লাইভ বোমাবাজি, অভাব-লোভের মশলা মাখা পঞ্চায়েত নির্বাচন এবার কতটা 'হিট'?

Panchayet Election 2023: অভাবের সংসারে শাসকই ভরসা। বেশিরভাগ মানুষ শাসক দলের সঙ্গেই থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।

পঞ্চায়েত নির্বাচন যেন একটা সিনেমার মতো বা ওয়েব সিরিজ বললেও হয়। কেমন হবে, কেমন হবে — এই ভাবনা নিয়েই আমজনতা টিভির সামনে বসে রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা হাতড়াচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও গিলছে। এবার তো অনুব্রত নেই। তাহলে কতটা জমবে এই 'থ্রিলার'! আদালত কি সরকার ও কমিশনকে টাইট দেবে? ক'টা লাশ পড়লে 'সিনেমা' হিট করে যাবে? লাইভ বোমাবাজি থাকবে তো? বা নিদেনপক্ষে ভোট-প্রার্থীদের বেদম মারার সিনগুলো? এবারের ভিলেন কে? নায়কই বা কে? ভিলেন কি নির্বাচন কমিশনার বা শাসক দলের কেউ হবে? নায়ক কি তবে আদালত না রাজ্যপাল না পাশা উল্টে মীরা পাণ্ডের মতো কেউ?

গরমে নাজেহাল হয়ে, লোডশেডিংয়ের চাপে রাতে এসির হাওয়া না খেতে পেয়ে ইতিমধ্য়েই তিতিবিরক্ত আম বাঙালির একমাত্র বিনোদন এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনই। মূল বিষয়গুলি নিয়ে না ভাবলেও চলবে। 'পঞ্চায়েত-সিনেমা' গোগ্রাসে খাও। শুধু লাশের সংখ্যা গুণে যাও। মাঝে মাঝে হায় হায় করো।

ফার্স্ট হাফে সিনেমা খুব একটা হতাশ করেনি। অনুব্রতর জায়গা নিয়ে নিয়েছে ভাঙড়। লাইভ বোমাবাজি দেখা হয়ে গেছে। সাইড-স্টোরি হিসেবে চোপড়াও হতাশ করেনি। বডি পড়েছে। আদালতের সিনগুলো একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে বটে। এখনও কেন্দ্রীয় বাহিনীর এন্ট্রি হয়নি। তবে 'প্রতিরোধ' ভালো লাগছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার সংখ্যাটা বেশ যুতসই হলো না এখনও।

এই চেনা সিনেমার ছক ছেড়ে না তো বাংলার রাজনৈতিক দলগুলি নতুন কিছু করতে পারল, না তো আম জনতা সত্যিই নতুন কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল যাতে সিনেমার চেনা প্লটগুলো পাল্টে যেতে পারে। পঞ্চায়েত নির্বাচন কেন, বাংলার কোনও নির্বাচনেই হিংসা নতুন কিছু নয়। কোনও কোনও বাঙালি গর্ব করেনও হয়ত— দেখো আমাদের রাজ্যের মানুষ কত রাজনীতি সচেতন। এ আসলে নিজের অধিকারের লড়াই। আসলে ভিন রাজ্যের বন্ধু-পরিচিতদের কাছে মুখ লুকনোর একটি অজুহাত ছাড়া এসব আর কিছু নয়।

আরও পড়ুন- ২০১৮-র মাশুল পঞ্চায়েত ভোটে গুনতে হবে তৃণমূলকে? গেরুয়া বিপদ কতটা দোরগোড়ায়

একটি গ্রামভিত্তিক দেশে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামের মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য এর থেকে শক্তিশালী ব্যবস্থা আর কী হতে পারে! স্বাধীনতার পর থেকেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থাকলেও তার হাতে ক্ষমতা দেওয়ার কাজটি হতে আরও সময় লেগেছে। ১৯৯২ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী গ্রাম পঞ্চায়তকে 'স্থানীয় সরকারের' পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালেই পঞ্চায়েত আইন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বামফ্রন্ট শুধু কৃতিত্ব পায় এই কারণেই যে তারা ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পরে নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন করিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে গ্রামের গরিব মানুষদের, ক্ষেত-মজুর, কৃষকদের ক্ষমতায়ন করেছে। আবার পশ্চিমবঙ্গই সেই বিরল রাজ্য যেখানে দলের প্রতীকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচু স্তরে অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েতে দলের প্রতীকে ভোটে লড়েন প্রার্থীরা।

যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামের মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার, নিজের এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল, সেটি আজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। এ শুধু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার নয়। এটি সারা দেশেই দেখা যাচ্ছে।

