স্বপ্নে ছিল সবুজ-মেরুন, তবুও ইস্টবেঙ্গলের হয়েই মাঠে নামা, আক্ষেপই চিরসঙ্গী তুলসীদাস বলরামের

Legendary Footballer Tulsidas Balaram Passes Away : আক্ষেপ তাঁর জীবন থেকে মুছে যায়নি। অজস্র আক্ষেপের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে, ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন তুলসীদাস বলরাম।

তেলেঙ্গানার সেকেন্দ্রাবাদের ছোট্ট এক টুকরো গ্রাম আম্মাগুডা। সেখানেই তস্য ছোট একটি সংসার। বাড়িতে নুন আনতে পান্তাও জোটে না। দারিদ্র্যের ছাপ যেন উপচে পড়ছে সেখানে। রোদে পুড়তে পুড়তে সেই বাড়ির কর্তা-গিন্নি তাকিয়ে থাকত তাঁদের ছোটো ছেলেটির দিকে। পড়াশোনা করলে সে-ই পরিবারের অবস্থা ফেরাতে পারবে। বারবার বাবা-বাছা করা, ওরে একটু পড়তে বোস। ভালো করে পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি না করলে তো পেটে ভাত জুটবে না! তখন কী করবি রে?

কিন্তু হাফ প্যান্ট পরা ছেলেটার পড়াশোনার দিকে খুব একটা ঝোঁক ছিল, তা নয়। তার থেকেও বেশি ঝোঁক ছিল খেলাধুলায়। পেটে খিদে, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে শরীর দিয়ে, মাথার ওপর চাঁদিফাটা সূর্য সর্বস্ব তাপ ঢেলে দিচ্ছে। সমস্ত কিছু নিয়েই এবড়োখেবড়ো জমিতে ফাটা চটি পরে ছুঁতে চলেছে সেই ছেলেটি। সামনে ছিল কেবল একটিমাত্র ফুটবল। সেটি নিয়ে চলতি যাবতীয় রাজত্ব। শিল্পী যেমন নিজের সৃষ্টির মধ্যেই মুক্তির আশ্রয় খোঁজেন, তেমনই এই ছেলেটিও ফুটবলের মধ্যে খুঁজে নিত চিলেকোঠার স্বপ্ন। ১৯৩৬ সালে শুরু হয়েছিল সেই ছোট্ট ছেলেটির লড়াই। ২০২৩-এ এসে থামল সেই বল। ছেলেটিকে এখন সবাই চেনে, তাঁর কথা অনেকেই বলে। কিন্তু আক্ষেপ তাঁর জীবন থেকে মুছে যায়নি। অজস্র আক্ষেপের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে, ছুটতে ছুটতে চলে গেলেন তুলসীদাস বলরাম। ভারতের ফুটবল ইতিহাস যার পায়ের স্পর্শে সোনায় রূপান্তরিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন : সাতে সাত! যতবার ডার্বি ততবারই হারের ভবিতব্য কেন ইস্টবেঙ্গলের?

কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। স্বপ্ন সত্যি করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। রানারের মতো হাজার হাজার মাইল কেবল ছুটে বেড়ান তাঁরা। তুলসীদাস বলরাম সেই মানুষগুলোরই একজন। ছোট থেকে স্বপ্নই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। তারপর এল ফুটবল। দুটোকে একসঙ্গে করে ছুটে চলত অশ্বমেধের ঘোড়া। উইকিপিডিয়া বলছে, ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকারদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকেই থাকবেন তুলসীদাস বলরাম। গোটা এশিয়া তাঁর পায়ের জাদু, ড্রিবলিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এমন এক কিংবদন্তির গল্পের শেষটা? মাত্র ২৭ বছর বয়সেই অবসর নিতে ‘বাধ্য’ হয়েছিলেন তুলসীদাস। যে বয়সে একজন পোড় খাওয়া স্ট্রাইকার নিজের মালমশলা আরও মজবুত করেন, আরও তীব্র হয় তাঁর আক্রমণ, সেই বয়সেই ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি। আর ২০২৩-এর ১৬ ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবীকেই বিদায় জানালেন তিনি। একা, অসহায়, দুঃখে-বেদনায় থেমে গেল কথাগুলো।

