মিষ্টির জন্য ট্রেন দাঁড়াত এক ঘণ্টা! লেডিকেনির ইতিহাস আজও অবাক করে
Ledikeni History: আসল রহস্য কী এই লেডিকেনির পিছনে?
মিষ্টি আর বাঙালি যেন সেই প্রাচীনকাল থেকে এক অদৃশ্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। যুগযুগান্তর ধরে মানুষের রসনা বিলাসের মূল উপকরণ হিসেবে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে মিষ্টি। তার সিংহাসন টলায় কার সাধ্যি! আর বাঙালিদের তো মিষ্টি ছাড়া কথাই শুরু হয় না। কনে দেখতে আসা থেকে জামাইষষ্ঠী, পূজা-পার্বণ, শ্রাদ্ধ, যে কোনও উৎসব মিষ্টি ছাড়া অপূর্ণ। বাঙালি শুধুমাত্র মিষ্টি খেয়েই তৃপ্ত নয়, সে খাইয়েও তৃপ্ত। সেই কারণে বাঙালির ঘরে অতিথি হয়ে এসে মিষ্টির বৈচিত্র্য আর স্বাদে গদগদ হননি; এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বহু নামজাদা বিদেশিও সময়ে সময়ে বাঙালির মিষ্টি খেয়ে সেই মিষ্টির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন রীতিমতো– এমন অনেক ঘটনাও আছে ভূরি ভূরি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি থেকে লর্ড কার্জন, আবার ওদিকে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ- সবাই বারবার মিষ্টির ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। মিষ্টির প্রশংসায় লেখা হয়েছে একাধিক পদ্য।
মিষ্টির দাঁড়িপাল্লায় বরাবর দক্ষিণ কলকাতার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় উত্তর কলকাতা, আর এই পাল্লায় এক বিশাল জায়গা নিয়ে আছে লেডিকেনি। মিষ্টি একটা, কিন্তু নাম অনেক। তাতে দাবিও অনেকের। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। কিন্তু আসল রহস্য কী এই লেডিকেনির পিছনে?
ইতিহাস এবং নামকরণ
যখনই মিষ্টির কথা বলা হয়, তখন রসগোল্লার পাশাপাশি ভাজা মিষ্টির রাজা পান্তুয়ার কথা না বললেই নয়। ছানার তৈরি ছোট ছোট কোলবালিশের মতো আকৃতির মিষ্টি বিশাল কড়াইতে গরম তেলে হালকা ভেজে নিয়ে রাতভর এলাচের রসে ডুবিয়ে রাখলে যে অমৃত তৈরি হয় তাকে কী বলে? উত্তর ভারতীয়রা বলবেন গুলাব জামুন, আর বাংলায় বলে পান্তুয়া। আর ঠিক এই রকমই একটি মিষ্টি হলো লেডিকেনি।
আরও পড়ুন: মুখে দিলেই স্বর্গীয় স্বাদ! পুজোয় গন্তব্য হোক কলকাতার সেরা সন্দেশের ঠিকানাগুলি
এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কালোজাম বা পান্তুয়ার সঙ্গে লেডিকেনির পার্থক্য কোথায়? জনপ্রিয় এক পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক রুপায়ণ ভট্টাচার্য এই নিয়ে তল্লাশি করে অনুধাবন করেছেন যে, পান্তুয়া তৈরি হয় ক্ষীর দিয়ে আর লেডিকেনি তৈরি হয় ছানা দিয়ে। লেডিকেনি একটু লালচে ধরনের হয় এবং এর রসও একটু পাতলা। অন্যদিকে কালোজাম একটু কালো করে ভাজা হয়। লেডিকেনির ভেতরটা ফাঁপা, ছানার তৈরি, রসে টইটম্বুর এবং ভেতরে একটা এলাচও দেওয়া হয়। এই গেল অন্য মিষ্টির সঙ্গে লেডিকেনির পার্থক্য। এবার আসা যাক ইতিহাসে।
লর্ড ক্যানিং ব্রিটিশদের কাছে খুব জনপ্রিয় একজন গভর্নর হয়ে উঠলেও ভারতীয়দের কাছে তিনি ছিলেন নিন্দিত। ১৮৩৫ সালে শার্লট স্টুয়ার্টের সঙ্গে লর্ড ক্যানিং-এর বিয়ে হয়। এরপর ১৮৫৬ সালে সিপাহি বিদ্রোহর আগের বছর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, লর্ড ডালহৌসির পরে ভারতের গভর্নর হিসেবে লর্ড ক্যানিং নিযুক্ত হবেন। এইভাবে লর্ড ক্যানিং-এর হাত ধরে শার্লট ভারতে আসেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ক্যানিং-এর প্রশংসনীয় ভূমিকা পরের বছরই তাঁকে ভারতের প্রথম ভাইসরয় হিসেবে অধিষ্ঠিত করে।
