সংবিধানই অস্ত্র! লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখাচ্ছেন কেরলের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী!

Kerala's First Transgender Lawyer: ২৭ বছরের এই মানুষটি কেরলের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী!

জীবনে, বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং পরিবেশ মানুষকে ভাষাহীন করে তোলে। মানুষ প্রশ্ন করার ক্ষমতা হারায়, লড়ার মানসিকতা নেতিয়ে পড়ে। এই অনন্ত ভাষাহীন মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখান, সত্যের জন্য লড়তে শেখান পদ্মলক্ষ্মী। অন্যায়ের মুখোমুখি হওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর হতে চান পদ্মলক্ষ্মী। কে এই পদ্মলক্ষ্মী? ২৭ বছরের এই মানুষটি কেরলের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী! পরিবার এবং অধ্যাপকদের অদম্য সমর্থনে কেরল বার কাউন্সিলে সদ্য আইনজীবী হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছেন পদ্মলক্ষ্মী। সে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পি. রাজীব তাঁর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পদ্মলক্ষ্মীর ছবি দিয়ে এই খবরটি মানুষকে জানিয়েছেন৷ লিখেছেন, "প্রথম হওয়া সবসময়ই ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অর্জন। এই লক্ষ্যের পথে কোনও পূর্বসূরি নেই। বাধা তো অনিবার্য। দমিয়ে দেওয়ার, নিরুৎসাহিত করার লোকও থাকবে। এসব কাটিয়েই আইনি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন পদ্মলক্ষ্মী"।

২০২২ সালে এর্নাকুলামের সরকারি আইন কলেজে ৩ বছরের পড়াশোনা চুকিয়ে আইনের ডিগ্রি অর্জন করেন লক্ষ্মী। আর নিজের এই পড়াশোনার পর্বে অধ্যাপকদের সমর্থন তিনি পেয়েছেন বিপুল। আইন নিয়ে পড়ার আগে এর্নাকুলামেরই ভারত মাতা কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। "আমার কলেজের দিনগুলো খুবই দুর্দান্ত ছিল। আমার শিক্ষক, ডাঃ মারিয়াম্মা এম.কে এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ আগিথা টি.জি. সবসময় আমাকে সমর্থন করতেন। তাঁরা সবসময়ই বলতেন, আরও এগিয়ে যেতে হবে, ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে এবং নিজের লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে হবে,” এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন পদ্মলক্ষ্মী। নেতিবাচক বিষয় নিয়ে না ভেবে নিজের স্বপ্নকে গুরুত্ব দিতে তিনি শিখেছেন নিজের শিক্ষকদের থেকেই।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন

রূপান্তকামী হিসেবে কতটা কঠিন ছিল তাঁর লড়াই? বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন কি সমস্ত ক্ষেত্রেই? বৈষম্য নিয়ে ভাবতে আগ্রহীই নন পদ্মলক্ষ্মী! নিজের লক্ষ্য তিনি স্থির করে ফেলেছেন। নিজের বঞ্চনা বা বৈষম্য নয়, বরং যারা বৈষম্য ও অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন তাদের পক্ষে কথা বলা এবং তাঁদের হয়ে সওয়াল করার লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। এই মাঠ তাঁর একার, এখানে তিনিই লড়বেন, পড়বেন, উঠবেন, আবার লড়বেন।

পরিবারে তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট লক্ষ্মীই। বাবা-মা এবং ভাই-বোনরাই তাঁর ভরসা এবং অনুপ্রেরণা। যখন নিজের এই রূপান্তরকামী চেতনাকে প্রথমবার মা বাবার সামনে মেলে ধরেন পদ্মলক্ষ্মী, একটুও অপমান বা লজ্জার মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। বাবা ছিলেন পেশায় একজন ঠিকাকর্মী, মা ছিলেন একজন অ্যাডভোকেটের সহযোগী করণিক। মেয়েকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন দু'জনেই। কর্মক্ষেত্রে তাঁর সিনিয়র, অ্যাডভোকেট কেভি ভদ্রা কুমারী এবং কেরল হাইকোর্টের অন্যান্য আইনজীবীদের কাছ থেকেও একই ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছিলেন পদ্মলক্ষ্মী।

ভারতের সংবিধান বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অস্ত্র, মনে করেন পদ্মলক্ষ্মী। ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। মানসিকতার বদল তো বটেই, পাশাপাশি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমেই বঞ্চনার মোকাবিলা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। একজন আইনজীবী হিসাবে তাই তাঁর লক্ষ্য, রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে লড়ে যাওয়া। পদ্মলক্ষ্মী বিশ্বাস করেন, সংবিধান এক স্বচ্ছ বই, এই বই এক অস্ত্র যা দিয়ে ন্যায়বিচারের জন্য লড়ে যাওয়া যায় আজীবন। এখানেই শেষ না, পদ্মলক্ষ্মী জানিয়েছেন, নিজের আইনের বইগুলি প্রান্তিক শ্রেণির যে কোনও পড়ুয়া, যারা ভবিষ্যতে আইনজীবী হতে আগ্রহী, তাদের পড়তে দিতে পারেন তিনি। নিজের পড়ুয়া জীবনে হাতখরচা চালাতে বেসরকারি এক বীমা সংস্থা এবং LIC-র এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। চিকিৎসা আর শিক্ষার খরচ মেটাতে টিউশনিও পড়িয়েছেন।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী সন্তানকে নিয়ে গর্বিত বাবা, ভারতীয় অভিভাবকরা শিখবেন?

ভারতে সমকামী বিবাহের স্বীকৃতির বিষয়ে আগামী মাসে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ একটি সিদ্ধান্ত নেবে। পদ্মলক্ষ্মীর আশা, সুপ্রিম কোর্ট ইতিবাচক রায় দেবে।

নির্বাচন কমিশন ২০০৯ সালে ভোটার রেজিস্ট্রেশন ফর্মগুলিতে 'অন্যান্য' বিভাগ জুড়ে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেয়। ২০১৪ সালে, সুপ্রিম কোর্ট রূপান্তরকামীদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে জানায়, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি তাদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। তারা নিজেদের পুরুষ বলবেন না কি মহিলা বা তৃতীয় লিঙ্গ তা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকার। ট্রান্সজেন্ডারদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চাকরিতে ভর্তিতে সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হবে বলেও জানায় শীর্ষ আদালত। যদিও গত মাসেই, সামাজিক বিচার মন্ত্রক লোকসভায় জানায়, শিক্ষা বা চাকরিতে রূপান্তরকামীদের জন্য সংরক্ষণের কোনও প্রস্তাব নেই।

২০১৭ সালে, জয়িতা মণ্ডল ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী বিচারক নিযুক্ত হন। পশ্চিমবঙ্গের ইসলামপুরের লোক আদালতে নিযুক্ত হন তিনি। পরের বছর, সত্যশ্রী শর্মিলা তামিলনাড়ু এবং পুদুচেরির বার কাউন্সিলে নাম নথিভুক্ত করেন দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার আইনজীবী হিসেবে। ওই একই বছর, রূপান্তকামী বিদ্যা কাম্বলে মহারাষ্ট্রের নাগপুরের এক লোক আদালতে সদস্য বিচারক নিযুক্ত হন এবং স্বাতী বিধান বড়ুয়া অসমের গুয়াহাটিতে লোক আদালতে সদস্য বিচারক হিসাবে নিযুক্ত হওয়া তৃতীয় রূপান্তরকামী বিচারকের মর্যাদা পান।

More Articles