সে ছিল এক অন্য 'দুয়ারে সংস্কৃতি'! উত্তরবঙ্গের সেই মেলায় তৈরি হয়েছিল ইতিহাস
আমরা মনে করতাম, শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমের যে আন্তঃসম্পর্ক, তাকে একই মঞ্চে উপস্থাপিত করতে হবে। সেই মঞ্চ হবে খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে, হাটেবাজারে, খোলামেলায়।
দুয়ারে সংস্কৃতি!
না, এটা কোনও রাজনৈতিক টীকাটিপ্পনী নয়।
এ-দুয়ার সে-দুয়ার নয়, এ হলো ডুয়ার্স, তোর্সা নদীর তীরবর্তী আলিপুরদুয়ার। যা আবার দুয়ারও বটে। একসময় এই আলিপুরদুয়ারকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সমান্তরাল সংস্কৃতির বিস্তার। বিস্তার বলছি বটে, তবে তা খুব একটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। তার নানা রকমের কারণ ছিল। তা আর এখানে বিশদে লেখার কোনও প্রয়োজন দেখি না। আসলে একটা উদ্যোগ, পরিকল্পনা যেমন সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয় তেমনই কালের নিয়মেই তার ছেদ পড়ে। তো এই দুয়ারেই শুরু হয় আমার ডুয়ার্স দেখা। পরবর্তীকালে প্রায় চষে বেড়িয়েছি, ছবি করেছি একটার পর একটা। কিন্তু সেই প্রথমবেলার আকর্ষণ আজও ভুলতে পারিনি।
এর মূল ভূমিকায় ছিল আমার এক প্রিয় বন্ধু, দিবাকর ভট্টাচার্য। দিবাকর একজন কবি, গদ্যকার ও সম্পাদক। একটি চমৎকার আধুনিক পত্রিকা সম্পাদনা করতো আটের দশকে। সেই 'দ্রোহ' নামের পত্রিকায় বহু লেখা লিখেছি। পত্রিকা বের করতে হবে, প্রকাশনা তৈরি করতে হবে বলে মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে দিবা (ডাক নাম) আস্ত একটা ছাপাখানাই তৈরি তৈরি করে ফেলে। আলিপুরদুয়ারের কোর্ট মোড় এলাকায় 'যুক্তপ্রয়াস' নাম দিয়ে ওর বন্ধু সুজিতের সঙ্গে এই লেটারপ্রেসের তখন ছিল রমরমা। কিন্তু উদ্যোগী যে, সে কি আর এতেই থেমে থাকে। এরপর বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে শুরু করে একটি ভিন্ন ধরনের প্রকাশনালয়। এই প্রকাশনালয় নিয়ে নানা সমস্যার জন্য দিবা তার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। পরবর্তী সময় একটি যৌথখামারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে চাষবাসে মন দেয়। যৌথখামার চলেনি, কিন্তু চাষআবাদে প্রাণপাত করে চলে বামপন্থী কবি ও গদ্যকার দিবাকর ভট্টাচার্য।
আরও পড়ুন: বামপন্থী আন্দোলন করতে গিয়েই জেল খাটা, তবু বামেরা বলেছিল সিআইএ-র দালাল
আসলে দিবাকরের উদ্যোগের শেষ ছিল না। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তখন আমাদের বয়স কম। নানা ধরনের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার জাল বুনে যাচ্ছি আমরা। সেই সময় আমরা মনে করতাম, শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমের যে আন্তঃসম্পর্ক, তাকে একই মঞ্চে উপস্থাপিত করতে হবে। সেই মঞ্চ হবে খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে, হাটেবাজারে, খোলামেলায়। এতে একটা মিথোষ্ক্রিয়া (ইন্টার্যাকশন) তৈরি হবে। দর্শক তথা পাঠকসমাজ সরাসরি যুক্ত হতে পারবে শিল্প-সংস্কৃতির কর্মপ্রণালী ও আন্তঃভাষাগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে। একথা পড়তে অনেকটাই কাঠখোট্টা সাহিত্যিক তত্ত্বনির্ভর আপ্তবাক্য মনে হতে পারে। আদতে বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণতই ভিন্ন।
