নিজের হাতে তৈরি দলই কোণঠাসা করে দিয়েছিল শম্ভু মিত্রকে

শোনা যায়, তাঁর নিজের দলেই তিনি একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। এও শোনা যায় যে, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেয়নি তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা দল।

বাড়িতে সেসময় একটা স্পুল রেকর্ডার ছিল বাপের। তার মধ্যে নানা কিছু তিনি সংগ্রহ করে রাখতেন। সেখানে যেমন হরেকৃষ্ণ কোঙার কিংবা বি. টি. রনদিভের জ্বালাময় ভাষণ শুনেছি, তেমনই শম্ভু মিত্রর স্বকন্ঠে 'মধুবংশীর গলি'-র আবৃত্তিও শুনেছি। সেই প্রথম শম্ভু মিত্র। অত বড় কবিতাটা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তাঁর পাঠের বিশুদ্ধতায়। তবে আমার পারিবারিক গণ্ডিতে তাঁকে নিয়ে তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি। বরং উল্টোটাই টের পেয়েছি।

পরবর্তীতে তাঁর শেষদিকের অভিনয়ের সাক্ষী থেকেছি রাত জেগে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে।

কিন্তু কম বয়সে ওঁর যত প্রশস্তি শুনেছি, তেমনই প্রভূত বিরোধিতার বিষও নিয়েছি কানে। শুনেছি উনি দাম্ভিক, উনি গণনাট্য ভাঙার কারিগর, উনি অসম্ভব বাম-বিরোধী। সমস্তটাই লোকমুখে, এবং তাঁরা ছিলেন ঘোরতর বামপন্থী।

এরও বহু পরে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার বরাত পাই শম্ভু মিত্রকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের। এই কাজটা করতে প্রায় সারা ভারতের বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এখানকার বহু লেখক-শিল্পীর সঙ্গেও কথা বলতে হয়েছিল সেই ছবির প্রয়োজনে। অন রেকর্ড সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও একমাত্র শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ব্যতিক্রম।

আরও পড়ুন: সে ছিল এক অন্য ‘দুয়ারে সংস্কৃতি’! উত্তরবঙ্গের সেই মেলায় তৈরি হয়েছিল ইতিহাস

শমীকদা সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন শম্ভুবাবুর ফিজিক্যাল অ্যাকটিং নিয়ে। এও বলেছিলেন যে, উনি বাচিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে যতটা জোর দিয়েছিলেন, শরীরের ভাষাকে ততটা উপলব্ধি করতে পারেননি। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে ড. শ্রীরাম লাগু আমাদের বলেছিলেন, শম্ভুদার কাছে শিখেছি যে, অ্যান অ্যাকটর হ্যাজ টু বি অ্যান অ্যাথলিট-ফিলোজফার।

Theatre scene

'রাজা অয়দিপাউস' নাটকে শম্ভু মিত্র

ব্যক্তিগতভাবে আমার দেখা শম্ভু মিত্রর অভিনয়ের একটা খণ্ডস্মৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে চাই। তখন ওঁর বয়স হয়েছে। ফ্রিৎস বেনেভিৎস কলকাতায় এসেছিলেন 'গ্যালিলিওর জীবন' পরিচালনা করতে। শম্ভু মিত্র গ্যালিলিও। শহরের সবক'টি গ্রুপ থিয়েটারের তাবড় অভিনেতা অভিনয় করেছিলেন সেই নাটকে। আমার সুযোগ হয়েছিল সেই নাটক দেখার। একা শম্ভু মিত্রই যেন সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, সে এক দুরন্ত অভিজ্ঞতা। প্রথম দৃশ্যেই তিনি খালি গায়ে একটা বারমুডা ধরনের কালো প্যান্ট পড়ে মঞ্চের এ-মাথা থেকে ও-মাথা যে প্রবল বিক্রমে রীতিমতো দৌড়ে বেড়ালেন, তা দেখে শমীকদার কথাকে মেনে নিতে পারিনি। তবে উনি বাচিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন সে-বিষয় মানতে বাধা নেই।

যে সমস্ত ব্যক্তি ওঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছিলাম ছবির জন্য। সব ছবিতে রাখা যায়নি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। শ্যামানন্দ জালান বলেছিলেন। তখন উনি ধর্মতলার কটেজ ইন্ডাস্ট্রি বাড়িটার ওপরতলায় থাকতেন। সেখানে শম্ভু মিত্র 'পাগলা ঘোড়া'-র রিহার্সাল করাতে যেতেন। কথামতো ঠিক পাঁচটার সময়। প্রতিদিন ঠিক পাঁচটার সময় কলিং বেল বাজতেন শম্ভু মিত্র। জালান ও তাঁর স্ত্রী তো যারপরনাই বিস্মিত। রোজ একেবারে একই সময়? এক মিনিট এদিক-ওদিক নেই? শম্ভু মিত্রকে জিজ্ঞেস করাতে উনি কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু হেসেছিলেন। তো একদিন এইরকম সময় শ্যামানন্দ জালান বারান্দায় এসে দেখেন যে, শম্ভু মিত্র বাড়ির নিচে পায়চারি করছেন আর ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন।