এখনকার সেলিব্রিটিদের মতোই তখনও লর্ড অ্যান্ড লেডি ক্যানিং-এর বিবাহিত জীবন নিয়েও আলোচনা কম হতো না। বিশেষ করে লেডি ক্যানিং হয়ে উঠলেন এক জনপ্রিয় চরিত্র। ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর তার নিদারুণ সহানুভূতি ছিল। অসাধারণ লেডি ক্যানিং দক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিল ফুল এবং গাছের প্রতি তাঁর ভালবাসা। বারাকপুরের বাড়িতে তাঁর নিজের হাতে তৈরি বাগান ছিল দেখার মতো। ভালোই কাটছিল সবকিছু, কিন্তু সুখ সইল না। ১৮৬১ সালে দার্জিলিং যেতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান লেডি ক্যানিং।
বলা হয়, বারাকপুর গঙ্গার পাড় তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল। তাঁর ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে সেই গঙ্গাতীরেই যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। আর লেডিকেনির ইতিহাসের শুরু এখান থেকেই। কথিত আছে, লেডি ক্যানিং-এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কলকাতার বিখ্যাত ভীমচন্দ্র নাগ বানিয়ে ফেললেন এক নতুন মিষ্টি, যার নাম দিলেন ‘লেডি ক্যানিং’। ‘বাঙ্গালা’ যেমন ইংরেজদের মুখে মুখে বেঙ্গলি হয়ে গেছে, তেমনই এই নতুন মিষ্টি চলতি কথায় বা অপভ্রংশে লেডিকেনি হয়ে উঠল। এইভাবে ভাইসরয় পত্নীর নাম জুড়ে গেল বাঙালি মিষ্টির সঙ্গে। প্রায় সব সরকারি অনুষ্ঠানে একবাক্যে জায়গা করে নিল এই লেডিকেনি। এমনকী, সেকালের ‘ভোজবাড়ি'-তেও রসগোল্লার সঙ্গে পরিবেশিত হতে লাগল লেডিকেনি।
তবে লেডিকেনির ইতিহাস নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। যেমন কেউ কেউ দাবি করেন, লেডি ক্যানিং-এর ভারত আগমন উপলক্ষে ভীমনাগ একপ্রকার মিষ্টি বানিয়ে তার নাম দেন লেডিকেনি। অন্য এক মতে, লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিন উপলক্ষে লর্ড ক্যানিং-ই অর্ডার দিয়ে ভাজা রসের এক বিশেষ মিষ্টি বানিয়েছিলেন, যার স্বাদ এর আগে কেউ কখনও পায়নি। যা পরবর্তীকালে নাম হয়েছিল ‘লেডিকেনি’। আবার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী জগু ময়রার চতুর্থ প্রজন্মের কর্ণধার সুমন প্রামাণিকের মতে, “সবটাই শোনা কথা, তবে পূর্বপুরুষদের মতে জগু ময়রা নিজে এই মিষ্টি বানাননি। কথিত আছে, হরিদাস পাল এই মিষ্টির স্রষ্টা। তখনকার দিনে রানাঘাটের জমিদার ছিলেন পালচৌধুরীরা। তাদের রাজত্বে রাণাঘাট ভ্রমণে আসেন লেডি ক্যানিং। তাঁর আগমনেই এই স্পেশাল মিষ্টি বানানো হয়, এবং তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম হয় ‘লেডিকেনি’।" সুমন প্রামাণিকের আরও মত, “লেডি ক্যানিং ভেবেছিলেন, বাইরে যেহেতু লাল, তাই মিষ্টির ভেতরেও লাল হবে। কিন্তু কামড় দিতেই ভেতরে সাদা ধবধবে ঘিয়ের জালি দেখে নাকি উনি হেসে ফেলেছিলেন। এই মিষ্টি নাকি তাঁকে অবাক করে দিয়েছিল।"
তাই বলে শুধু লেডি ক্যানিং নয়, রেলপথের সঙ্গেও এই মিষ্টির এক সুন্দর ইতিহাস আছে। শোনা যায়, সেই সময় দার্জিলিং মেল রাণাঘাট হয়ে যেত। আর হরিদাস পালের দোকান থেকে মিষ্টি কেনা হবে বলে ট্রেন নাকি এক ঘণ্টার বেশি দাঁড়াত।
লেডিকেনি কিন্তু শুকনো মিষ্টি নয়, বরং রসগোল্লার মতোই রসে ডোবানো। তবে ঘন হলদে রস নয়, রসগোল্লার মতো পাতলা আর কম মিষ্টির রসে ডোবানো। লেডিকেনির ভেতর ফাঁপা, যাতে থাকে কিছুটা রস আর একটা এলাচ। এই এলাচই হলো লেডিকেনির আসল পরিচয়। তবে এখন উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছাড়া আর কোথাও এই আদি, অকৃত্রিম লেডিকেনি পাওয়া যায় না। ইতিহাস বিভ্রাট যাই থাকুক, লেডি ক্যানিং-এর নামানুসারেই যে এই মিষ্টি, একথা একবাক্যে স্বীকার করবেন সকলেই। এইভাবেই বিদেশিনী লেডি শার্লট ভারতে এসে চিরকালের জন্য বন্দি হয়ে থেকে গেলেন বাঙালি মিষ্টিতে।