হাতছাড়া হল বড় রেকর্ড! কেন ওড়িশার মসনদ হারালেন নবীন পট্টনায়ক?

Naveen Patnaik: দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল বিজু জনতা দল। তবে এই বারের বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের ময়দানে সম্পর্কে হঠাৎই তিক্ততা আসে।

ওড়িশায় ডুবল নবীন-সূর্য। প্রায় পঁচিশ বছর পরে ওড়িশায় ভূমিপুত্র নবীন-সাম্রাজ্যের পতন হল। সেই জায়গা দখল করল বিজেপি। ওড়িশায় এ বার লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন একই সঙ্গে হয়েছিল। আর সেই ভোটই কাল হল বিজু জনতা দলের। সেই ২০০০ সাল থেকে টানা পাঁচবার বিধানসভা ভোটে জিতে রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন নবীন পট্টনায়েক। জ্যোতি বসুর রেকর্ড পর্যন্ত কার্যত টপকে গিয়েছিলেন তিনি। ২০২৪-এর বিধানসভা ভোটে জিতলে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিঙ-এর রেকর্ডও ভাঙতে পারতেন নবীন। কিন্তু তেমনটা হল না। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে উঠে পড়ে লেগেছিল গেরুয়া শিবির। আর তাতে সাফল্যও পেল তারা। রীতিমত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল নবীনের দল বিজেডি। বিধানসভা ভোটে বিজেপি একাই ওড়িশায় পেয়েছে ৭৮টি আসন। বিজু জনতা দল পেয়েছে ৫১টি। কংগ্রেস ১৪টি আসন ও অন্যান্যরা চারটি আসন। বিধানসভা ভোটেই যেখানে এই হাল, লোকসভা ভোটে কী হতে পারে, তা তো অনুমান করাই যায়। ২০২৪ লোকসভা ভোটে মোট ২১টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২০টিই পেয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র একটি। আর বিজেডি শূন্য। এই প্রথম ওড়িশায় মারাত্মক ভালো ফল করল বিজেপি। ক্ষমতা হারালেন নবীন পট্টনায়েক! নেপথ্যে আসলে কোন ষড়যন্ত্র? কোন কোন ভুল সিদ্ধান্তের জেরে রাজ্যের রাশ হাত থেকে ছিটকে গেল বিজেডির?

দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল বিজু জনতা দল। তবে এই বারের বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের ময়দানে সম্পর্কে হঠাৎই তিক্ততা আসে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয়, কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও রাজি ছিল না। রাজ্য বিজেপি শেষপর্যন্ত 'একলা চলো' নীতিতে ভরসা করেই লড়াই করেছে ওড়িশা। ২০০৭ সালেই কন্ধমল সাম্প্রদায়িক হিংসার পর বিজেপি-বিজেডির গাঁটছড়া ভেঙে ছিল। এরপর নবীন যোগ দিয়েছিলেন তৃতীয় ফ্রন্টে। বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তকমা পাচ্ছিলেন নবীন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই রাজ্যে নবীনের সাম্রাজ্য ধ্বসে যাওয়ার পিছনে খানিকটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর বার্ধক্য। পাশাপাশি উত্তরসূরি তৈরি করতে না পারাও এক বড় ফ্যাক্টর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন দু'টি কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ২০টি আসনে জয় পেয়েছিল বিজেডি। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোট থেকে সেই সমীকরণ বদলাতে শুরু করে। সে বছর বিজেপি পায় ৮টি, বিজেডি পায় ১২টি এবং কংগ্রেস পায় ১টি আসন। যদিও সেই উত্থান সে বার বিধানসভা নির্বাচনে দেখা যায়নি। এই রাজ্যে চলতি বছর বিধানসভা ও লোকসভা ভোট হয়েছে একই সঙ্গে। ২০১৯ সালে, ১৪৭টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১১২টি আসন ছিল বিজেডির দখলে। বিজেপি পেয়েছিল ২৩টি এবং কংগ্রেস ৯টি। এই ফারাক বুঝিয়ে দেয় ওই রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভার ভোটের আলাদা মাপকাঠি রয়েছে। ভোট প্রচারে সম্বিত পাত্রের বেফাঁস মন্তব্য— "ভগবান জগন্নাথ মোদির ভক্ত" নিয়ে শুরু হয়েছিল জল্পনা। প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমা চেয়ে সেই গুরুভার খন্ডাতে পারবেন কি না সম্বিত? তবে শেষপর্যন্ত দেখা গেল লক্ষাধিক ভোট পেলেন তিনিই, হেরে গেল বিজেডি।

