চিরন্তন স্বার্থ-রাজনীতির ফাঁদ ও একা সুজেট
Park Street Gangrape Case: ভিড়ের ঝাঁকে মিশে থাকা সুপার কনফিডেন্ট পুরুষটি কখন সুপার অ্যাকটিভ হয়ে উঠতে পারে সে কথা হাড়ে মজ্জায় জেনেছিলেন সুজেট জর্ডন।
১৪ অগস্ট, ২০২৪। সন্ধে রাতের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। শহর-শহরতলি বেয়ে আবেগ উত্তেজনা জমাট রাগ জড়াজড়ি হয়ে ট্রেনে-বাসে, অটো-ওলা করে এদিক ওদিক থেকে নারীরা ছুটে চলেছে রাতের দখল নিতে। আমিও চলেছি সেই দখলের সাক্ষী হতে। এই শহরে সরকারি হাসপাতালের ভিতরে রাতে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসক খুন-ধর্ষণ হয়েছেন গত ৯ ই আগষ্ট ২০২৪। এতটা সময় পার করেও সরকার 'আসল' অপরাধীকে ধরতে নিরুপায়! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পাতাল রেলের সিঁড়ি টপকে দরজার কাছে পৌঁছতেই বোঝা গেল বৃষ্টি পড়ছে। কত বয়সের কত রকমের পুরুষ সেই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার, কোনও বয়সের কোনও নারী-ই কিন্তু সেখানে দাঁড়াচ্ছেন না। কেন? কৌতূহলের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেল, আবার তড়তড়িয়ে নিচের দিকে নেমে গান্ধি চরকা-গান্ধি পোর্টেট ভালো করে দেখে মনোযোগ বাড়িয়ে নিয়ে আবার শুরু হল সিঁড়ি চড়া। গেটে-র কাছে মিনিট দেড়েক দাঁড়াতেই কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। ভিড়ে মিশে থাকা চোখ দিয়ে ধর্ষণ করে চলা সেই সুপার কনফিডেন্ট পুরুষের উপস্থিতি।
ভিড়ের ঝাঁকে মিশে থাকা সুপার কনফিডেন্ট পুরুষটি কখন সুপার অ্যাকটিভ হয়ে উঠতে পারে সে কথা হাড়ে মজ্জায় জেনেছিলেন সুজেট জর্ডন। সামাজিক অনুশাসনের নিয়ম মেনে কাপড়ের আড়াল নিতে বাধ্য হয়ে থাকার মানসিক-শারীরিক জড়তা কাটিয়ে মেয়েটি দিন কয়েকের ব্যবধানে সটান নিজেই সেই আড়াল তছনছ করে আত্মপরিচিতি স্পষ্ট করেছিলেন। মাঝরাতে চলন্ত গাড়ির ভিতরে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় গণধর্ষিতা সুজেট জর্ডন। দেশপ্রেমের ধুয়োধরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের গায়ে লেগে থাকা বাছাই করা শব্দবাণ এমন পেশাদার ভঙ্গিমায় নিক্ষেপ করলেন, যাতে নারীচরিত্র নিয়ে বিচারসভার রগরগে দরবার তৈরি হয়। আড়ালে চলে গেলেন ধর্ষক কাদের খান, নাসির খান, রুমান খান, সুমিত বাজাজ। মন্ত্রিসভার পারিষদবর্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঝালা ফর্মে সদা প্রস্তুত থাকলেন রাতে-চলা নারী, পান শালায় পুরুষ বন্ধু জোটে এমন নারী 'বেজায় খারাপ' — এই বলে। সেই খারাপের নমুনা ও সেই ফর্দ নিয়ে তারা সদা তৎপর থাকলেন।
আরও পড়ুন: ৫১ বছর আগে ধর্ষণ করে কুকুরের চেন দিয়ে শ্বাসরোধ! মনে পড়ে নার্স অরুণা শানবাগকে?
