স্টিম ইঞ্জিন নয়, বরং বলদ দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলায় ট্রেন চলাচল

Darjeeling Mail: পরাধীন ভারতে কিন্তু দার্জিলিং মেলের আগেও কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চালানো হতো একটি ট্রেন। আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়টি হলো, ট্রেনটি চলতো স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে না বরং বলদ ও হাতি দিয়ে।

ট্রেন তখন প্রায় চলতে শুরু করে দিয়েছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। ভিড় থেকে দৌড়ে এসে এক বৃদ্ধ হাত রাখলেন কামরার সিড়িতে। অস্ফুষ্ট স্বরেই ট্রেনকে প্রণাম জানালেন, ভিড়ের উদ্দেশ্যে বললেন, 'জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে মা-বাবার সঙ্গে এই ট্রেনে উঠতাম। রংপুর, পার্বতীপুর হয়ে ট্রেনে কলকাতা যেতাম। এখনো এই ট্রেনের সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। একটা সময় জলপাইগুড়ি হলদিবাড়ি হয়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে এই ট্রেনটি যেত। এখন অবশ্য, সীমানার জন্যে বদলেছে রুট। সেই ট্রেনের কামরাও আর নেই। কিন্তু এই ট্রেনটি নিয়ে হলদিবাড়ি এবং জলপাইগুড়ি স্টেশনের স্মৃতি এখনো একই রকম তাজা। উত্তরবঙ্গের দুই প্রাণকেন্দ্র নিউ জলপাইগুড়ি এবং হলদিবাড়ির ঐতিহ্যবিজড়িত সেই স্মৃতির টানেই প্রতিদিন এই ট্রেন ধরতে ছুটে আসেন বহু মানুষ। ট্রেনের কোচ আধুনিক হলেও, ট্রেনের স্মৃতিটা তো আর পুরনো হয়ে যায়নি।

এই বছর স্বাধীনতা দিবসের সকালেই প্রথম যাত্রী নিয়ে এনজিপি ছাড়িয়ে জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন হয়ে হলদিবাড়ি অব্দি পৌঁছেছিল দার্জিলিং মেল। এতদিন পর্যন্ত এনজেপি থেকে চলাচল করলেও সোমবার থেকেই হলদিবাড়ি থেকে চলতে শুরু করেছে ভারতীয় রেলের ঐতিহ্যবাহী এই ট্রেন। তবে, জানেন কি, পরাধীন ভারতে কিন্তু দার্জিলিং মেলের আগেও কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চালানো হতো একটি ট্রেন। আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়টি হলো, ট্রেনটি চলতো স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে না বরং বলদ ও হাতি দিয়ে। সেই সময় যদিও দার্জিলিং মেলের অস্তিত্ব ছিল না। তবে, কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চলা এই ট্রেনকে দার্জিলিং মেল এর উত্তরসূরী বলেই মনে করা হয়। তৎকালীন সময়ে এই ট্রেন পরিচিত হতো বুলক ট্রেন নামে। সম্প্রতি দার্জিলিং মেল নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হওয়ার পর এই পরাধীন ভারতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চলা এই বিশেষ বলদ চালিত ট্রেনের ব্যাপারেই বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে ইতিহাসবিদদের মুখ থেকে।

সঠিকভাবে বলতে গেলে, ভারতীয় রেলের ইতিহাসের সবথেকে পুরনো এবং সব থেকে ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি ট্রেনের মধ্যে একটি হলো এই দার্জিলিং মেল। আগে অধুনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এই ট্রেন চলাচল করলেও স্বাধীনতার পরবর্তীতে এই ট্রেনের রুট পরিবর্তিত হয়। ভ্রমণ কাহিনী লেখক গৌরী শংকর ভট্টাচার্য জানালেন, ১৮৭৮ সালে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে শুরু হয়েছিল এই ঐতিহ্যবাহী ট্রেনের যাত্রা। তখন এই ট্রেন শিয়ালদহ, রানাঘাট, অবিভক্ত বাংলার ভেড়ামারা, সারা সেতু, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, হিলি, পার্বতীপুর, নীলফামারি, হলদিবাড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়িতে প্রবেশ করতো। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনেই এই ট্রেন থামতো। তৎকালীন সময়ে যদিও শিয়ালদহ স্টেশনের নাম ছিল ক্যালকাটা স্টেশন। যেহেতু সেই সময় কলকাতা ছিল ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের রাজধানী, তাই প্রথম কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাওয়ার জন্যই চালু করা হয়েছিল এই ট্রেনটিকে।

