বাঙালির পাত অসম্পূর্ণ পোস্ত ছাড়া! এই শস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পলাশির যুদ্ধের ইতিহাসও
History of Posto: চাহিদার দিক থেকে হল্যান্ডের উৎপাদিত পোস্তর চাহিদা সব থেকে বেশি। এই পোস্ত দেখতেও বেশ আলাদা, এর রঙ খানিকটা স্লেট-ব্লু।
আজ নয়, প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালির রান্নাঘর কাঁপিয়ে চলেছে ছোট্ট একটা দানা। ‘ঘটিবাড়ি’র রান্নার মেনুতে অবশ্যম্ভাবী পদ, বাংলার হেঁশেলের অন্যতম দামী উপকরণ এই ছোট্ট তৈলবীজটিকে টেক্কা দিতে পারার মতো কিছুই বোধহয় এতদিনেও সামনের সারিতে উঠে এল না। সে একা, অদ্বিতীয়ম। সে বাংলা তথা ভারতীয় রান্নার মহামূল্যবান উপকরণ পোস্ত। সাধারণত বীজ আকারে অথবা গুঁড়ো আকারেই রান্নায় ব্যবহার হয়ে থাকে পোস্ত। যদিও, কখনও কখনও পিষে নিয়ে পোস্তদানার তেলও তৈরি করা হয়।
বাঙালি রান্নায় সাদা পোস্তর ব্যবহারের ফর্দ করতে বসলে তা শেষ হওয়া মুশকিল। কখনও বিউলি বা কলাই ডালের সঙ্গে, কখনও আলুর সঙ্গে মিশে আলুপোস্ত অথবা ঝিঙের সঙ্গে মিশিয়ে ঝিঙেপোস্ত, পটলের সঙ্গে মিশিয়ে পটলপোস্ত, টমেটোর সঙ্গে মিশিয়ে টমেটো পোস্ত রান্না করা হয়। একই সঙ্গে রান্নায় সরষের তেলে, পোস্ত, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে ফোড়নও তৈরি করা যায়। আর পোস্তর বড়ার কথা না বললে সত্যিই অবমাননা হবে এই উপকরণটির। ভারতীয় রন্ধনশৈলীর একজন অত্যন্ত সুপরিচিত লেখক এবং ইতিহাসবিদ চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি লেখায় জানিয়েছেন, “এটি অন্যান্য রান্নায় ব্যবহার করা হয় ঠিকই, তবে এর এত বিস্তৃত এবং একইসঙ্গে একক ব্যবহার শুধুমাত্র বাংলায় দেখা যায়।”
যদিও ইতিহাস বইয়ের পাতায় পোস্তর সঠিক মূল্যায়ন পাওয়া যায় না। শোনা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ সালে অর্থাৎ ব্রোঞ্জ যুগে মিনোয়ান সভ্যতায় পোস্ত দানার চাষ প্রচলিত ছিল। দুধ, আফিম, মধু ইত্যাদি খাদ্যবস্তুর সঙ্গে মিশিয়ে এবং সেই মিশ্রণ খাইয়ে বাচ্চাদের শান্ত করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ থেকে ১৪৫০ মিনোয়ান সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং বোঝাই যায় পোস্তদানা চাষ আসলে কতটা প্রাচীন। লোকগাথায়ও পোস্ত দানার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে পোস্তদানার সঠিক মূল্যায়নও করা হয়েছে। পোস্তদানাকে ঘুমের ওষুধ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি, এমনকী লোকবিশ্বাসে পোস্ত ধন সম্পদ বাড়াতেও সাহায্য করে বলে মনে করা হয়। লোকবিশ্বাসে পোস্তদানাকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হিসাবেও দেখানো হয়েছে নানা কাহিনিতে।
আরও পড়ুন- প্রযুক্তি-অর্থ-ক্ষমতা, সবেতেই এগিয়ে NASA, তবু কোথায় টেক্কা দিতে পারে ISRO?
