পাশের জেলাতেই রয়েছে 'বাংলার বেনারস', এই প্রাচীন শিবমন্দির আজও টানে ভক্তদের

অনেকে মুর্শিদাবাদের বড়নগরকে 'বাংলার বেনারস' বলেন।

পশ্চিমবাংলাকে মন্দিরময় রাজ্য বললে অত্যুক্তি হয় না। এই রাজ্যের আনাচকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নানা দেবদেবীর মন্দির। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত 'বড়নগর' মুর্শিদাবাদ জেলার একটি গ্রাম। মুর্শিদাবাদের রেলস্টেশন আজিমগঞ্জ থেকে বড়নগর যাওয়ার পথে ভাগীরথীর তীরে একটি শিবমন্দির দেখা যায়, এটি 'পঞ্চমুখী বা পাঁচমুখী' শিবমন্দির নামে খ্যাত। ত্রিখিলান প্রবেশপথ বিশিষ্ট দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটির টেরাকোটার অলংকরণ দর্শনীয়। দোচালা বা একবাংলা শৈলীর ধাঁচে তৈরি এই মন্দির।

নাটোরের রানি ভবানী, তাঁর জমিদার স্বামী রামকান্ত রায়ের মৃত্যুর পর জমিদারির দায়ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার রাজশাহী, রংপুর, যশোহর এবং মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদা ইত্যাদি স্থানগুলি শাসন করতেন তিনি। স্বামী জমিদার রামকান্ত রায়ের মৃত্যুর পরে তিনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে এই বড়নগরে বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় প্রজারা রানিমা-কে খুব মান্য করতেন। অপার দান-ধ্যান এবং অঞ্চলের প্রভূত উন্নয়নের ফলে রানি ভবানীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রানি ভবানী ছিলেন অত্যন্ত ভক্তিমতী, তিনি বড়নগরে বিভিন্ন স্থানে মোট ১০৭টি শিব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শিবভক্ত। অনেকেই মনে করেন, বড়নগরে এসে কোনও মন্দিরে মনোবাসনা জানালে সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ হবেই। এই কারণেই অনেকে বড়নগরকে 'বাংলার বেনারস' বলেন।

Barnagar Murshidabad

বাংলার বেনারস

পঞ্চমুখী শিবমন্দিরটি বড়নগরের বিশেষ আকর্ষণ।এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটির পাঁচটি মুখ রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী এই পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গর পাঁচটি মুখের আলাদা আলাদা নাম।

আরও পড়ুন: মন্দির ভাঙতে এসে দেবীর পদতলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কালাপাহাড়

১) অঘোর: এই মুখটি ডানদিকে।এই দক্ষিণমুখী শিবের রূপ সাধারণ ভয়ংকর ও প্রলয়কারী হয়।

২) তৎপুরুষ: শিবের এই রূপটি অত্যন্ত প্রসন্ন। মন্দিরের দরজার সম্মুখভাগে এটির অবস্থান।

৩) বামদেব: এটি মূলত দেবী পার্বতীর একটি রূপ বলে ধারণা করা হয়। এটি লিঙ্গর বামদিকে অবস্থান করছে।

৪) সদ্যোজাত: এই রূপটি তৎপুরুষ রূপের বিপরীত দিকে রয়েছে। শিবের এই রূপটি শিশুসুলভ বলেই এই রূপটিকে সদ্যোজাত বা প্রসিদ্ধ বলা হয়।

৫) ঈশান: এই রূপটি শিবলিঙ্গের উপরিভাগে অবস্থান করছে। যেন মহাকাশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে।

রানি ভবানী ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় 'নাটোর' রাজবংশের প্রথম মহিলা জমিদার। আনুমানিক ১৭৫৩-'৫৪ সালে রানি ভবানী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কালের নিয়মে ধ্বংসপ্রায় মন্দিরের পুনরায় সংস্কার করেন (১৯৪০ সাল) স্থানীয় এক জৈন ব্যবসায়ী। নেপালের পর ভারতের আর কোথাও এই বিরলতম পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ দেখা যায় না। মহা শিবরাত্রিতে ও শ্রাবণ মাসে এই মন্দিরে ভক্তের ঢল নামে।