আরও পড়ুন-ট্রেন মানেই দেরি, কেন লেট লতিফের শিরোপা পেল ভারতীয় রেল

১৯১৫ সালে দার্জিলিং এর লেখক ই সি ডজ তাঁর লেখা একটি বই 'দার্জিলিং - অতীত ও বর্তমান'-এ দার্জিলিং মেলের উল্লেখ করেছিলেন। সেই বইতে তিনি লেখেন, তৎকালীন সময়ে ভারতের সবথেকে দ্রুতগামী ট্রেন ছিল দার্জিলিং মেল। দার্জিলিং মেলের ব্যাপক সফলতার বেশ কয়েক বছর পর শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন পর্যন্ত চালু করা হয় নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস, যা এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস হিসেবে পরিচিত। ১৮৮১ সালে দার্জিলিং মেল শিলিগুড়িটা স্টেশন পর্যন্ত এলে সেই ট্রেনটিকে দার্জিলিং অবধি নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করা হয়। বড় লাইন থেকে ছোট লাইনে ছোট কামরা দিয়ে দার্জিলিং অবধি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা।

তবে দার্জিলিং মেলের ইতিহাসের সঙ্গেই আরো একটি ট্রেনের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে, এবং সেটা হলো দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের টয় ট্রেন। তৎকালীন সময়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নেতাজি, স্বামী বিবেকানন্দ, এবং বাংলার বহু মনীষীরাই দার্জিলিং মেল ব্যবহার করে কলকাতা থেকে সরাসরি পাহাড়ে আসতেন। শিলিগুড়ি স্টেশনে নেমে ছোট টয় ট্রেন ধরে পাহাড় পর্যন্ত যেতে হতো সেই সময়। গাড়ির বাতুলতা ততটা ছিল না।

এরপর ষাটের দশকে ব্রিটিশ সরকার চালু করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। এই স্টেশনটি চালু হওয়ার পর, নতুন করে রুট পাল্টায় দার্জিলিং মেলের। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের পরিবর্তে শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পর্যন্ত চলাচল শুরু করে দার্জিলিং মেল।

তবে বুলক ট্রেনের ইতিহাসটা জানতে হলে স্মৃতির স্মরণে বেয়ে চলতে হবে আরো একটু পিছনে। সময়টা ১৮৬৯। দার্জিলিং ততদিনে হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের গ্রীষ্মকালীন অবলম্বন। গ্রীষ্মের সময় সমভূমির তাপ থেকে বাঁচতে, পুরো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমস্ত ব্যবসার কাজকর্ম চালানো হতো দার্জিলিং থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো মাঝেমধ্যেই। পাশাপাশি ব্যবসার পণ্য নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসাও বেশ শক্ত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া তো আর সহজ বিষয় নয়, তার ওপর সেটা ব্যাপক খরচ সাপেক্ষও বটে। তাই প্রয়োজন পড়ল ট্রেনের। সে বিষয়টির কথা মাথায় রেখেই তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়ো কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চালু করেন একটি ট্রেনের রুট। এই ট্রেনটিই পরিচিত ছিল বুলক ট্রেন হিসেবে। বার্ড কোম্পানি এই ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং সেই কোম্পানির প্রধান ছিলেন স্যাম বার্ড। মূলত, তার মাথা থেকেই প্রথমেই বলদের সাহায্যে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা বেরিয়ে এসেছিল।

