পুরুষকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটা! নবদ্বীপে যেভাবে তৈরি হয়েছিল প্রথম কালীমূর্তি
Kali Puja 2022: কীভাবে উৎপত্তি হয়েছিল কালীমূর্তির?
সবেমাত্র পরিবর্তিত হচ্ছে নবদ্বীপ। সঙ্গে বাংলায় প্রভাব কমছে চৈতন্যের। ঠিক এই মুহূর্তেই ফের বাড়ল শক্তির আরাধনা। কালো যাদু, তন্ত্র-মন্ত্র উচ্চারণে ব্যতিব্যস্ত তখন চারিদিক। অবিভক্ত বাংলার ছত্রে ছত্রে গড়ে উঠছে শক্তিচর্চার আরাধনা কেন্দ্র। ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা আসলে কেমন? দুই পন্থার শত্রুতা নিরসনে কীভাবে মেলবন্ধনের বাংলা রচিত হবে আবার? এই সমস্ত ভাবনার দোলাচলে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভুর বন্ধু নদিয়ার নবদ্বীপের কৃষ্ণনন্দ আগমবাগীশ। যিনি বৈষ্ণব নন, ছিলেন শাক্ত। কিন্তু মানসিকতায় ভিন্ন।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কে?
মূলত, তন্ত্রের সাধনার গীতা বলা হয় যাকে, সেই 'বৃহৎ তন্ত্রসার' গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত তিনি। নদিয়ার নবদ্বীপে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পরে তন্ত্রশাস্ত্রের জন্য ‘আগমবাগীশ’ উপাধি লাভ করেন কৃষ্ণানন্দ। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শান্তি এবং দর্শনধর্মী তন্ত্রসাধনার কথা যে কয়েকজন ভেবেছিলেন, তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। তন্ত্র সাধনার এই পথপ্রদর্শক বিখ্যাত আর একটি কারণেও। যিনি প্রথম গোটা দেশের মধ্যে এমন একটি জায়গায় বসে তন্ত্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। সেটি সম্পূর্ণভাবে ছিল বৈষ্ণবদের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ তথাকথিত দুই পন্থার বিভেদের সূত্রধার ছিলেন কৃষ্ণানন্দ। বলা হয় এমনও।
আরও পড়ুন: রোশনাইয়ের আনন্দ নয়, মনখারাপের দীপাবলি মাটির প্রদীপের কারিগরদের
কালী মূর্তির উদ্ভব
কথিত আছে, কৃষ্ণানন্দের সৃষ্টির আগে পৌরাণিক যুগ থেকেই নিরাকার ছিলেন কালী। শুধুমাত্র কল্পনা করে তাঁর আরাধনা চলত। শিলাখণ্ড অথবা মাটি দিয়ে ঘট তৈরি করে চলত দেবীর উপাসনা। মূলত, দক্ষিণা এবং রটন্তি কালীর রূপের মাধ্যমে সার্বিকভাবে কালীর রূপ প্রকাশ এই কৃষ্ণানন্দের হাত ধরেই। বলা, পূজার মন্ত্রের সৃষ্টির নেপথ্যেও রয়েছে তাঁর নামই।
কীভাবে তৈরি হলো প্রথম কালী মূর্তি
কথিত আছে, একদিন রাতে নাকি দেবী স্বয়ং কৃষ্ণানন্দকে স্বপ্নাদেশ দিলেন। সেই আদেশে তিনি বললেন, সকালে বেরিয়ে প্রথম যে নারীকে দেখবি, ওটাই আমার রূপ হবে। নিরাকার দেবী স্বপ্নে বললেন নিজের আকারের কথা।