তো সেই দিবাকরকে প্রথম এই চিন্তাভাবনার কথা বলি। তখন এই ধরনের অনুষ্ঠান আমরা লাগাতার করে যাচ্ছি কলকাতা শহর ও পার্শ্ববর্তী নানা শহরে। মানুষজন আসছে, দেখছে, শুনছে, প্রশ্ন করছে, তারিফ করছে। দিবাকরের উৎসাহেই আমরা ঠিক করি যে, আলিপুরদুয়ারে এমন একটা অনুষ্ঠান আমরা তিনদিন ধরে করব। তারও নাম হবে 'খোলামেলা'। কী হবে সেখানে? গান, নাটক, চিত্রকলার প্রদর্শনী, লিটল ম্যাগাজিনের স্টল আর প্রতিদিন একটা করে সিনেমা দেখানো। ঠিক হয়ে গেল, নদীভিত্তিক তিনটি সিনেমা, ঋত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম', বারীন সাহার 'তেরো নদীর পারে' আর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের 'নাগমতী'। মনে রাখতে হবে, তখন কিন্তু ফিল্মের যুগ। এক-একটা ছবি, মানে দশ থেকে পনেরো বা বিশটি জাম্বো ক্যান। সেগুলো ছিল অসম্ভব ভারি।
ঠিক হলো, কলকাতা থেকে যাবতীয় বিষয়গুলির আয়োজনের দায়িত্ব থাকবে আমার আর আলিপুরদুয়ারে দিবাকরের তত্ত্বাবধানে আয়োজন সম্পূর্ণ হবে। সে কি আর যেমন-তেমন আয়োজন! একটা জনাদশেকের নাটকের দল, প্রায় জনাপাঁচেক ছবি আঁকিয়ে, চারজন বাউল আর কিছু লেখক-কবি আর আমার মতো কয়েকজন শ্রমিক সদস্য নিয়ে আমরা রওনা দিলাম আলিপুরদুয়ার। ট্রেনে কোনও আসন সংরক্ষণ নেই। সস্তার টিকিটে আমরা ট্রেনে চাপলাম সেই বিস্তর মালামাল নিয়ে। রাস্তায় খাদ্যখাবার বলতে প্রত্যেকের বাড়ি থেকে আনা খাবারদাবার মিলেজুলে খাওয়া। একমাত্র চা আমরা কিনে খেয়েছি। তখন আমাদের পয়সা কোথায়?
আলিপুরদুয়ারে পৌঁছলাম আমরা সময় মতো। সেখানে রেলের একটা হল ও তৎসংলগ্ন মাঠে আমাদের জায়গা হলো। পৌঁছেই শুনলাম, দিবাকরকে আর্থিক সাহায্য করার কথা যারা দিয়েছিল, তারা কেউ কথা রাখেনি। সব শুনে বললাম, তাই তো হয়, কেউ কথা রাখে না। কিন্তু তাহলে কি করা? এসেছি যখন, বলেছি যখন, তখন এই অনুষ্ঠান করতেই হবে। আমাদের সঙ্গেই গিয়েছিলেন নদিয়ার প্রখ্যাত বাউল-গুরু সুবল দাস বাউল ও জনপ্রিয় দোতারা শিল্পী নিমাইচাঁদ। তাদের বললাম, আগামীকাল সকালে আমরা সমস্ত বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এলাকায় ভোরগান বা প্রভাতী গান করব এবং মাধুকরী করব, যাকে ওরা বলে টহল। সেটা ছিল একটা রেলের কলোনি। মূলত পূর্ববঙ্গের মানুষের বাস।
তা যেমন বলা তেমন কাজ। প্রথমদিন ভোর সকালে ঘণ্টাখানেক ঘুরে পর্যাপ্ত দান পাওয়া গেল। প্রচার হলো অনুষ্ঠানের। সন্ধে থেকে লোকে লোকারণ্য। গান হলো, বাজনা হলো, কবিতা পড়া হলো, চিত্রকলা ও সিনেমা দেখানো হলো। খোলামেলায় ভরে উঠল ভিন্ন সংস্কৃতির মুক্তধারা। তৎকালীন সময় প্রতিদিন অত চালডাল, সবজি আর টাকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিল। পাঠক আর দর্শকের মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি হলো। তবে তা পর্যায়ক্রমে আর করা যায়নি। কিন্তু অল্টারনেটিভ কালচারের একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেল। আজ কি কেউ তথাকথিত স্পনসর ছাড়া এই ধরনের অনুষ্ঠান করতে পারবে? কিন্তু দিবাকর পেরেছিল।
ওহ্ , বলতে ভুলেছি গত মাসে নিঃসঙ্গ দিবাকর চলে গেছে কাউকে কিছু না বলে, কোনও কথা না রেখে।
আমি কোন ভাষার আড়াল নেব?