জাহাজে লুকোনো রত্ন পেয়ে ভাগ্য ফিরেছিল গৌরী সেনের! বাংলা প্রবাদগুলিতে লুকিয়ে যে ইতিহাস
সত্যি কি আমাদের বলা সব প্রবাদ বা কবিতার নেপথ্যে একটা করে গল্প আছে?
খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে। খাজনা দেবো কিসে?
ছোটবেলায় এই পদ্য বা গান শোনেনি, এইরকম বাঙালি সম্ভবত নেই। ছোটবেলায় শুনে আনন্দ পাওয়া এই পদ্য আসলে যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের কথা বলে, তা আমরা হয় জানি না অথবা ভুলে গিয়েছি। এই পদ্যের বর্গীদের ইতিহাস আমাদের অজানা। উত্তর কলকাতায় একটা রাস্তার নাম মারহাট্টা ডিচ লেন, সেই রাস্তার নামের সঙ্গে এই পদ্যের মিল রয়েছে। কারা সেই মারহাট্টা, যাদের ভয়ে ইংরেজরা কলকাতার চারপাশে পরিখার মতো গর্ত খুঁড়ে কলকাতায় তাদের আক্রমণ আটকাতে চেয়েছিল? সত্যি কি আমাদের বলা সব প্রবাদ বা কবিতার নেপথ্যে একটা করে গল্প আছে?
একটু বইয়ের পাতা আর কম্পিউটারের ইঁদুরের ঘেঁটি ধরে নাড়াচাড়া করলে জানা যায় যে, পদ্যের বর্গী আর রাস্তার নামের মারহাট্টা দু'টি আলাদা নাম হলেও আসলে তাদের উৎস এক- মারাঠা। যদিও তাদের সেই সময়ের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় বর্ধমানের কাটোয়া, দাঁইহাট এবং কালনায়। প্রায় ছ'বার বর্গী আক্রমণ এবং অবাধ লুঠপাটের ফলে এই এলাকাগুলো সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই এলাকায় যে মারাঠারা এসেছিল, তার প্রমাণ হিসাবে আজও দাঁইহাটে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গামণ্ডপ দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজদের আশঙ্কা যদিও শুধু আশঙ্কা হিসাবেই থেকে গিয়েছিল। মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করেনি। তার ফলে ইংরেজদের আবার সেই বিশাল সুবিশাল পরিখার মতো গর্ত মাটি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। যে এলাকা দিয়ে সেই পরিখা ছিল, তেমন একজায়গার রাস্তার নাম হয়ে গিয়েছিল মারহাট্টা ডিচ লেন।
আরও পড়ুন: দশটি গ্রাম নিয়ে জমিদারি! হুগলির এই জায়গায় ইতিহাস এখনও কথা বলে
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এক ভদ্রলোক মাছের দাম শুনেই প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বললেন, "মগের মুলুক পেয়েছে।" এই প্রবাদটা আজ প্রায় চারশো বছর ধরে বাঙালিরা বলে চলেছি। যদিও উৎস অনেকই জানি না, কিন্তু মানে সবাই জানি। এই কথাটার সঙ্গেও বাংলার এক অন্ধকার অধ্যায় জড়িয়ে আছে। মারাঠারা এসেছিল বর্ধমানের দিকে আর সুন্দরবনের দিকে লুঠপাট চালিয়েছিল আরাকান বা মায়ানমারের বাসিন্দা মগেরা। তখনও ইংরেজরা তাদের শাসন শুরু করেনি। জাহাজে করে বাংলায় হাজির হয় মগের দল। সুন্দরবন এবং তার আশেপাশের এলাকায় অবাধ লুঠপাট, অপহরণ, পাচারের সঙ্গে যুক্ত মগেদের ঠেকানোর ক্ষমতা বাংলার সুবেদারদের ছিল না। তার ফলে এক চরম অরাজকতা সৃষ্টি হয়। ক্রমে মগেদের উৎপাত সুন্দরবন ছেড়ে অধুনা পূর্ববঙ্গের কিছু অংশে শুরু হয়। সেই অরাজকতা থেকে তৈরি হওয়া বিরক্তি আজও আমাদের মুখ থেকে প্রবাদ হয়ে বেরিয়ে আসে।
এক-দেড় দশক আগে বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে একটা কথা খুব জনপ্রিয় ছিল- হার্মাদ। এই শব্দের আমদানি পর্তুগিজদের হাত ধরে। যদিও তাদের ভাষাতেও সেই আসল শব্দ নেই, যা থেকে হার্মাদ শব্দের উৎপত্তি। স্পেনের নৌবাহিনীকে বলা হতো আর্মাডা। পর্তুগিজরা এই বাংলায় তাদের বিশাল নৌবহর নিয়ে ব্যবসা করতে এল। আমাদের প্রিয় সবজি আলু তারাই নিয়ে এসেছিল, কিন্তু ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ে তাদের মাথায় চাপল দুর্বুদ্ধি। সেই বিশাল নৌবহর নিয়ে তারা শুরু করল জলদস্যুবৃত্তি। লুঠপাট, খুন, পাচার কিছুই তারা বাদ রাখেনি। জলপথে তো বটেই, স্থলপথেও তাদের আতঙ্ক কম ছিল না। ব্যবসায়ী থেকে জলদস্যুতে পরিবর্তনের মতো বাঙালিদের উচ্চারণে 'আর্মাডা' হয়ে গেল হার্মাদ। শব্দটি নৌবহর থেকে জলদস্যুদের অত্যাচার বোঝাতে ব্যবহার হতে লাগল।
খরচ করতেই হবে কিন্তু টাকার জোগান সেইরকম নেই। এই পরিস্থিতিতে আমরা বলেই থাকি যে, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। হঠাৎ গৌরী সেন টাকা কেন দেবেন? আর গৌরী সেন এত টাকা দেবেন কিভাবে? কলকাতার ব্যবসায়ী গৌরী সেন অংশীদারিতে ব্যবসা করার সময়ে একটা ডুবে যাওয়া জাহাজ নিলামে কিনেছিলেন। তারা শুনেছিলেন যে, ওই ডুবে যাওয়া জাহাজে প্রচুর দস্তা আছে। জাহাজ কেনার পর দস্তা খুঁজতে গিয়ে তারা দস্তার আড়ালে প্রচুর রুপো খুঁজে পান যেগুলো সম্ভবত চোরাচালান করা হচ্ছিল। সেই রুপো পেয়ে গৌরী সেনের ভাগ্য খুলে যায়। অর্থ পেয়ে তিনি হয়তো নিজের জীবনের সংগ্রাম মনে রেখেছিলেন, তাই অসহায় মানুষের অর্থকষ্টে তিনি সাহায্য করতেন। তার দান-ধ্যানের কারণেই শুরু হয় এই প্রবাদ। গৌরী সেন কিন্তু মোটেই কোনও কাল্পনিক চরিত্র না। তাঁর বংশধররা আজও কলকাতা এবং আশপাশের এলাকায় নানারকম ব্যবসা করছেন।
বাংলার ইতিহাস আর বাংলা ভাষার জাদু হয়তো এখানেই। আমরা কেবলই কথা বলি না, তার পিছনে অনেক অজানা গল্প বলি। হয়তো জোর করে বাংলা ভোলার চেষ্টা না করলে এই গল্পগুলো প্রবাদ হিসাবে আরও কয়েকশো বছর বেঁচে থাকবে।