাঙিয়ে দেওয়া হয় দ্বীপ জুড়ে। গোটা দ্বীপের সব গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ডাচেদের হাতে প্রাণ গিয়েছিল ৮০০ দ্বীপবাসীর। কিছু লোককে বন্দি বাণিয়ে জাভার ডাচ উপনিবেশে পাঠানো হয়। বান্দা বেসার পর্বের ভয়াবহতা বুঝতে শুধু সংখ্যার হিসেব শুনলেই যথেষ্ট। বান্দা দ্বীপপুঞ্জের ১১টি দ্বীপের আনুমানিক ১৫ হাজার বাসিন্দার মধ্যে বেঁচে ছিল ১ থেকে ২ হাজার মাত্র। ডাচরা গোটা এলাকাকে ৬৮টি জায়ফলের বাগানের ভিত্তিতে ভাগ করে নেয়। বান্দা বেসারের গনহত্যা নিয়ে কোথাও তেমন কোনও হইচই হয়নি। কোয়েনকে এই নারকীয় গণহত্যার জন্য একটাও জবাবদিহি করতে হয়নি কোথাও।
আশপাশের ঘন জঙ্গলে ঢাকা দ্বীপে পালাতে পেরেছিল বান্দা দ্বীপপুঞ্জের অল্প কয়েক জন বাসিন্দা। কোয়েনের বাহিনী চলে যাওয়ার পরে ফের আলোয় আসতে শুরু করে তাঁরা। ততদিনে জায়ফল চাষের ভূত নেমেছে মাথা থেকে। বাধ্য হয়ে অন্যান্য কৃষিজ ও সামুদ্রিক জিনিসের চাষবাস ও ব্যবসা শুরু করল তারা। মজার ব্যাপার, সেখানেও মিলল সাফল্য। অন্যান্য শস্য উৎপাদনে এতটাই লাভ হতে শুরু করল যে ডাচদের জায়ফল বাগানের কর্মীরাও শেষপর্যন্ত তাদের উপরেই বেশি ভরসা করা শুরু করল। পলাতক এই বান্দাবাসীরা ছোট ছোট দ্বীপে বাস করতেন। দক্ষ ব্যবসার পাশাপাশি নাবিক হিসেবেও এঁরা ছিলেন দক্ষ। ফলে জলপথে ঘুরে ঘুরে নিজেদের পণ্য বিক্রি তেমন কঠিন কাজ ছিল না তাঁদের পক্ষে।

১৮৮০ অবধি ডাচরাও অবশ্য বিদ্রোহী এই ছোট ছোট দ্বীপগুলো দখলের চেষ্টা করেনি। কারন সেখান থেকেই জায়ফল বাগানের কর্মীদের খাদ্যশস্য আসে। এরই ফাঁকে কিছু পলাতক বান্দাবাসী দূরের দ্বীপে নতুন করে জায়ফলের চাষ শুরু করে। শুরু করে ব্যবসাও। ছোট আকারে হলেও এই চিরাচরিত চাষ ও ব্যবসা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল তাঁরা। আর ডাচেরা চেষ্টা করেছিল নানা ভাবে তাকে রোখার। কিন্তু শেষপর্যন্ত বান্দাবাসীর এই নিজস্ব কৃষি-বাণিজ্য ধরে রাখার চেষ্টা বৃথা যায়নি। আজও জায়ফলের চাষ হয় বান্দা দ্বীপপুঞ্জের বাইরের অনেক দ্বীপেই। অবশ্য বলা কঠিন সেইসব পলাতক বান্দাবাসীর সরাসরি বংশধর কতজন আছে আর ওই দ্বীপে। ভাষা, সংস্কৃতি কিছুটা মিশ্রিত হয়েছে প্রায় সব দ্বীপেই। কিন্তু জায়ফলের উপস্থিতি বলে দেয় বান্দাবাসীরা আজও আছেন।
