তালিম নিতে চাইতেন খোদ ভীমসেন যোশী, বাঙালির স্মৃতিপট থেকে মুছে গেলেন গায়ক পাহাড়ী সান্যাল!

বড় রঙিন সুতোয় বোনা ছিল সেই রাত। বৈঠকি মেজাজে চলছিল নানান মানুষের গুফতগু। এমন সময় এক বৃদ্ধ  বেহাগে অল্প আলাপ সেরে ধরলেন অতুলপ্রসাদী সুর, 'বধুয়া নিদ নাহি আঁখি পাতে।' মুহূর্তে সবাই চুপ। এমন সুস্বাদু গায়কীর কাছে নীরবে নতজানু হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর শ্রোতার কীই বা করার থাকতে পারে? বা ধরা যাক 'অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে' একই মানুষ ঠুমরি গাইছেন খামাজ রাগে, 'এ জী যাও মোরি শ্যাম।' এককালে এমন নানান সুরেলা বৈঠকের প্রাচুর্য ছিল বাঙালির জীবনে। আর তাদের মধ্যমণি হয়ে যিনি রেওয়াজি গলায় সুরের লহরী তুলতেন তাঁর নাম পাহাড়ী সান্যাল। না আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। নিজের সুরজ্ঞান কে কোনোদিনই গোপন রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। বরং, সুযোগ পেলেই তাকে এনে ফেলতেন শ্রোতাদের প্রকাশ্য সমাবেশে। আসলে আমরা অনেকেই জানি না,'দেয়া নেয়া'র মতো অসংখ্য সুপারহিট ছবির এই অভিনেতার প্রাজ্ঞ সমালোচনার ভয়ে একসময় মঞ্চে উঠে রীতিমত সতর্ক থাকতেন তাবড় তাবড় ওস্তাদরা। 

পাহাড়ী সান্যালের জন্ম হয়েছিল পাহাড়ের কোলে। আর্মিতে কর্মরত তাঁর বাবার বদলির চাকরি ছিল ফলত নানান সময় নানান জায়গায় পোস্টিং হত তাঁর। জীবনের এক দীর্ঘ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ে, আর সেখানেই তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নিলেন পাহাড়ী। পাহাড়ে জন্ম বলেই আদর করে ছেলের অমন ডাকনাম রেখেছিলেন তিনি। যদিও তাঁর ভালো নাম ছিল নগেন্দ্রনাথ। কিন্তু পরবর্তীতে পাহাড়ী নামেই বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি।  

দার্জিলিংয়ে জন্ম হলেও পাহাড়ীর প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল লখনউতে। সেখান থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উদ্দেশ্যে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখালেন তিনি। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং খুব বেশিদিন তিনি পড়তে পারেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এলেন তাঁর প্রাণের শহর লখনউতে। তারপর শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিতে আরম্ভ করলেন মরিস কলেজে। শৈশব থেকেই পাহাড়ীর সুরজ্ঞান ছিল টনটনে। কিন্তু এবার খাঁটি তালিমের উদ্দেশ্যে তাঁকে ছুটতে হল উস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন, ছোটে মুন্না খান, নাসির খানের মতো রথী মহারথীদের কাছে। গানের সঙ্গে সঙ্গে রাসবিহারী শীল এবং আবিদ খানের কাছে চলছিল তবলা শিক্ষা। এ ছাড়াও তাঁর জীবনে ছিলেন আরেক ব্যক্তি, অতুলপ্রসাদ সেন। পরবর্তীকালে তাঁর প্রভাবই পাহাড়ীর জীবনে সবচেয়ে বেশিরকম পড়েছিল।

পাহাড়ীর সংগীত শিক্ষা চলছিল পুরোদমে। লখনৌ শহরকে দিলরুবার মতো ভালোবাসতেন তিনি। নবাবী মেজাজে দামি সিগারেট আর পান মুখে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তার পথে পথে। কিন্তু এ অবস্থায় তাঁর জীবনে নেমে এলো ঘোর দুঃসময়। তাঁর বাবা গেলেন যুদ্ধে। তারপর দীর্ঘদিন কোনও খোঁজ নেই তাঁর। হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া গেল যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। পাহাড়ী অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন। এ সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন অতুলপ্রসাদ। পাহাড়ীর জীবনের নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হয়ে উঠলেন তিনি। 

হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনেমায় নেমে না পড়লে হয়ত গায়কই হতেন পাহাড়ী সান্যাল। প্রখ্যাত গায়ক হওয়ার সকল গুণাবলীই ছিল তাঁর মধ্যে। অভিনয়ের কারণে তাঁর গান কোনোদিন থেমে থাকে নি। কে এল সায়গাল বা প্ৰমথেশ বড়ুয়ার মতো গায়ক নায়কদের পাশাপাশি তিনিও নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। 'সুহাগ কি রাত' থেকে আরম্ভ করে ভাগ্যচক্র, হিন্দি বাংলা মিলিয়ে অজস্র ছবিতে তিনিই ছিলেন কন্ঠশিল্পী। তাঁর সঙ্গে ঘটা এক মজার ঘটনার কথা একবার ভীমসেন যোশী নিজের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।

ঝিঁঝোটি রাগে উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁর গান শুনে তখন যোশীজীর পাগল পাগল অবস্থা। ধারওয়াড়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। চোখে একরাশ স্বপ্ন, কঠোর তালিম নিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখবেন। অথচ গুরু পান কোথায়? সে সময় চাইলেই গুরু পাওয়া যেত না। তখন তো ঠিক পাড়ায় পাড়ায় গানের ইস্কুল গজিয়ে ওঠেনি। বড় বড় ওস্তাদদের কাছে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে তাঁদের শিষ্যত্ব লাভ করতে হত। যোশীজী এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান গুরুর খোঁজে। কখনো কারুর সন্ধান পেলে তাঁর কাছ থেকে অল্প বিস্তর তালিম নিয়ে নেন। এই করতে করতে তিনি এসে পৌঁছলেন কলকাতা। পাহাড়ী সন্যালের বাড়িতে পরিচারকের চাকরি জোটালেন। তারপর প্রত্যেকদিন মন দিয়ে শুনতে লাগলেন তাঁর রেওয়াজ। যোশীজীর খুব ইচ্ছে পাহাড়ীবাবুর কাছে গান শিখবেন। একদিন লজ্জা কাটিয়ে তাঁকে সেই প্রস্তাবখানা দিয়েই ফেললেন। পাহাড়ী কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, 'তা বাপু তোমার যা গলার আওয়াজ, ও গলায় গান হবে না।' যোশীজীর কণ্ঠস্বর ছিল কিছুটা ভারীর দিকে। পাহাড়ীবাবু নিশ্চিত ছিলেন, এ গলায় আর যাই হোক, গান হবে না। 

এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। এক সন্ধ্যায় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাহাড়ী সান্যাল গেছেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়িতে একটা মেহফিলে শুনতে। মেহফিলে গাইছেন এক অল্প বয়সী ছোকরা। দিব্যি লাগছে শুনতে। তাঁর গানের শেষে পাহাড়ীবাবু তাঁকে জিগেস করলেন, 'পন্ডিতজী, ইয়ে আপ নে অভি কৌন সা রাগ গায়া?' যোশীজী বললেন, 'জী, ম্যায় নে তো ইস কো ছায়া নাম সে শিখা হ্যায়।' তারপর পাহাড়ীবাবুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তিনি বললেন, 'বাবুমশাই, আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারছেন না। আমি সেই ভীমসেন, যে আপনার বাড়িতে নৌকরের কাজ করত।' ভারতের নানান শহর ঘুরে অবশেষে আব্দুল করিম খাঁর শিষ্য সওয়াই গন্ধর্বের কাছে তালিম নিয়ে যোশীজী তখন শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের তরুণ তুর্কি। তাঁর ওজনদার গলায় একেকটা তানের ফান্দা শুনে শ্রোতা বিস্মিত হয়ে পড়েন। সেই ভীমসেনের কথা শুনে সেদিন পাহাড়ী সান্যাল অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে।

এমন কত অজস্র গল্প যে তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তার হিসেব নেই। গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ী সান্যালের জন্মদিনে এভারগ্রিন নায়ককে শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেনি বাঙালি। কিন্তু গায়ক পাহাড়ী সান্যাল যেন আজও লুকিয়ে আছেন বিস্মৃতির আড়ালে।

তথ্যঋণ: ভীমসেন যোশীর সাক্ষাৎকার

More Articles