নাটোরের রানি যে শুধুমাত্র এই পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই নয়,এই স্থানটিকে তিনি মন্দিরময় করে তুলেছিলেন। রানি ভবানীর অপূর্ব কীর্তির মধ্যে ভবানীশ্বর শিবমন্দির অন্যতম।এই মন্দিরটিতে টেরাকোটার অল‌ংকরণ দর্শনীয়। মন্দিরটি আটকোণাকৃতি, উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট, গম্বুজাকৃতি মন্দিরের মাথায় আটটি পাপড়িবিশিষ্ট পদ্মের অবস্থান।আটটি প্রবেশদ্বার। অলিন্দ-যুক্ত ভাস্কর্যময় এই মন্দিরের পাশে আরও একটি সুন্দর মন্দিরে মা মহিষমর্দিনী দুর্গার 'রাজরাজেশ্বরী' মূর্তিটি অষ্টধাতুর তৈরি। অপূর্ব কারুকার্যখচিত, অলংকরণসমৃদ্ধ, রণসম্ভারে সজ্জিতা এইরকম মূর্তি সাধারণত দেখা যায় না। এছাড়া আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি, যেমন, মহালক্ষ্মী, জয়দুর্গা, মদনগোপাল, বিষ্ণু প্রভৃতি। অনতিদূরেই রানি ভবানীর কন্যা 'তারাসুন্দরী'-র নির্মিত গোপাল মন্দির। কালের করালগ্রাসে মন্দিরটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায়।

Temple

পঞ্চমুখী শিবমন্দির

পাশাপাশি গঙ্গেশ্বর, নাগেশ্বর শিবমন্দির, কস্তুরীশ্বর ইত্যাদি মন্দিরগুলিও জীর্ণ ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে।রাজবাড়িটিও প্রায় বিলুপ্তির পথে। পঞ্চমুখী শিবমন্দিরের জন্য বড়নগরের খ্যাতি থাকলেও, অজস্র মন্দিরের অবস্থান রয়েছে এই বড়নগরে। রানি ভবানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ভাগীরথীর তীরে একটির পর একটি মন্দির গড়ে ওঠে। রানি ভবানী মাতার ইচ্ছা ছিল বড়নগরকে কালীধামে পরিণত করা। ১৮৯২ সালে বড়নগর-সংলগ্ন রূপপুর গ্রামে রানি ভবানী রুদ্রদেবের একটি মন্দির তৈরি করান। সুতি থানার অন্তর্গত বংশবাটি গ্রামে 'বৃদ্ধেশ্বরী দেবী'-র পূজা প্রচলন করেন রানি ভবানী। এখানে দেবীমূর্তি পক্ষীরূপা। কথিত আছে, দ্বাপরে কংস-র কারাগার থেকে যশোদার কন্যারূপে জন্মগ্রহণকারী মহামায়া পক্ষীরূপ ধারণ করে কারাগার থেকে উড়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই রূপ কল্পনা করে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।রুদ্রদেবের মন্দিরটি দেখে, আপাতদৃষ্টিতে মন্দির বলে মনে হয় না, কারণ এটি একটি সাধারণ পাকা দালানঘরমাত্র। সামনে রয়েছে একটি টানা বারান্দা। মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে প্রায় দেড় ফুট উঁচু এবং এক ফুট চওড়া কালো পাথরের তৈরি বুদ্ধদেবের একটি ধ্যানী মূর্তি। বেদির ওপর একটি পদ্মফুল এবং তার উপর যোগাসনে উপবিষ্ট এই মূর্তিটি। মূর্তিটির ডান হস্ত নাভিমূলে এবং বামহস্ত ভূমি স্পর্শ করে রয়েছে।‌ এই বুদ্ধমূর্তিই এখানে রুদ্রদেব নামে খ্যাত এবং শিবজ্ঞানে পূজিত হয়ে আসছেন। মন্দিরে রুদ্রদেবের মূর্তি ব্যতীত দারুকাঠের নির্মিত বাণেশ্বর মূর্তি রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের দুইপাশে চারটি চারচালায় মহাদেব শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

বড়নগরের অনতিদূরেই রয়েছে কান্দি থানার অন্তর্গত দোহালিয়া গ্রাম। এইখানে কালীভক্ত রানি ভবানী দক্ষিনাকালীর মন্দিরটি স্থাপন করান। এই মন্দিরটি সিদ্ধপীঠ বলে খ্যাত। মন্দিরটির অভ্যন্তরে উঁচু বেদির ওপর সিঁদুরচর্চিত দেবী কূর্মাকৃতি এক ব্রহ্মশিলা।শিলাটির গায়ে সোনার জিভ এবং চোখ লাগানো আছে। গ্রামবাসীরা এই দেবীকে দক্ষিণাকালী রূপে পুজো করেন এবং বিশ্বাস করেন, এই দেবী সকল মনোবাসনা পূরণ করেন। কালীমন্দিরটির পশ্চিমদিকে পাঁচটি এবং পূর্বে দু'টি শিবমন্দির রয়েছে। এই মন্দিরগুলি কান্দির সিংহ রাজপরিবার দ্বারা নির্মিত।এছাড়া এখানে ধর্মরাজ মন্দির, কপিলেশ্বর মন্দির, চন্দ্রশেখর মন্দির প্রভৃতি বিরাজমান।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সূর্যতপা আদক

More Articles