তবে এই ট্রেনে যাত্রীরা থাকতেন না। সেই সময় যখন দার্জিলিং মেল বা টয় ট্রেন চালু হয়নি, সেই সময় ব্রিটিশরা পাহাড়ের চা বাগানের চা, ব্যবসা বা অন্যান্য পণ্য পরিবহনের জন্য এই বুলক ট্রেনের সাহায্য গ্রহণ করতেন। সাহেবগঞ্জ থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত প্রথমবার এই ট্রেন চালানো হয়েছিল। কারাগোলা ঘাট থেকে পুরানিয়া হয়ে এই ট্রেন দার্জিলিং পৌছাতো। তৎকালীন সময়ে দার্জিলিংয়ের প্রসিদ্ধ হিলকার্ট রোড পরিচিত হতো ওল্ড কার্ট রোড নামে। প্রায় ১৮৮ মাইল ছিল এই বুলক ট্রেনের যাত্রাপথ।

তবে এই ট্রেন চালানো খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় এই ট্রেন দাঁড় করাতে হতো। দার্জিলিং পৌঁছতে প্রচুর সময় নিয়ে নিত এই ট্রেন। বিভিন্ন স্থানে এই ট্রেন দাঁড়াতো পণ্য ওঠা নামানো করানোর জন্য। ট্রেনের কামরাগুলি আকৃতিতে ছিল অনেকটা বাক্সের মত। দুই পাশে ছিল দুটি করে চাকা এবং কামরার মাথায় ত্রিপলের ছাউনি। দুটি বলদ সেই সময় কামরা টেনে নিয়ে যেত। তবে এই ট্রেন কিন্তু লাইনের উপর চলতো না। বরং সাধারণ রাস্তার উপর দিয়েই চালানো হতো এই বুলক ট্রেন। একটি বলদ অসুস্থ হলে তার জন্য বাড়তি বলদ তৈরি করা থাকতো।

তবে বৃষ্টিতে যখন বলদ ভালো কাজ করত না, সেই সময় ব্যবহার করা হতো হাতি। শোনা যায় নাকি, ১৩০০ টাকা খরচ করে সেই সময়ে এই ট্রেন চালানোর জন্য একটি হাতিও কিনেছিল বার্ড কোম্পানি। আরেকটি হাতি মাসে ২০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে আসা হয়েছিল। ট্রেন পাহারা দেওয়ার জন্য লাঠিধারী চাপরাশি থাকতেন একজন। তবে এই ট্রেনের সবথেকে বড় বিষয়টি ছিল, এর সুরক্ষা। ১৪ বছর ধরে এই ট্রেন চললেও কখনোই কোন চুরি বা ছিনতাই এর ঘটনা এই ট্রেনে ঘটেনি।

কালের নিয়মে একটা সময় এই ট্রেনকেও বিদায় নিতে হয়। ১৪ বছর এক টানা পরিষেবা দেওয়ার পর ১৮৮১ সালে তৈরি হয় দার্জিলিং হিমালয়ের রেলওয়ে। বার্ড কোম্পানির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পল বার্ড রেলের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের সেই ঐতিহ্যবাহী বুলক ট্রেন পরিষেবা চালু রাখার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হতে পারেননি। শেষমেষ ওই বার্ড কোম্পানি ২০ হাজার টাকায় তাদের সমস্ত গোডাউন এবং অন্যান্য সামগ্রী রেলের কাছে বিক্রি করে ইতি টানেন বুলক ট্রেন পরিষেবায়।

স্বাভাবিক নিয়মে ইতিহাসের বুক থেকে হারিয়ে যায় সেই ঐতিহ্যবাহী বুলক ট্রেন। তার জায়গা দখল করে পাহাড়ের রানী দার্জিলিঙে অভিষেক হয় টয় ট্রেন বা খেলনা ট্রেনের। আর কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন এবং টাউন স্টেশন থেকে ছোট লাইনে যাত্রা শুরু করে দার্জিলিং মেল, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও দার্জিলিং যাওয়ার সব থেকে ভালো মাধ্যম।

More Articles