ডাচদের স্থাপন করা জায়ফল বাগিচা শিল্প কিন্তু সেসময় চলত আমদানি করা দাস-শ্রমিকদের দিয়েই। কিন্তু শ্রমিক লাগালেই তো হয় না, জায়ফল চাষের নিয়ম-পদ্ধতি জানাটা যে জরুরি। যে হাজার ২ হাজার বান্দাবাসী বেঁচে ছিলেন তাঁদেরই অন্যদের প্রশিক্ষণের কাজে লাগনো হয়েছিল। তাদের থেকেই বাইরের লোকেরা জায়ফল চাষ যেমন শিখল, তেমনই বান্দা সংস্কৃতির কিছুটাও তাদের জীবনে মিশে গেল। এখন বান্দা দ্বীপুঞ্জের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। তারা বেশিরভাগই ডাচদের মাধ্যমে নানা এলাকা থেকে এসেছিলেন। তাঁদের আদিবসতি যে বান্দা নয়, তা তাঁরা জানেন। তবু নিজেদের প্রকৃত বান্দাবাসীই মনে করেন তাঁরা। বান্দা সংস্কৃতির ধারক-বাহক এখন তারাই।
আরও পড়ুন: ‘তাসের দেশ’-এর রাজপুত্র এখনও যুদ্ধ ঘোষণা করে সব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
বান্দা দ্বীপপুঞ্জে আবার জায়ফল চাষ হচ্ছে। ডাচদের জায়ফল বাগান শিল্পের অনুকরণে নয়, বরং বান্দাদের চিরন্তন প্রথাতেই হচ্ছে সেই চাষ। তবে আজকের বান্দাবাসী যতই জায়ফল ফলাক না কেন তা যে কখনও তাদের ইতিহাসের সেই সোনার দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না, তা তাঁরা জানেন। কারণ জায়ফলের সেই চাহিদাও আর নেই, হাতে ছ্যাঁকা লাগা দামও নেই। আগের মতো কয়েকজন ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রনেই জায়ফল চাষ হবে, সেই দিনও নেই। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাই তাল মেলানোর চেষ্টা করেন আজকের বান্দার জায়ফল ব্যবসায়ীরা।
বান্দা দ্বীপপুঞ্জের রাণ দ্বীপের বাসিন্দা ফটোগ্রাফার মহম্মদ ফাদলির কথায়- "আমি এখানে মানুষদের ছবি তুলে বেড়াই। কারণ তাঁরাই তো সব। তাঁদের নিয়েই তো ইতিহাস।" ছোট্ট দ্বীপ রাণ। দিনে ঘন্টা দুই-তিন বিদ্যুৎ থাকে। আজও কোনও মোবাইল সিগন্যাল ধরে না এখানে। তবে প্রতি ঘরে ঘরে টিভি আছে, স্যাটেলাইট কানেকশন আছে। বিদ্যুৎ থাকলে টিভি চলে। জাকার্তা থেকে এসেছিলেন ফাদলি। তাঁর কথায়, এখানে রাত্রি এতটাই নিঃস্তব্ধ যে প্রথম প্রথম ঘুম আসত না তাঁর। তবু অতীতের তাড়না তাকে রান দ্বীপকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। একসময় মশলার উৎপাদন আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই ভাগ্য নিয়ন্ত্রক ছিল বান্দার। সেই ভাগ্য কিন্তু ততটাও গৌরবজনক ছিল না। মশলার এই বাণিজ্য, সমুদ্র-বাণিজ্যে দক্ষ ইউয়োরোপীদের জন্য সৌভাগ্যজনক ছিল বটে তবে দ্বীপবাসীদের জীবনে তা ডেকে এনেছিল কেবল অভিশাপ। এমনটাই মনে করেন ফাদলি। জায়ফলের দাম কমে যেতেই প্রায় সকলেই সেই ইতিহাসের কথা ভুলেছে। ফাদলি মনে করেন, তাঁর তোলা ছবি আচমকা সব কিছু বদলে দেবে না। কিন্তু তবু হয়ত কিছু লোক প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে সজাগ হবে। আর সেটুকুই লাভ।

Whatsapp