অভাব, লোভ ও অসহয়তা থেকেই পঞ্চায়েতি রাজের এই দুরবস্থা। একবার ভেবে দেখুন ওই মানুষগুলো যারা লাঠি হাতে দৌড়চ্ছে বা বোমা ছুঁড়ছে, হাতে পিস্তল নিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, বিরোধী ও শাসকদলের হয়ে রাস্তায় মার খাচ্ছে বা দিচ্ছে তারা কারা? গুণ্ডাবাহিনী। সমর্থক। তারা তো আর শওকত মোল্লা, আরাবুল কিংবা অনুব্রত মণ্ডল নয়। এই সিনেমার হিরো তো নয়। তারা বোড়ের দল। এই ঠ্যাঙারে বাহিনীর প্রত্যেকের মধ্যেই হয় অভাবের তাড়না অথবা লোভী মন আঁকুপাঁকু করছে। কারও বা অসহয়তা।

যখন একটি রাজনৈতিক দল অনেকদিন ধরে রাজত্ব করে, তখন বোঝা যায় যে একটি অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাজ করছে সমাজে। মানে মানুষের রোজগারের পথগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। তখন রাজনৈতিক স্থিতবস্থা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ শাসক দলের বদান্যতাতেই তখন বেঁচে থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে। শাসক দলও এর সুযোগ নেয় যতক্ষণ না বিরোধীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে। তার জন্য সন্ধিক্ষণের প্রয়োজন হয়।

অর্থনৈতিক অভাবের তাড়নায় গ্রামের সাধারণ জনগণ ও এই ঠ্যাঙারে বাহিনী রাজনৈতিক দলগুলির পায়ে নিজেদের সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দু'পয়সা যা পাওয়া যায়- সরাসরি, হাতে হাতে বা সরকারি সাহায্যের মোড়কে। শাসক দলের সঙ্গে না থাকলে সেই সাহায্য পাওয়া মুশকিল।

১০০ দিনের কাজ কমে গেছে। দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে জব কার্ড থাকলেও কাজ নেই। চাষ থেকে আয় সীমিত হয়ে গেছে। ফলে চাষের কাজে বহু কৃষকের ছেলেমেয়ের মন নেই। কিন্তু গ্রামে কাজও তেমন নেই। এ রাজ্যে এমন বড় কোনও শিল্প আসেনি যে দলে দলে ছেলেমেয়েদের কাজের সুযোগ হবে। ছোট-মাঝারি শিল্পে কাজের সুযোগ সীমিত। শহরে উপচে পড়া ভিড়। এত দিনে বোঝা হয়ে গেছে সরকারি চাকরি পেতে কতটা পরিমাণে ঘুষ দিতে হয় রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের। ডিএ নিয়ে টালবাহানায় রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রী বলে দিয়েছেন রাজ্য সরকারি চাকরি না করে কেন্দ্রের চাকরি খুঁজতে। তাই 'করমণ্ডল এক্সপ্রেস' ধরতে হয় রাজ্যের খেটে খাওয়া মানুষদের। অথবা ভরসা করে থাকতে হয় শ্রী-সাথী বা ভাণ্ডার-প্রকল্পের দিকে। দু'মুঠো যা পাওয়া যায় আর কী! শাসক দলও বেঁধে ফেলে সাধারণ মানুষকে। সামাজিক সুরক্ষা কবচই তখন গলার হার হয়ে যায়। আর্থিক ক্ষমতায়নের বদলে আর্থিক-নির্ভরতা তৈরি হয় সরকার-শাসকদের উপর। আর এই প্রকল্পের ভাগ পাওয়া যাবে কী করে? শাসকের হাত ধরে থাকলে।

ইতিমধ্যেই 'শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি-সিনেমা' আমরা দেখে নিয়েছি। বুঝে গিয়েছি পুরসভায় চাকরি পেতে পকেটে কতটা জোর থাকতে হয়। সরকারি সাহায্যে বাড়ি তৈরি করতে গেলে কাকে ধরতে হয়। এমনকী ঝড়ে বাড়ির চাল উড়ে গেলে কে সেই মাথার ছাদ তৈরি করে দিতে পারে এবং কীভাবে পারে। অনেক নেতাই তো প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন শাসককে না জেতালে এলাকায় রাস্তা তৈরি হবে না বা একটি জাতি-ভুক্তির সমস্যা নিয়ে কথোপকথনে যুবরাজ বলে দিয়েছেন, "আপনারা আমাদের ভোট দেন না।" তার মানে ভোট দেন না বলেই তাদের সমস্যা তাদের। শাসক দলের নয়।

সুতরাং অভাবের সংসারে শাসকই ভরসা। বেশিরভাগ মানুষ শাসক দলের সঙ্গেই থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তারা চাইবেন স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নে এগিয়ে থাকে শাসক দল। নির্বাচনের ফলাফলেও খুব হেরফের হওয়ার কথা নয়।

কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। হয় তাদের গায়ে ছাপ লেগে গেছে যে তারা 'বিরোধী' অথবা শাসকদলের থেকে তারা কিছুই পাননি। হয়তো পাওয়ার আশাও করেন না আর। অথবা বিরোধী দলের লোকজন ক্ষমতায় এলে কিছু পেতে পারেন এই আশা রাখেন। আর না হলে একদম 'আদর্শের' দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাদের সংখ্যাটি কম।

এই পুরো চিত্রটি বাম আমলের ক্ষেত্রেই সত্যি। তৃণমূল আমলেও সত্যি। বামেরা তিন দশকের বেশি রাজত্ব করেছেন। তৃণমূলের এক দশক হয়ে গেল।

আরও পড়ুন- মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?