মাননীয় ভদ্রমহোদয়-মহোদয়ারা বিলক্ষণ জানতেন সাদামাটা নিপাট সত্য একটা সময় মিথ্যার মোটা পর্দা ফুটো করে হাড়হিম করা মৃত্যুভয় শিরদাঁড়ার উপর থেকে নীচ অবধি কীভাবে বয়ে যেতে পারে। সুকুমার রায়ের 'গন্ধ বিচার' কবিতায় মিথ্যার এমনই এক অ্যাখ্যান ফাঁস করেছিলন অশক্ত নড়বড়ে শরীরের এক বুড়ো। বুদ্ধি সাহস ও মনোবলে ভর করে। সেই আপাত নড়বড়ে-ভঙ্গুর স্বভাবের নারী পর্দা-লজ্জার আড়াল ভেঙে প্রকাশ্যে দাঁড়ালে পরিণাম কোথায় পৌছাতে পারে সেই সাহস-অভিজ্ঞতা ও পথ চলার পাঠ আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ধর্ষিতা সুজেট জর্ডন। হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছিলেন। ব্যবহার হওয়া পিতৃতান্ত্রিক মন-মানসিকতা-শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে। হাতে কলমে প্রমাণ হল পিতৃতান্ত্রিক মন-মানসিকতার বাহক এ দেশের শাসক শ্রেণী। রাতের পানশালায় সদ্য পরিচিত পুরুষ কতটা বেআব্রু হয়ে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে আর তার থেকেও বেশি বেআব্রু হয়ে সরকারপক্ষ কীভাবে ধর্ষকের রক্ষক হয়ে উঠতে পারে, সেই স্বার্থ জড়িত রাজনীতিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল আরও একবার। এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকারে থাকা শাসক আজও সেই গদিরই কর্তা। স্বার্থ-রাজনীতির কোন পাঠশালায় শাসক সরকার দণ্ডী কাটছেন, সেই তুলনামূলক সমীকরণগুলি স্মরণ করা এই সময়ে যেন আরও বেশি জরুরি।
কেন্দ্রে ন্যায়ের ধ্বজাধারী তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসা মোদি সরকার ১ জুলাই, ২০২৪ থেকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বলবৎ করার দিকে ফরমান দিল। নাগরিকদের সুরক্ষার দিকে নজর দিতে নারী-শিশু সুরক্ষা ন্যায় বিচার পাওয়ার দিকে লক্ষ্য রেখে সংস্কারের দিকে নজর দিলেন। জোর দিলেন অভিযুক্তদের অধিকার-রক্ষায়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিপুণ সাক্সেনা এই আইনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জানালেন, আগে দেশের সংবিধান স্বীকৃত আইন অনুসারে কোনও নারী ধর্ষিতা হলে থানার কর্তব্যরত পুলিশ তাঁর বক্তব্য নথিভুক্ত করে শরীর সংক্রান্ত বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে উদ্যেগী হতে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু ন্যায় সংহিতার হাত ধরে সংবিধান স্বীকৃত যে আইন লাগু হয়েছে, তাতে ধর্ষিতা বা নির্যতিতা নারী বয়ান নথিভুক্ত করা হবে কি হবে না, গোটাটাই কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিকের উপর নির্ভর করবে। কর্তব্যরত পুলিশ তদন্তের জন্য পরে নির্যাতিতার বয়ান নথিভুক্ত করবেন বলে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। এমনকী তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষাও এড়িয়ে যেতে পারেন। ফলত নারীর শরীর-মনের উপর নির্যাতন হলে আইন-বিচার সবটাই হবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন: পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে গণধর্ষণ, বিলকিস বানো মামলার নেপথ্যে যে ভয়াবহ ইতিহাস
রাষ্ট্রের এই মন-মর্জি-মানসিকতাকে আমরা কী বলব? 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'? রাষ্ট্র কি সংবিধান স্বীকৃত আইন ব্যবস্থাকে অমানবিক হয়ে ওঠার তালিম দেওয়ার চেষ্টা করছেন না? ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে পুলিশের কাছে যেতে দু-তিন দিন সময় লেগেছিল তাঁর। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে সুজেট জর্ডন যখন থানায় এফআইআর জন্য পৌঁছন, পুলিশ তাঁর সঙ্গে অমর্যাদাকর, অশালীন ব্যবহার করে। মেডিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গড়িমসি করেন পুলিশ। সেই তথ্য ইন্টারনেট ঘাটলে এখনও পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে সেই সময়কার সংবিধান-স্বীকৃত আইন মোতাবেক পুলিশ কিন্তু বাধ্য ছিলেন নির্যাতিতার বয়ান নথিভুক্ত করতে। তা সত্বেও পুলিশের অমানবিক বর্বর স্বভাবই প্রকাশ পেয়েছিল। সেই কারণেই বলবৎ হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ও শাসকের স্বার্থ-রাজনীতির এই ফাঁদ অতিক্রম করতে পিছন ফিরে তাকানোটা বোধহয় অত্যন্ত জরুরি।