পরদিন সকালে কৃষ্ণানন্দ গঙ্গাস্নানে যাচ্ছেন। এমন সময় গোপ-পাড়ার কাছে যেতেই তাঁর চোখে প্রথম পড়লেন এক গোপবধূ। যিনি ঘুঁটে দিচ্ছিলেন দেওয়ালে। একহাতে গোবর। ছোট শাড়ি পরনে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুন্দরী ওই মহিলা তাঁকে দেখে লজ্জায় জিভে কামড় দিলেন। সেই দৃশ্য দেখে বাড়ি ফিরলেন তিনি। ফিরেই মনে পড়ল সেই স্বপ্নের কথা। তারপরেই তিনি তৈরি করলেন মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি। সেই থেকেই কালীর রূপ প্রকাশিত হলো জনমানসে।
পরবর্তীকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে দিকে দিকে শ্যামা পূজার আবহে ছড়িয়ে পড়ল দেবীর এই রূপ। কৃষ্ণানন্দের দেওয়া রূপেই পূজিত হলেন কালী।
বর্তমান অবস্থা
আগমেশ্বরী মাতা। প্রায় ৪৫০ বছর ধরে এই পুজো চলছে নবদ্বীপের আগমেশ্বরী পাড়ায়। এখনও দীপান্বিতা অমাবস্যায় ওই রূপেই পূজিতা হন দেবী। বিরাট চোখ, কালো বর্ণ আর মাথায় সুসজ্জিত মুকুটে সেজে ওঠেন দেবী। মায়ের ভোগেও রয়েছে বিশেষত্ব। দেওয়া হয় অড়হর ডালের খিচুড়ি, মোচার ঘণ্ট, এঁচোড়ের ডালনা এবং চালতার টক। সারারাত হয় পুজো। পরের দিন দুপুর ১২টায় বেহারার কাঁধে চেপে মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় পাশের নদীতে। এখনও পুজোর দিন ভিড় জমে ওই অঞ্চলে। বিরাট জনসমাগমে মুখরিত হয় চারিদিক। কিন্তু স্রষ্টার পরিবারের পুজো হয় শান্তিপুরে।
শান্তিপুরে পুজোর সূচনা
একই আচার ৩৭৬ বছর ধরে পালিত হচ্ছে শান্তিপুরে। বলা হয়, এই পুজো নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরে নিয়ে আসেন কৃষ্ণানন্দের পরিবার। দেবীরূপ সৃষ্টির ৮৩-৮৪ বছর পর থেকেই শান্তিপুরে হয় পুজো।
যদিও এই ঘটনার পিছনেও রয়েছে কারণ। বলা হয়, শাক্ত-বৈষ্ণব বিরোধ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টায় কৃষ্ণানন্দের নাতি সার্বভৌম আগমবাগীশের সঙ্গে মথুরেশ গোস্বামী তাঁর নিজের মেয়ের বিয়ে দেন। এর পর নবদ্বীপ উত্তাল হয়। বৈষ্ণব-শাক্ত বিভেদে একঘরে হন সার্বভৌম। শান্তিপুরে মেয়ে, জামাইকে নিয়ে চলে আসেন মথুরেশ। বড় গোস্বামীদের পরিবারে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। এই পরিবারই পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সেখানে কালী পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এই সূত্রেই শান্তিপুরে বড় গোস্বামী পাড়ায় শুরু হয় কালীপুজো। সেই প্রতিমার নামও আগমেশ্বরী মাতা। যাঁর পুজো এখনও সাড়ম্বরে পালিত হয় ওই এলাকায়। যদিও শাক্ত এবং বৈষ্ণব বিভেদে একটা সময় দুই মেরুতে অবস্থান করত শান্তিপুর এবং নবদ্বীপ। আজ কৃষ্ণানন্দের বংশ পরম্পরায় শান্তিপুরে তৈরি হয় সেই মূর্তি। কোজাগরী পূর্ণিমার পর, পঞ্চমী থেকে একাদশী পর্যন্ত তৈরি হয় ছোট মূর্তি। তারপর রীতি মেনে একাদশীতে শুরু হয় বড় মূর্তির কাজ। তার আগেই চলে খড়ের কাজ। অমাবস্যা তিথিতে চক্ষুদান হয় দেবীর।