সেদিন বোঝা গেল বিষয়টা। উনি পাঁচটার আগেই পৌঁছে যেতেন। ওঁর সময়জ্ঞান দেখার মতো, শেখার মতো।

এই কাজের সুবাদেই দেখা করেছিলাম গুজরাতি নাট্যকার জয়ন্ত পারিখের সঙ্গে। তাঁর কাছেই এই ঘটনার কথা জানতে পারি। তখন গুজরাতি ভাষায় 'রক্তকরবী' রিহার্সাল করাচ্ছেন শম্ভু মিত্র। একজন প্রখ্যাত অভিনেতা কিছুতেই একটা আবেগ-সংবলিত সংলাপ বলতে পারছেন না। তখন তিনি শম্ভু মিত্রকে দেখিয়ে দিতে বলেন। শম্ভু মিত্র বলেন, "আমি দেখাব আর আপনি আমাকে নকল করবেন? এভাবে নাটক করা যায় না। আপনি কি দস্তয়েভস্কি পড়েছেন? কাফকা? তা না হলে এই যে শূন্যতার অভিব্যক্তি, তা আপনি বুঝবেন কী করে।" অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথই হোক কিংবা ব্রেখট, স্তানিস্লাভস্কিই হোক কিংবা বাদল সরকার, অভিনয় করতে গেলে সাহিত্য পড়তে হবে। শুনেছি শম্ভু মিত্র তাঁর দলের অভিনেতাদের পরামর্শ দিতেন এই বলে যে, "সঙ্গে থাকা কাঁধের ব্যাগে বই রাখবে। যখন সময় পাবে পড়বে। বাসে, ট্রামে বসতে পারলেই দু'-চার পাতা পড়ে নেবে। রোজ অন্তত দশ পাতা পড়বে।"

শোনা যায়, তাঁর নিজের দলেই তিনি একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। এও শোনা যায় যে, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেয়নি তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা দল। তার কারণ কি ওঁর অনাবশ্যক অহংকার? অন্যকে খাটো করে দেখা? ঠিক বলতে পারব না। তবে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে তিনি অসম্ভব নির্মম ছিলেন, তা বোধহয় স্বীকার করে নেওয়া ভালো।

এখানে আরেকটি ঘটনার কথা বলে শেষ করব। রবীন্দ্র সদনে 'কর্ণকুন্তীসংবাদ' পাঠ করবেন শম্ভু মিত্র ও শাঁওলি মিত্র। সে সময় শম্ভু মিত্র মানেই লম্বা লাইন, হাউজফুল। তো তখন আমি কবি অরুণ মিত্রর ওপর একটি ছবি করছি। অরুণদাকেও সেখানে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। সেই কারণেই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। দর্শক-আসনে শঙ্খ ঘোষ-সহ নানা বিশিষ্ট মানুষজন। সেখানে পাঠের আগে শম্ভু মিত্র বলেন যে, অনেক বিজ্ঞ মানুষ আছেন এখানে। কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে একজন (যিনি এখানে আছেন) আবৃত্তি নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। আজকে তাঁকে এখানে মঞ্চে এসে দেখিয়ে দিতে হবে, স্বরক্ষেপণ নিয়ে যা তিনি বলেছেন। তারপর আমি পাঠ করব নচেৎ নয়। আমরা বুঝতে পারি যে, উনি অরুণদার কথা বলছেন। লোকে এসেছে শম্ভু মিত্র শুনতে, সেখানে এমন প্রস্তাবে ক্ষিপ্ত দর্শক-শ্রোতারা অরুণদা সম্পর্কে নানা টিপ্পনী ও মন্তব্য করতে শুরু করে। অরুণদা কানে কম শুনতেন, ফলে কিছু বুঝেই উঠতে পারছেন না। ওঁর স্ত্রী শান্তিদি অপমানবোধে কেঁদেই ফেললেন এবং অরুণদাকে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে চলে যান। যেন কিছুই ঘটেনি এমন একটা ভাব করে শম্ভু মিত্র পাঠ শুরু করলেন। আমরা হতবাক।

আগামীকাল এই মহান নাট্যাচার্যর ১০৮তম জন্মদিন।

More Articles