পিরামিডের যুগেও ছিল তন্দুরের চল, দেখতে কেমন ছিল প্রাচীন ভারতীয় চুলাগুলি?
Origin Of Tandoor Ovens : তন্দুর চুলা সঙ্গে করে বেড়াতে যেতেন সম্রাট শাহজাহান! কীভাবে ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই পদ?
খাবারের দুনিয়ায় এখন স্থান কালের ভেদাভেদ প্রায় নেই বললেই চলে। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের খাবার এখন একযোগে মেলে রেস্তোরাঁয়। তাছাড়া এখন তো আবার ফিউশন খাবারের চল, তাতেই মিলে মিশে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিভিন্ন পদ। শুধু দেশি খাবারের মেলবন্ধনের কথাই বা কেন, এ দুনিয়ায় বিদেশি খাবারের আনাগোনাও চলে নিরন্তর। আজকাল বিদেশের সর্বত্র মেলে বাঙালি খাবারের আস্তানা। তবে এই গল্পটা আজকের নয়, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ ককেশাসে প্রভৃতি জায়গায় প্রথম শুরু হয়েছিল তন্দুরের চল। তার পর অবশ্য তা নিজস্ব স্বাদ যশে কবেই বাড়িতে এসে পড়েছে তার সঠিক হিসাব কষা মুশকিল। এখন বাঙালির হেঁশেলেও তন্দুরের স্বাদ জমে ক্ষীর। তাছাড়া ইউটিউবের দৌলতে আজকাল রেসিপিও হাতের মুঠোয়!
যদিও প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে রান্নার উপকরণ থেকে শুরু করে আধার, সবই। আজকাল বিভিন্ন আধুনিক মডেলের তন্দুর ওভেনের পাশাপাশি মাইক্রোওভেনেও রান্না করা হয়। তবে সাবেকি আমলের দিকে ফিরে তাকালে তন্দুর মানেই বোঝায় একটা কোনও চুলা আর তাতে পুড়িয়ে রান্না। মূলত নলাকার কাদামাটি বা ধাতুর তৈরি চুলাকেই তন্দুর বলা হতো সে যুগে।
দেখতে অনেকটা ছিল ঠিক লম্বা কলসির মতো। বিভিন্ন সাইজের হতো। সর্বনিম্ন এক মিটার থেকে শুরু করে কয়েক ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হতো এই ওভেনগুলি। বিশাল মাটির কলসগুলিকে সাধারণত ব্রিটানিকায় তৈরি হতো। এগুলিই ছিল প্রাচীনকালের তন্দুর ওভেন। ঐতিহ্যগতভাবে, ওভেনগুলিকে প্রথমে কাঠকয়লার আগুনে উত্তপ্ত করা হতো, তারপর জ্বলন্ত গরম তাপমাত্রায় পৌঁছলে খাবার অর্থাৎ মাংস দিয়ে পুড়িয়ে রান্না করা হতো। তন্দুর শব্দটি এসেছে হিন্দি অথবা উর্দু তানদুর থেকে যা ফার্সি তানর শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হল মাটির চুলা । দেহখোদা ফার্সি অভিধান মতে, ফারসি শব্দটি মূলত এসেছিল আক্কাদিয়ান শব্দ তিনুরু থেকে। যেখানে এর অর্থ ছিল কাদা এবং আগুন নিয়ে গঠিত চুলা বিশেষ।
আরও পড়ুন - কাঁচা খাবার রান্না করা শুরু হয়েছিল ঠিক কবে থেকে? যে রহস্য লুকিয়ে ভারতের রান্নার ইতিহাসে
বর্তমানে আমরা তন্দুর চুলাকে তথা তন্দুর পদকে একচেটিয়াভাবে ভারতীয় রন্ধনশৈলীতে ভাবি, তবে এর নাগাল অন্যান্য সংস্কৃতিতেও প্রসারিত। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এর তরফে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠী সাধারণত জিনজিয়াং প্রদেশে তন্দুর চুলা ব্যবহার করে। প্রায় ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান রাজবংশের অধীনে প্রতিষ্ঠিত সিল্ক রোড বাণিজ্য রুটের মাধ্যমে ভারত থেকে চীনে এই ওভেন গুলি যাতায়াত করত। অর্থাৎ এ ঘটনার সময়কালও আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে। যদি অত দিন আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হতো ভারতীয় ছিল তাহলে ভারতে সেগুলি তো আরো বহু আগেই তৈরি গিয়ে গিয়েছিল নিশ্চিত। জানেন ঠিক কতদিন আগে ভারতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল তন্দুর চুলা?
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, সম্প্রতি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিকরা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালের কিছু তন্দুর চুলার অবশিষ্টাংশ আবিষ্কার করেছেন। অর্থাৎ সেই গবেষণা থেকে আঁচ করা যাচ্ছে যে মিশরের পিরামিডের সমসাময়িক ছিল ভারতের তন্দুর চুলা। সুতরাং আজকের বহুল চর্চিত এই তন্দুরকে বিশ্বের প্রথম সভ্যতার একটি পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যে যায়, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি ব্রিটানিকা উল্লেখ করেছে যে, রাজস্থান একসময় সিন্ধু সভ্যতার একটি অংশের আবাসস্থল ছিল, যা হরপ্পান নামেও পরিচিত। লাইভসায়েন্স অনুসারে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে উদীয়মান, মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধু সভ্যতাও ছিল প্রাচীনতম মানব সভ্যতার একটি। ফলে সব মিলিয়েই তন্দুরের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের আর অবকাশ থাকে না।
আরও পড়ুন - মজেছিলেন আকবর থেকে রানি ভিক্টোরিয়া! খিচুড়ির অবাক করা ইতিহাস আজও অজানাই
যদিও এত দিনের এই প্রাচীন ঐতিহ্যের সবটুকুই আড়ালে রয়ে গিয়েছে তন্দুরের। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে তৈরি এই চুলাটি কার্যাবলীর দিক থেকে অবশ্য খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তার বাইরের গঠনে হয়তো কিছু পরিবর্তন ঘটেছে তবে সাবেকিয়া এখনও অটুট। নিউ ইয়র্ক টাইমস এর একটু ব্যাখ্যায় জানা যায়, রাজস্থানে পাওয়া প্রথম দিকের তন্দুরগুলি স্পষ্টতই ফ্ল্যাটব্রেড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ আজও তন্দুর পদের তালিকায় ভারতীয় নান এবং রোটি রান্নার পাশাপাশি তুর্কমেনিস্তানের চোরেক রান্নার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে একটি তন্দুরে তির্যক মাংস ভাজানোর অনুশীলনের সন্ধান মেলে। আর এই তন্দুর অর্থাৎ পোড়ানো মাংসের পদের একজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা ছিলেন তাজমলের নির্মাতা সম্রাট শাহজাহান। আরও জানা যায় যে, তাঁর কাছে একটি পোর্টেবল তন্দুর কাস্টম-মেইড ছিল। বাড়ি তো বটেই এমনকী ভ্রমণের সময়েও এই যন্ত্রটিকে কাছ ছাড়া করতেন না শাহজাহান। সম্রাটের সেই প্রাচীন সময় থেকে আজও তন্দুর পদ রান্নার পদ্ধতি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। কেবল বদলে গিয়েছে প্রজন্ম, আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন নতুন তন্দুর খাবার। কিন্তু সাবেকিয়ানা এবং প্রাচীনত্বের নিরিখে আজও তন্দুরের বিকল্প নেই।