আরও পড়ুন: মোদি ম্যাজিক শেষ! বারাণসীতে কেন এত কম ভোট পেলেন মোদি?

বাকি রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও চলেছে ধর্মীয় সমীকরণে মোদির ভোট প্রচার। প্রধানমন্ত্রী ভোটের প্রচারে এসে রাজ্যবাসীকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভান্ডারের চাবি হারানোর রহস্য নিয়ে উস্কে দিয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন, দ্বাদশ শতকে তৈরি প্রাচীনতম জগন্নাথ মন্দির বিজেডির হাতে সুরক্ষিত নয়। রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা নিয়ে বিপুল উত্তেজনার প্রচার দেখেছে ওড়িশা। ভোট প্রচারে এই রাজ্যে মোদির আনাগোনা হয়েছে বহুবার। প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীনও। অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পাঁচদিন আগেই রাজ্যে উদ্বোধন করে ফেলেন বিশ্বের জনপ্রিয় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের "পরিক্রমা প্রকল্প" ও " শ্রীসেতু" সংযোগের। এতে খরচ করেছিলেন ৪,০০০ কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির, সম্বলপুরের সমলেশ্বরী মন্দির, পুরীর গুন্ডিচা, রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ-সহ রাজ্যের প্রায় সব প্রধান মন্দিরের সংস্কারের কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না।

নবীনের কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল করতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপির আইটি-সেল। উদ্দেশ্য ছিল প্রশ্ন তোলা— অসুস্থ, প্রবীণ নেতা নবীনকেই কি মুখ্যমন্ত্রী চায় রাজ্যবাসী? এ নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্ক আরও উস্কে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদিও। ১৯৯৭ সালে পিতা বিজু পট্টনায়ক মারা যাওয়ার পর, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন নবীন। বাবার নামে দলের নাম দেন বিজু জনতা দল (বিজেডি)। কিন্তু তিনি ২৪ বছর পরও দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি ওড়িয়া ভাষায়। মোদি প্রচারে এসে এই নিয়েও কটাক্ষ করেন। বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় আসলে এমন কোনও ভূমিপুত্র বা ভূমিকন্যাকে মুখ্যমন্ত্রী করবে, যিনি রাজ্যের ভাষা জানেন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, গেরুয়া শিবিরের বারবার এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ঝড় তোলাই ওড়িশায় জোড়া ভোটে সাফল্যের অন্যতম কারণ। যেমন প্রচার চলেছিল বিজেপির পক্ষে ভোট দেওয়ার, তেমনই ট্রেন্ড করা করা হয়েছিল নবীন পট্টনায়কের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার।

আরও পড়ুন:মোদিকে যোগ্য জবাব! মেইতেই-কুকি মিলে কীভাবে বিজেপিকে উপড়ে ফেলল মণিপুর?

একদা যিনি ছিলেন বন্ধু, অবশেষে তাঁর ষড়যন্ত্রেই এতদিনকার ক্ষমতা খোয়ালেন নবীন। শেষমেশ কি প্রধানমন্ত্রীর উস্কে দেওয়া বিতর্কে ভর করেই উল্টেপাল্টে গেল ওড়িশার রাজনৈতিক সমীকরণ? সেটাই ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।

More Articles