বলাইবাহুল্য, পোস্তর সঙ্গে ভারতের রন্ধন ইতিহাসের এক দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। আগেকার দিনে কেবল রান্নায় এক সুস্বাদু মশলা হিসেবেই নয়, ঔষধি গাছ হিসেবেও পোস্তর ব্যবহার ছিল বিশাল গুরুত্বপূর্ণ। মুঘলযুগে সম্রাট আকবরের শাসনকাল থেকে এই বীজটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। ফলস্বরূপ, সম্রাটের নির্দেশে এই তৈলবীজের চাষ বৃদ্ধি পায়। আসলে এক সুন্দর লাল রঙের রাজকীয় ফুল থেকে এই তৈলবীজ মেলে। যদিও এবিষয়ে ব্রিটিশদেরও এক বিশেষ ভূমিকা আছে।
ব্রিটিশরা যদি চিনে আফিমের বিপুল অবৈধ বাজার আবিষ্কার না করত তাহলে হয়তো পোস্তর এই বিস্তৃতি ঘটত না। লক্ষ্য করার বিষয়, ১৭৫৭ সালে হওয়া পলাশির যুদ্ধের সঙ্গেও পোস্তর একটি ঐতিহাসিক যোগ রয়েছে। অমিতাভ ঘোষের জনপ্রিয় উপন্যাস, ‘সি অফ পপিসে’র মূল বিষয়বস্তুই হল ভারতের একটি বিশেষ আফিম উৎপাদনকারী অঞ্চলে এক গ্রামীণ মহিলার সঙ্গে একটি পোস্ত বীজের প্রাণবন্ত সাক্ষাৎ। যে সময় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় তখন দেশে প্রায় ১৩ লক্ষ কৃষক পরিবার পোস্ত চাষ করত। উনিশ শতকের শেষের দিকে পোস্ত চাষ উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার রাজ্যের প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে।
ভারতে আফিম চাষের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ নিজেদের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানি এই অবাধ বাণিজ্যের অধিকার মূলত দু’টি যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছিল, যা চিনকে বাধ্য করে ভারতীয় আফিমের জন্য নিজেদের দরজা খুলতে। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল, ‘দ্য অ্যানার্কি’-তে লিখেছেন, “হংকংয়ের কাছাকাছি একটি আফিমের বিশাল ক্ষেত দখল করতে চিনা সেনারা নির্মমভাবে গণহত্যা করে। পরবর্তীকালে ইংরেজরা তাদের থেকে দখল নিয়ে এই পাপই ফিরিয়ে দিয়েছিল চিনাদের।” ইতিহাসবিদদের দাবি, আফিম ব্যবসা ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং কৃষকদের পরিবারেও সমৃদ্ধি এনেছে।
আরও পড়ুন- আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
পোস্তদানার হদিশ যেহেতু আফিম থেকে পাওয়া যায় তাই এই ফসল চাষকে ঘিরেও অনেক বিতর্ক জন্ম নেয়। আফিম বা গাঁজার ‘বাই প্রোডাক্ট’ হিসাবে পোস্ত পাওয়া যায়। তাই পোস্ত চাষে সরকারের বিবিধ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকা স্বাভাবিক। পোস্তদানা আকারে খুবই ছোট, প্রায় এক মিলিমিটারেরও কম এমন ৩৩০০ টি পোস্তদানা নিয়ে মাত্র ১ গ্রাম পোস্ত পাওয়া যায়। সেই কারণেই পোস্তর বাজারমূল্য এত বেশি। সারা বিশ্বের অনেক দেশেই পোস্ত উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ২২৬৬৫ মেট্রিক টন পোস্তদানা উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে চাহিদার দিক থেকে হল্যান্ডের উৎপাদিত পোস্তর চাহিদা সব থেকে বেশি। এই পোস্ত দেখতেও বেশ আলাদা, এর রঙ খানিকটা স্লেট-ব্লু। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে কৃষি জমির একটি বিরাট অংশ জুড়ে চাষ হত পোস্তর।
পোস্ত নিরামিষ খানার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে নিজের ঠাঁটবাট জমিয়ে ফেলেছে আমিষের দলেও। পোস্ত রুই থেকে শুরু করে চিংড়ি পোস্ত, পোস্ত চিকেন, ডিম পোস্ত, এমনকী ইলিশ পোস্ত- সবেতেই মিশে গিয়েছে এককালের ঘুমের দাওয়াই পোস্ত। এক্সপেরিমেন্টাল রান্নায় মজতে চাওয়া বাঙালির কাছে সবেধন নীলমণি হয়ে ইঠেছে পোস্ত। যদিও, আম বাঙালির ঘরে এখন পোস্ত বিলাসিতারই ডাকনাম।