এ তো গেল অভাবের কথা। লোভ তবে কোথায়? ক্ষমতায়। যতই সমাজকল্যাণ, জনকল্যাণের কথা হোক, দিনের শেষে রাজনীতি আসলে ক্ষমতা দখলের খেলা। যার যত ক্ষমতা তার তত টাকা না হোক, প্রতিপত্তি তো বটেই। ধরে নিন আমাদের রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রীর কথাই। বিরোধী দলে থেকেও টালির ঘরে থাকতেন। শাসকের চেয়ারে বসেও টালির ঘরে থাকেন। সবচেয়ে বড় তফাৎ এখন তাঁর কথায় পুলিশ ও আমলারা ওঠাবসা করেন। আগে সেই পুলিশ-আমলারাই হেনস্থা করতেন তাঁকে।

একইভাবে গ্রামের 'সরকার' পরিচালনার দায়িত্বে আসতে পারলে সরকারি টাকার বন্টনের দায়িত্বও তাঁর হাতে আসবে। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি টাকা পঞ্চায়েতের কাজের জন্য আসে। সেই টাকার ভাগ-বখরা করার দায়িত্বে থাকেন গুটিকয়েক মানুষ। অফিস-বাড়িতে দিন রাত ভিড় করবে অভাবের তাড়নায় আসা সাক্ষাৎপ্রার্থীরা। একটি বা একাধিক গাড়ি হবে। বাড়িও হবে। যে কোনও গ্রামে গিয়ে শুধু পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িটি দেখে আসুন, বুঝে যাবেন। এই যে অনুব্রত মণ্ডল। কোনও সরকারি পদে না থেকে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়ে কীসের লোভে হম্বিতম্বি করতেন! ক্ষমতার লোভেই। সম্পত্তি বাড়িয়েছেন সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই।

বাম আমলে গ্রামের গরিব-গুর্বোদের ক্ষমতায়নের কথা বললেও আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল গ্রামের গণ্যমান্যের হাতে। বেশিরভাগ পঞ্চায়েতের মাথায় বসেছেন গ্রামের শিক্ষকরা বা বড় চাষি। যদিও বাগদি পাড়া থেকে বা পরে কোনও মহিলা পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছেন বা সংরক্ষিত প্রধানের পদে বসেছেন, ছড়ি ঘুরিয়েছেন সেই গণ্যমান্যরা বা পার্টি। দলের হাতে যাতে ক্ষমতা থাকে তা নিশ্চিত করা হয়েছে প্রতি পদে পদে।

তৃণমূল আমলে সেই ক্ষমতা দলের কিছু বেয়ারা নেতার হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। তাই নন্দীগ্রামে জাহাজ-বাড়ি হয়েছে। আমফানের ত্রাণের টাকা ও সাহায্য পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে বা আত্মীয়স্বজনের ঘরে গেছে। সরকারিভাবে নিদান দিতে হয়েছে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার। আর ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ শুধু নামেই রয়েছে। জেলায় জেলায় রিভিউ মিটিংয়ে সরকারি কাজের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেছে খানিকটা হলেও। কিন্তু গ্রামের মানুষের হাত থেকে গ্রামের উন্নয়নের ক্ষমতা কীভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। সিদ্ধান্ত একজনই নেন, তাও উপর থেকে।

এই অভাব ও ক্ষমতার মাঝে রয়েছে অসহয়তা। যাদের হয়তো সে অর্থে অভাব নেই বা ক্ষমতার লোভ নেই, তারা ফেঁসে রয়েছেন মাঝখানে। রাজনৈতিক স্থিতবস্থা তাদের জন্য মন্দের ভালো। কে রক্ষা করবে তাদের? শাসকের কোপে পড়ার থেকে চুপচাপ থাকা ভালো। আর এ সবেরও মাঝে রয়েছে বিনোদন-প্রেমী বাঙালি। আমরা যারা লাশ গুনছি, লাইভ বোমাবাজি-গুলিবাজি দেখছি, সন্ধেবেলায় পাড়ার চায়ের দোকানের মতো অনর্থক আলোচনা শুনছি- তুই আমার চুল টেনেছিলি, আমিও তোর চুল টানলাম, এবার কী করবি— গোছের আলোচনা।

নাগরিক সমাজ হয় বিকিয়ে গেছে অথবা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে তাই দলীয়-সমাজই রাজত্ব করছে, করবে। হিংসা চলতেই থাকবে। আমরা 'সিনেমা' দেখতেই থাকব।

More Articles