মায়ের স্বপ্ন ছিল, ছেলে যেন পড়াশোনা করে চাকরিবাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু তুলসীদাসের সেসবে কোনও আগ্রহ ছিল না। তাঁর শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ছিল ফুটবল; আর সেই গোল বলটির সঙ্গে জুড়ে ছিল দু’টি বিশেষ রং। সবুজ-মেরুন। মাকে মিথ্যে কথা বলে টাকা নিয়ে সেই জার্সিও বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন। পরে জানতে পারলেন, ওই টাকাটুকুও দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না মায়ের। ছেলে বলেছিল ‘বই কিনতে টাকা লাগবে’, তাই তুলসীদাসের মা-ও প্রতিবেশীর কাছে গিয়ে টাকা ধার করে আনেন।

এভাবেই নরমে গরমে চলছিল জীবন। আর এই যাত্রাপথে একমাত্র অস্ত্র ছিল ফুটবল। সমস্ত রাগ, অভিমান ভোলানোর সঙ্গী। আচমকাই বদলে গেল জীবন। তখন ১৮ বছর বয়স পেরিয়েছেন তুলসীদাস বলরাম। খেলায় ধারও বেড়েছে। ১৯৫৫ সালে হায়দ্রাবাদ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আব্দুল রহিম লক্ষ্য করলেন টগবগে যুবক তুলসীদাসকে। সত্যিকারের এক ঘোড়া যেন তিনি! পায়ের জাদুতে, কারসাজিতে ডিফেন্ডারদের বোকা বানাচ্ছেন তিনি। অনায়াসে ফাঁক গলে চলে যাচ্ছেন গোলের সামনে, তারপর জোরালো শটে গোল। এই ছেলেকে তাঁর চাই, যে করেই হোক। ঠিক তার পরের বছরই সন্তোষ ট্রফিতে হায়দ্রাবাদের হয়ে মাঠে নামলেন তুলসীদাস বলরাম। জানেন না, ঠিক কী অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। পাঠক, খেয়াল করুন সময়টার কথা! ১৯৫৬ সাল। ইতিহাস বলে, ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের শুরুয়াৎ এই সময়টা থেকেই।

আরও পড়ুন : ভাইপোর পা থেঁতলে দিয়ে শাস্তি! ময়দানে ফুটবলের ঝাঁঝ ‘স্যার’ দুখীরামকে ভুলেছে বাঙালি

১৯৫৬ সালের সন্তোষ ট্রফিতে তাঁর দুরন্ত পারফর্মেন্স জায়গা করে দেয় অলিম্পিক দলে। কিন্তু তখনও রিজার্ভ বেঞ্চেই ছিল তাঁর জায়গা। দেশে ফিরে ভাবলেন, নিজের জায়গা হায়দ্রাবাদেই ফুটবল খেলা চালিয়ে নিয়ে যাবেন। রাজ্যের সিটি পুলিশের হয়ে খেলবেন, সঙ্গে চাকরিও করবেন। কিন্তু অল্পদিনেই মোহভঙ্গ হল। তুলসীদাস বলরামকে যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল, সেটা একেবারেই পূরণ করা হল না। যে শহর তাঁকে জন্ম দিয়েছে, স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে, সেই শহরই এরকম করল! মন ভাঙার শুরুটা এখান থেকেই হয়েছিল। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড আগুন। ফিনিক্স হওয়ার ডাক এল সুদূর বাংলা থেকে। সবুজ-মেরুন? না, বরং তাদের বিপক্ষ – লাল হলুদ। ইস্টবেঙ্গল ঠিক করেই নিয়েছিল, এই প্রতিভাকে তাদের চাই। শেষমেশ দক্ষিণের ফিনিক্স পাখির যাত্রা কলকাতায়।

এখান থেকে শুরু হল নতুন এক অধ্যায়ের। ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে যা অমর হয়ে থাকবে আজীবন। ১৯৫৬-১৯৬৩, ভারতীয় ফুটবলের এই সোনালি সময়ের কাণ্ডারি হয়ে এলেন তুলসীদাস বলরাম। একে ঠিক আসা বলা যায় না, বলা ভালো ‘আবির্ভাব’! তুলসীদাসের ছোঁয়ায় ইস্টবেঙ্গলের সর্বত্রই তখন বসন্ত; তাঁর পা যেন মাঠে ফুল ফোটাচ্ছে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে গোটা কেরিয়ারে ১০৪টি গোল করেছিলেন তিনি। তবে ক্লাবের পাশাপাশি দেশের হয়েও জ্বলে উঠেছিলেন তুলসীদাস। একটা সময় তাঁকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। আর এই জাতীয় দলে খেলার সময়ই তাঁর সঙ্গী হলেন আরও দুজন। একজনের নাম চুনী গোস্বামী, আরেকজন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সংক্ষেপে পিকে।

ভারতীয় ফুটবল যতদিন থাকবে, পিকে-চুনী-বলরামের ত্রিফলার কাহিনি অমর হয়ে থাকবে। ভারতের আক্রমণ ভাগে এই তিনজন থাকলে আর কাউকে ভাবতে হতো না। তিনজনই কিংবদন্তি, মাঠে তাঁদের বোঝাপড়া চমকে দেবে সবাইকে। পঞ্চাশ-ষাটের দশক মানে এশিয়ার সিংহ হয়ে গর্জে উঠছে ভারত। কোরিয়া থেকে হাঙ্গেরি – কেউ পার পাচ্ছে না। এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক, এশিয়াড – সব জায়গায় ভারতের ভরসা এই ত্রিশূল।

কিন্তু তারপরই ভাগ্যের চাকা গড়িয়ে যায় খাদের দিকে। মায়ের অসুস্থতার জন্য ইস্টবেঙ্গলকে না জানিয়েই চলে যান হায়দ্রাবাদে। ব্যাপারটি একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি লাল-হলুদ। ক্লাবের আচরণ মেনে নিতে পারেননি বলরামও। ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে দেন তিনি। তারপর অবশ্য বিএনআরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হায়দ্রাবাদ ছেড়ে কবে যে বাংলার বাসিন্দা হয়ে উঠলেন, জানতেও পারলেন না। বাংলা আর এখানকার ময়দানের সঙ্গে তাঁর আত্মিক টান। কিন্তু ২৭ বছর বয়সেই থেমে গিয়েছিল তাঁর ফুটবল কেরিয়ার। ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের সমস্যা যেন জাঁকিয়ে ধরেছিল তাঁকে। সেই রোগই অকাল অবসর নিতে বাধ্য করাল।

পরবর্তীকালে কোচিং, কলাম লিখন ইত্যাদি করলেও ফুটবল থেকে অনেকটা দূরে সরে যান তুলসীদাস বলরাম। কারণ, অভিমান। দেশের জন্য সর্বস্ব পর্যায়ে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি। বদলে কী পেয়েছেন? হুগলির উত্তরপাড়ার সামান্য একটা বাড়ি। অর্জুন পুরস্কার পেলেও ‘অজ্ঞাত কারণে’ পাননি পদ্ম সম্মান। অসুস্থতাও জাঁকিয়ে বসেছিল ক্রমশ। শেষমেশ সেই দৌড় থামল ২০২৩-র ফেব্রুয়ারি মাসে। চুনী আর পিকে আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এবার চলে গেলেন তুলসীদাস বলরাম। অদৃশ্যে নতুন জুটি বাঁধার আশায়…

More Articles